চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের মহাপরিকল্পনা প্রশংসনীয়

| রবিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। উত্তর কাট্টলীস্থ পোর্ট লিংক রোডের পাশে ৩০ একর সরকারি জমির উপর এ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক বলেছেন, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পর এটি হবে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মৃতিসৌধ।
আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, অর্জিত হয়েছে অনেক অর্জন। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুষ্প্রাপ্য আলামত নষ্ট হয়েছে, অনেক স্মৃতি অসংরক্ষিত রয়ে গেছে। এছাড়া এ যাবৎকালে সরকারিভাবে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অন্যান্য সংস্থার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের যত ধরনের সংগ্রহ রয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ম্যানুয়াল ও কাগজে সংরক্ষিত। ফলে এসব দলিল-দস্তাবেজ আগামীতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সব ধরনের তথ্য ও দলিল ম্যানুয়ালের পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
গত বৃহস্পতিবার উত্তর কাট্টলীস্থ পোর্ট লিংক রোডের পাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ঢাকার পরে মুক্তিযুদ্ধের সুঁতিকাগার চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জায়গাগুলো সংরক্ষণ করবো, যাতে তারা ইতিহাস বিকৃত করতে না পারে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মহাপরিকল্পনা চলছে। একমাস পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জায়গা দেখে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসেন বলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এ বিষয়টিতে সম্মতি দিয়েছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন। বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। আমরা শিগগিরই এটি করবো। এ জমিগুলো প্রতীকী মূল্যে আমাদের মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হলে আমরা সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো ও দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আপনাদের যে পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ করবো আমরা। পরবর্তীতে যেন মানুষের সামনে তা উপস্থাপন করা যায় সে ব্যবস্থা করবো। এখানে বড়পরিসরে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্যও নির্মাণ করা হবে।
চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের মুখ’। তাই চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত দলিল সংরক্ষণ করা অনেক জরুরি। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধ অপরিচিত থেকে যাবে। ইতিমধ্যেই অনেক স্থাপনা ও দলিল নষ্ট হয়েছে। তবে দেরি হলেও এখনো সময় চলে যায়নি। এ জন্য এখনই উদ্যোগী হওয়া উচিত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যগুলোকে অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণ করার।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময়ই এটা সংরক্ষণ করা যায়। এখনো অনেক দলিল আছে অবিকৃত। এগুলো চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কাগুজে ইতিহাস সংরক্ষণ করা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি নষ্ট করাও অনেক সহজ। আর তাই ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের সবচেয়ে গৌরবের এ সময়টা সংরক্ষণ করতে হবে।
এখানে উল্লেখ করতে পারি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ৬২ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার প্রকল্প নিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ‘দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের অডিও ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। গত ১০ আগস্ট একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের নথি, বই, চিঠিপত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্মরণিকা, ছবি, মানচিত্র, চুক্তিপত্র, সাক্ষাৎকার, দিনপঞ্জি, অডিও-ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করবে সরকার। জানা যায়, অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহে ছিল না দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। হয়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আর্কাইভ। সংগ্রহে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ১ হাজার ৫৫১টি নথি জাতীয় জাদুঘরে পড়ে আছে অযত্নে।
মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামকে আগলে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এই চট্টগ্রাম থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এম এ হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জননেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সহ অনেক বড় নেতা চট্টগ্রামের। তাই বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের কথা সবসময় বলতেন এবং চট্টগ্রামকে ভালোবাসতেন। বর্তমানেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশেষ গুরুত্ব দেন এ চট্টগ্রামকে। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ বিষয়ে চট্টগ্রামবাসীর ইচ্ছা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা যাতে পূর্ণ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাইরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংরক্ষণ করেছে অনেক দেশ, আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়। সেসব সংগ্রহে কখনো উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার। মুক্তিযুদ্ধের এসব দলিল ছাড়া সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন ও তথ্য বিকৃতি রোধ করা কঠিন। এসব উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষণের বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে