চট্টগ্রামে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’র প্রদর্শনী শুরু

এ চলচ্চিত্র আমাদের জন্য গর্বের : মেয়র প্রীতিলতার ত্যাগ অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে : এম এ মালেক

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, রাত দশটা। চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবের সাহেবমেমরা তখন নাচগান আর খানাপিনায় মত্ত। এই ক্লাবে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল, যাতে লেখা ছিল ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। মাস্টারদা সূর্য সেনের নির্দেশে প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীদের একটি টিম এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতে নির্দিষ্ট সময় ক্লাবটি ঘিরে ফেলেন।

 

হঠাৎ গোটা ক্লাবঘর কেঁপে উঠল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। সেই সঙ্গে কয়েকটি পিস্তল ও বন্দুক থেকে চলছিল গুলি। কণ্ঠে বাজলো দামামা, ‘বন্দে মাতরম’। অপারেশন শেষে দলনেত্রীর নির্দেশে সবাই চলল গন্তব্যের দিকে। কিন্তু দলনেত্রী? পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতল ঢেলে দিল মুখে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মাটিতে, কুড়ি বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

মৃত্যুর আগের দিন অজ্ঞাতবাস থেকে মাকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রীতিলতা লিখেছিলেন, দেশের স্বাধীনতা যজ্ঞে অনেক পুত্র প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু কোনও কন্যা এখনও প্রাণ দেয়নি। তাঁদের অনুপ্রেরণা দিতেই মৃত্যুবরণ করছেন তিনি।

‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ সিনেমার শেষদিকের দৃশ্য এটি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনের ওপর কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’।

অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সংগ্রামী জীবন নিয়ে নির্মিত ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’র প্রদর্শনী গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে।

শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় নগরীর যাত্রা মোহন (জে এম) সেন হলে চলচ্চিত্রটির উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এসময় একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

সিটি মেয়র বলেন, প্রীতিলতা নামটি শোনার সাথে সাথে গর্বে আমাদের বুকটা ভরে উঠে। তাঁর ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ দেশের জন্য গৌরবের। প্রীতিলতা যখন অস্ত্র নিয়ে ইউরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণ করতে গিয়েছিল তখন মেয়েদের অবলা বলা হতো।

প্রীতিলতা প্রমাণ করে দিয়েছেন বাঙালি নারীরা সব পারে। শুধু অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ নয়। এ ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে প্রীতিলতা সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পুরো বিশ্বের বুকে চট্টগ্রামকে চিনিয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রীতিলতার জীবনীর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। প্রীতিলতাকে নিয়ে আমাদের

আরো কাজ করতে হবে। এ সিনেমা দেখে মনে হচ্ছে আমরা সে যুদ্ধদিনে ফিরে গিয়েছি।

একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার মানসে যুগে যুগে তাজা প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন প্রীতিলতার মত আত্মত্যাগী তারুণ্য। তার মাধ্যমে এ বিশ্বভুবন তাদের মনে রেখেছে, তাদের নিয়ে ছবি করছে।

প্রীতিলতার জীবনের অন্ধকার অংশের ওপর প্রদীপের আলো ছাড়িয়ে জনসাধারণের কাছে তারা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে ত্যাগ করে গেছেন তা সাধারণের সামনে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ সিনেমায়। এ সিনেমা দেখে দেশের তরুণ প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হবে। যতদিন চট্টগ্রামে এ সিনেমা প্রদর্শিত হবে বিনামূল্যে আজাদী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দেব।

তিনি বলেন, একুশ আমার অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশের সাথে জড়িয়ে আছে আমার পরিবারের ইতিহাস। একুশের প্রথম কবিতা কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ছাপিয়েছিলেন আমার বাবা।

তিনি বলেন, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটি লাল সবুজ পতাকা দিয়ে গেছেন। আমার মৃত্যুর পর লাল সবুজের পতাকাটি আমার কফিনের ওপর শোভা পাবেএকজীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

বীরকন্যা প্রীতিলতা’ সিনেমার পরিচালক প্রদীপ ঘোষ বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একটা অন্যতম দলিল এই চলচ্চিত্র। এই সিনেমায় একদিকে সে সময়ের সাহসী বিপ্লবীদের তুলে ধরা হয়েছে।

আবার অন্যদিকে কারান্তরীণ বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে বীরকন্যা প্রীতিলতার বারবার সাক্ষাৎ এবং তাঁর প্রতি দুর্বলতার কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রীতিলতাকে নিয়ে করা ভারতীয় সিনেমাগুলোতে অনেক গলদ আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস অনেকেই জানে না।

চট্টগ্রামে যারা সশস্ত্র আন্দোলন করেছে তাদের বিষয়ে বর্তমান প্রজন্ম জানেই না। ভারতীয় লেখকরা তাদের বইয়ে ও সিনেমাগুলোতে প্রীতিলতাকে নিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলোতে অনেক ভুল আছে। আমরা রিসার্চ করে সিনেমাটির কাজ করেছি। প্রীতিলতা চট্টগ্রামের গর্ব।

আমার ধারণা, সিনেমায় প্রীতিলতাকে খুঁজে পাবেন দর্শক। পরিচালকের মতে, এটি একটি রিয়েল প্লেস মুভি। কারণ, ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ক্লাব, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কাট্টলী, ঢাকার আরমানিটোলা, ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারেও চলচ্চিত্রটির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে।

অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শ্যামল পালিত, এইচএম স্টিলের মহাব্যবস্থাপক নিপুর চৌধুরী প্রমুখ।

এদিকে সিনেমা দেখার জন্য সন্ধ্যা ৬ টা থেকেই শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ অনেকেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সবার জন্য ১০০ টাকা টিকিটের দাম নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে অর্ধেক দামে টিকিট সংগ্রহ করছিল।

আজ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১২টা, ৩টা, বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিচালক প্রদীপ ঘোষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিইউএফএলে টানা ৪৯ দিন উৎপাদন বন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬