করোনা মহামারীর পরবর্তী অর্থনীতির চাকা সচল করা এবং বিপর্যস্ত অবস্থা হতে উত্তরণের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উর্ধ্বতন মহল হতে জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে শিল্প বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। শিল্প স্থাপন এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতিতে এর সুফল আসবে। ইতোমধ্যে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার সুফলও আসতে শুরু করছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থ বছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছেন উদ্যোক্তারা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ফলে বিনিয়োগ বাড়ার ‘দৃশ্যমান’ অগ্রগতি ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
একই সঙ্গে বিনিয়োগ নিবন্ধন পরিস্থিতিতেও গতি সঞ্চার হয়েছে চলতি বছরে (এপিল-জুন) তিন মাসে দেশী বিদেশী ১৮৪টি শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড (বিডা)।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৪০ হাজার অধিক লোকের কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে। শিল্প স্থাপন ও দেশের উন্নয়ন সংগ্রামে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম একটি নাম। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি বলে খ্যাত বাণিজ্যিক রাজধানী, শিল্প নগরী, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শিল্পায়নে চট্টগ্রাম অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রামের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ একটি সংগ্রাম ও দীর্ঘ পরিকল্পনার এবং ইতিহাসের অনন্য এক নাম।
দেশের অন্য কোন কোম্পানীর ন্যায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর সাথে তুলনা করলে ভুল করা হবে। এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। চট্টগ্রামে শিল্প, বাণিজ্য, ক্যাপটিভ, সিএনজি এবং আবাসিক খাতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের অঙ্গীকার নিয়ে এ কোম্পানীটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি সহ বিস্তৃর্ণ এলাকা নিয়ে উন্নয়নের আওতায় বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিঃ (বর্তমানে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ)। তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিঃ নামক কোম্পানীর রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম হতে জোগান দেয়া হলেও প্রধান কার্য্যালয় স্থাপিত হয় কুমিল্লার এক অজ পাড়াগাঁয়ে চাঁপাপুর নামক স্থানে। চট্টগ্রামের শিল্প, আবাসিক, বাণিজ্যিক যে কোন সংযোগের অনুমোদন এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কুমিল্লার দিকে থাকিয়ে থাকতে হতো। ফলে চট্টগ্রামের গ্রাহকরা প্রকৃত সেবা হতে বঞ্চিত রয়ে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পুরো ক্ষমতা কুমিল্লা থাকার কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সমাজসহ সকল ক্ষেত্রে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় বঞ্চিত ও প্রবঞ্চনার শিকার হওয়ায় প্রথমত দাবি উঠে চট্টগ্রামে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ব ক্ষমতা প্রদান পূর্বক গ্যাস সংযোগ ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ। যা পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামে প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরের দাবিতে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণ চট্টগ্রামে প্রধান কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এছাড়া গ্যাস স্বল্পতার কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখে কুমিল্লা অঞ্চলে কোন চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দেয়া হয়। বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিঃ এর চট্টগ্রাম বিদ্বেষী হঠকারিতা মূলক মনোভাবের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ্ এবং কোম্পানীতে চাকুরীরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
প্রধান কার্যালয়ের চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য গ্যাস সেক্টরে আলাদা কোম্পানী গঠনের দাবিটি সামনে চলে আসে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এর নেতৃত্বে ব্যবসায়ী সমাজ চট্টগ্রামে আলাদা গ্যাস কোম্পানী গঠনে জোড় তৎপরতা শুরু করে। একই সাথে চট্টগ্রামের জনগণের প্রিয় নেতা চট্টল প্রেমিক জননেতা এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহ সকল দল মত নির্বিশেষে চট্টগ্রামের জন্য আলাদা গ্যাস কোম্পানী গঠনের বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করে যৌথভাবে সরকারের উচ্চ মহলে যোগাযোগ করে তদবির ও আন্দোলন গড়ে তোলে।
সকল প্রকার ষড়যন্ত্র এবং প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে অবশেষে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সরকার বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় কর্ণফুলী গ্যাস সিস্টেমস্ লিঃ নামে আলাদা একটি কোম্পানী গঠন করে। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সময়ক্ষেপণের পর অবশেষে ৮ নভেম্বর ২০০৮ ইং বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেডকে ভাগ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকায় সুষ্ঠ গ্যাস ব্যবস্থাপনার জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ নামে একটি কোম্পানী গঠনের জন্য গেজেট প্রকাশ করা হয়।
আমার জানামতে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী গঠনে এত আন্দোলন বা সংগ্রাম হয়নি। সে ক্ষেত্রে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ নামক প্রতিষ্ঠানটি একটি আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে আলাদা স্থান করে নিয়েছে এবং সে জন্য এর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রয়েছে বলে আমি মনে করি।
গ্যাস শিল্পের বিকাশ এবং বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানীর সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১১ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে জারিকৃত গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীনস্থ পেট্টোবাংলার আওতাধীন কোম্পানীগুলোকে সমন্বয় ও সুষমকরণ পূর্বক বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেডকে পুনঃবিন্যাস করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলার সমূহের জন্য ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ (কেজিডিসিএল) গঠন করা হয়। কোম্পানীটি ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১০ এ কোম্পানী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। জুলাই ২০১০ ইং তারিখে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সূচনা করে এবং প্রকল্প পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান ঘটে এবং চট্টগ্রামবাসীর মনোবসনা পূর্ণ হয়। চট্টগ্রামের জনগণের মনোবেদনা ও কষ্ট লাগব হয়, পুরো চট্টগ্রাম আনন্দে উদ্বোলিত হয়ে উঠে।
চট্টগ্রামের জনগণের আশা আকংখা ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ ইং তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন এবং জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় নবদিগন্তের উন্মোষ ঘটে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ কোম্পানীকে চট্টগ্রামবাসীর জন্য উপহার হিসেবে ঘোষণা করেন।
দেশে গ্যাস উৎপাদন এবং চাহিদার তারতম্য থাকায় ২০০৯ সাল হতে শিল্পে চট্টগ্রামে নতুন সকল ধরনের গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। যার কারণে চট্টগ্রামে শিল্প কারখানা ও উৎপাদনে এক প্রকার স্থবিরতা চলে আসে। শুধুমাত্র চট্টগ্রামে চার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং মেশিনারী নষ্ট হয়ে যায়। অনেক শিল্প মালিক দেওলিয়া হয়ে পরে। চট্টগ্রামের শিল্প ও বিনিয়োগকারীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স সরকারের কাছে বার বার আবেদন নিবেদন করে চট্টগ্রামে গ্যাস সংকটের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোন সূফল আদায় করতে পারেনি।
২০১০ হতে গ্যাস ঘাটতির কারণে শিল্পে গ্যাস সংযোগ সংকুচিত করা হয় পরবর্তীতে একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময়ে অনেক শিল্প উদ্যোক্তা কারখানা স্থাপন করে গ্যাস সংযোগের আবেদন করেও সংযোগ পাননি। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে কারখানা বসিয়ে রেখে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে, অনেক বিনিয়োগকারী দেউলিয়া হয়েছে। অনেকে শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েও আর বিনিয়োগে এগিয়ে আসেননি। দেশের এ সংকটময় অবস্থায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ সেক্টরের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং পেট্রোবাংলার নেতৃত্বে অচল শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জোড় প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। দেশের শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার ও বিবেচনায় ২০১০ হতে সরকার এলএনজি আমদানীর উদ্যোগ নেয়।
অনেকের কাছে এলএনজি বিষয়টি দুর্বোধ্য। তাদের বোঝার ও জানার সুবিধার্থে বলতে হয়, প্রাকৃতিক গ্যাসকে শীতলকরণ (রিফিক্সজারেশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে ১৬০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কমিয়ে তরলে অর্থাৎ এলএনজিতে রূপান্তরিত করা হয়। দেশে যে বিশেষায়িত জাহাজটি স্থাপন করা হয়েছে তা ব্যবহৃত হচ্ছে এফ এস আর ইউ হিসেবে অর্থাৎ ফ্লোটিং ষ্টোরেজ এ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট। এখান হতে সাধারণ তাপমাত্রায় প্রাকৃতিক গ্যাস হিসেবে পূর্ব হতে স্থাপিত গ্যাস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের গ্যাস সেক্টরে মাষ্টার প্ল্যান ২০১৭ অনুযায়ী দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (এলএনজির হিসাবে যা দাড়ায় ৭ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন টন)।
২০১৮ সালে গ্যাসের মোট চাহিদার ১৭ ভাগ এলএনজি আমদানীর মাধ্যমে পূরণ করা হবে যা ২০২৩ সালে দাড়াবে ৪০ ভাগ। ২০২৮ সালে ৫০ ভাগ এবং ২০৪১ সালে ৭০ ভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালে এলএনজি আমদানীর পরিমাণ বছরে ৩০ মিলিয়ন হবে। জ্বালানী বিষয়ক পরামর্শ ও গবেষণা ব্যবসায়ী কোম্পানী উড ম্যাকোঞ্জ ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়েছে যে, প্রতিবছর বাংলাদেশের এলএনজি চাহিদার পরিমাণ হব্ে ২০২০ সালে ৪ মিলিয়ন টন, ২০২৫ সালে ৮ মিলিয়ন টন এবং ২০৩৫ সালে ১১ মিলিয়ন টন।
২০১৬ সালে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত ও তাইওয়ান ছিল পৃথিবীর সর্ব্বোচ্চ এলএনজি আমদানীকারক দেশ। এছাড়াও পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি করে।
সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে উত্তীর্ণ হতে চায়, তবে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ হতেই হবে। এ প্রবৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দেশে দ্রুত শিল্পায়ন এবং জ্বালানী চাহিদা বৃদ্ধি। প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি কয়লার তুলনায় অনেক বেশি পরিবেশ বান্ধব।
সুতরাং আমাদেরকে শিল্পের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতেই হবে। ২০৫০ এর মধ্যেই নবায়নযোগ্য জ্বালানী হবে বিশ্বময় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি।
দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠায় সরকারের আগ্রহ এবং ২০৪১ সালকে সামনে রেখে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই চট্টগ্রামের শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ফলে দেশের শিল্পায়নে এক নব পর্যায়ে সূচনা হয়েছে। শিল্পে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নতুনভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা দেশের উন্নয়ন ও সফলতার জন্য শুভ সংবাদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সরকার প্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের শিল্পায়নকে প্রাধান্য দিয়ে দেশে এলএনজি আমদানি করা হলেও গ্যাস সেক্টরের প্রতি উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। উদ্যোক্তাদেরকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ হতে বার বার বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈঠকে বসে।
সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয় এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে চট্টগ্রামের শিল্প উদ্যোক্তাদের সাথে বার বার মতবিনিময় করে গ্যাস সংযোগ নিতে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু গ্যাস সেক্টরের সাথে গ্রাহকদের যে আস্থাহীনতা তাঁর পরিবেশ ফিরে আনতে না পারায় শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে তেমন কোন আশানুরূপ সাড়া মিলেনি। পরবর্তীতে মাননীয় জ্বালানী উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পরিষদ এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ কর্তৃপক্ষ যদি উদ্যোক্তাদেরকে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করে তবে উদ্যোক্তাগণ নতুন করে শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগ করবেন। সভায় মাননীয় জ্বালানী উপদেষ্টা উদ্যোক্তাদেরকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে, তাদেরকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ করা হবে এবং গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়া আরো সহজতর করা হবে। সে আলোকে গ্রাহক ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর মধ্যে সৃষ্ট আস্থাহীনতার যে পরিবেশ তাত্থেকে উত্তোরনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ হতে কিছু সুপারিশমালা প্রদান করা হয়। এসব সুপারিশ সমূহের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে মাননীয় উপদেষ্টা চেম্বার প্রদত্ত সুপারিশমালার সাথে সহমত পোষণ করেন এবং পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
সরকারের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি ও সহযোগিতার বাণীর ফাঁদে পা দিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা আবারো নব উদ্যোমে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং জামানতের টাকা প্রদান করেন। ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সংযোগের অপেক্ষায় থাকা শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। অনেক শিল্প মালিক কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানীর উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্যাস সংকটের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা। গ্যাস সংকটের কারণে তাঁদের মহাপরীক্ষা দিতে হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারীর কারণে সারা বিশ্ব স্তব্ধ ও অচল হয়ে পড়ে। যার ফলে শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়া এবং গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। যে সকল উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের জন্য জায়গা ক্রয় করে শিল্প স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা নিয়েছে তারাও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ে। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, জায়গা ক্রয়, অর্থের সংস্থান, অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণ এবং বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন গ্রহণ করতে ৪/৫ বছর সময়ের প্রয়োজন। এখন যারা সকল প্রকার অনুমোদন গ্রহণ করেছে তারা যদি শিল্প স্থাপন নির্মাণ কাজ শুরু করে শেষ করতে ২/৩ বছর সময়ের প্রয়োজন হবে। এছাড়াও শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারের যে সকল বেজা, বেপজা বা বিসিকের জন্য জায়গা অনুমোদন হয়েছে সে সকল স্থান শিল্প স্থাপনের জন্য প্রস্তুত হতে কমপক্ষে আরো ৪/৫ বছর সময়ের প্রয়োজন হবে। দেশের সব চাইতে বড় শিল্প এলাকা মিরেরসরাইতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সে কারণে ইতিমধ্যে শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন চট্টগ্রাম বাণিজ্য নগরী, শিল্পনগরী এবং বন্দরনগরী হওয়ার সুবাধে সর্বত্রই শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশীয় শিল্প ও অর্থনীতিকে বিকশিত ও চলমান রাখার স্বার্থে চট্টগ্রামে এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রাখার স্বার্থে গ্যাস সংযোগ সহ সকল প্রকার সুবিধা প্রদান জরুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে আরো লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নতুন আবেদনকৃত গ্রাহকদেরকে ‘ক্যাপটিভ খাতে’ গ্যস সংযোগ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অনুমোদনের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিভিন্ন রকম নিয়মের মারপ্যাচে প্রক্রিয়া জটিল করা হচ্ছে। যদিও এবিষয়ে কোন লিখিত নির্দেশনা নেই। এবিষয়ে যুক্তি হলো দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাস্তব অবস্থা কি? তা জানা প্রয়োজন। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখনো বিদ্যুৎতের ঘনঘন আসা যাওয়া, লোড শেডিং, সারাদিন বিদ্যুৎ না থাকা এগুলোর সমস্যা এখনো প্রবল। এছাড়া ভোল্টেজ আপ-ডাউন সহ কোয়ালিটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছেনা বিদ্যুৎ বিভাগ। যার কারণে শিল্প কারখানায় স্থাপিত আধুনিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় নষ্ট হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। এসব কারণে শিল্পদ্যোক্তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গ্যাস জেনারেটর আমদানি করে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করছে। কারণ তাদের বিনিয়োগ বেশি হলেও নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার কারণে কারখানায় স্থাপিত মেশিনারীজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া হতে রক্ষা পাচ্ছে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল থাকছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং কর্তৃপক্ষকে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। দেশের শিল্পয়ানের প্রয়োজনে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় ক্যাপটিভ খাতে গ্যাস সংযোগ প্রদানের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ প্রদান এবং দ্রুততম সময়ে সংযোগ প্রক্রিয়া সমাধান করা। কিন্তু বর্তমানে কেজিডিসিএল জনবল সংকটে ভুগছে জনবল সংকটের কারণে প্রক্রিয়াগত জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং মান সম্মত সেবা গ্রাহক পাচ্ছেন না। ফলে শিল্প গ্রাহক পর্যায়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সংযোগ প্রদান এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য কেজিডিসিএল এর প্রতি গ্রাহকদের প্রত্যাশা অনেক। সে কারণে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে অপ্রত্যাশিত ও অযৌক্তিক কিছু সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সময় কেজিডিসিএল এর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কেজিডিসিএল এর কিছু সিদ্ধান্ত যেমন নির্ধারিত স্থান ব্যাতিত শিল্প গ্যাস সংযোগের বিষয় এবং ক্যাপটিভ শ্রেণীতে গ্যাস সংযোগে নিরুৎসাহিত এবং প্রক্রিয়াগত জঠিলতায় শিল্পোদ্যোক্তার মাঝে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হলেও বর্তমানে কেজিডিসিএল এর সেবার মান এবং কাজের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। যদিওবা জনবলের সংকটের কারণে অনেক সময় সঠিকভাবে সেবা দেয়া সম্ভব হয়না। তবুও এবিষয়ে কেজিডিসিএল এর ব্যবস্থাপনা সজাগ দৃষ্টি রাখেন বলে মনে হয়। এছাড়াও ২৫ হাজার আবাসিক সংযোগ নিয়ে জঠিলতা সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান জরুরী।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জনসাধারণের মাঝে শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিক, সিএনজি, চা বাগান এবং বিদ্যুৎ সেক্টর সহ সকল প্রকার গ্রাহকদেরকে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনে স্থানীয় রাজনীতিবিদ্, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, প্রেস মিডিয়া, ইলেকট্রিক মিডিয়া, গ্যাস সেক্টরে কর্মরত চট্টগ্রামের কর্মকতা, কর্মচারীবৃন্দ, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণীর মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অংশগ্রহণ ছিল। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ পেট্রোবাংলার অন্যান্য কোম্পানীর ন্যায় গঠিত হয়নি। এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয়েছে, দাবি দেওয়া হয়েছে, দীর্ঘ ২০ বছরের অধিক সময় আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি আদায় করে নেয়া প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের কালো রাত্রিতে থমকে যায়। ইতিহাসের চাকা হয় গতিরুদ্ধ। হত্যা, ষড়যন্ত্র, ক্যু, পাল্টা ক্যু সকল কিছুর মাঝেও দেশের উন্নয়ন থেমে থাকেনি। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহারে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে আবিষকৃত হয় গ্যাস ক্ষেত্র, তেল ক্ষেত্র সহ অনেক খনিজ সম্পদ।
চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই হলো দেশের উন্নয়ন। সে উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরীতে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কেজিডিসিএল এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখার জন্য চট্টগ্রামের শিল্প, বাণিজ্য, ক্যাপটিভ, সিএনজি সহ সকল প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্নভাবে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা না করে গ্যাস সংযোগ প্রদান জরুরি। বিগত প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় ধরে গ্যাস সংযোগের সকল প্রকার অনুমোদন এক প্রকার বন্ধ বললেই চলে। যা চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে এবং সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল।
যদিওবা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদসহ সকল জনসাধারণ যে উদ্দেশ্য বা আশা নিয়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ গঠন করেছে তা কতটুকু সফলতা পেয়েছে- এ প্রশ্ন থেকে যায়। তবুও আমরা আশাবাদী। আশায় বুক বেধে চলাটাই চট্টগ্রামবাসীর মজ্জাগত স্বভাব। আমরা অপেক্ষায় আছি। অমানিশার অন্ধকার একদিন কেটে যাবে, রক্তিম সূর্যের উদয় হবে। চট্টগ্রামের মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেখতে পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক-শিল্পশৈলী