চট্টগ্রামে আবাসন শিল্প : সমস্যা ও সম্ভাবনা

রেজাউল করিম | মঙ্গলবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে আবাসন অন্যতম। বাংলাদেশের অনেকে আবাসন সুবিধা পাচ্ছে না। তবে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নও করে যাচ্ছেন। তবে সরকারের একার পক্ষে আবাসনের ব্যবস্থা সম্ভব নয়। নগরে নাগরিকদের জন্য উন্নতমানের আবাসন সুবিধা দিতে সরকারের পাশাপাশি রিহ্যাব অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

বাংলাদেশে আবাসন ব্যবসা যার হাত ধরে :

বাংলাদেশে আবাসন ব্যবসা যার হাত ধরে, তিনি হলেন ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জহুরুল ইসলাম। তিনি ইস্টার্ন হাউজিং নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তিনিই প্রথম বেসরকারি খাতের আবাসন ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। স্বাধীনতার পর দেশের আবাসন খাত এগিয়েছে মূলত তার দেখানো পথেই। আধুনিক নগরায়নের ইতিহাস জহুরুল ইসলামকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। আর্থিক টানাপড়েন তাকে সে সুযোগ দেয়নি। এ কারণে দেশভাগের অব্যবহিত পরই ১৯৪৮ সালে চাকরিতে ঢোকেন তিনি। পেশা জীবনের শুরু সিঅ্যান্ডবির ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। তৎকালীন ৮০ টাকা মাসিক বেতনে। তবে চাকরির চেয়ে ব্যবসার প্রতিই তার আকর্ষণ বেশি। এ কারণে পদোন্নতির প্রলোভন উপেক্ষা করে তিন বছরের মাথায় চাকরি ছাড়েন তিনি। যোগ দেন পিতার ঠিকাদারি ব্যবসায়।

চট্টগ্রামে আবাসন ব্যবসার গোড়াপত্তন : বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রামে বেসরকারি খাতে আবাসন ব্যবসা শুরু হয় ১৯৮৪৮৫ সালের দিকে। প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো আইডিয়াল হোম ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। চার উদ্যোক্তার এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮৪৮৫ সালে পূর্ব নাসিরাবাদে ‘আপন নিবাস’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। প্রায় ১০ বছর পর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই খাতে যুক্ত হয় শাইনপুকুর হোল্ডিংস। এরপর ১৯৯৯ সালে আসে ইকুইটি প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট। এই শতকের শুরুতে একের পর এক প্রতিষ্ঠান যুক্ত হতে থাকে। এর মধ্যে রয়েছেস্যানমার প্রপার্টিজ, সিপিডিএল, ফিনলে প্রপার্টিজ, এএনজেড প্রপার্টিজ, এপিক প্রপার্টি, র‌্যাংকন এফসি প্রপার্টিজ, জুমাইরা হোল্ডিংস, পিটুপি, উইকন প্রপার্টিজ, শেঠ প্রপার্টিজ, সিকিউর প্রপার্টিজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে চট্টগ্রামে আবাসন ব্যবসার প্রসার ঘটে।

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক মন্দাভাব বাংলাদেশেও কিছুটা আচঁড়ে পড়ে। সরকারের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে সেভাবে মন্দার ঢেউ লাগেনি। আবাসন খাতে করোনার আঁচড় পড়লেও চট্টগ্রামের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা সেই সংকট খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠেছে। এখন আশার আলো দেখছেন ও দেখাচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যেই ফ্ল্যাট বা প্লট কিনতে খোঁজ খবর নিচ্ছেন নানা শ্রেণিপেশার ক্রেতারা। তবে নির্মাণসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতিতে কিছুটার ভাঁজ ফেলেছে আবসান খাতের ব্যবসায়ীদের।

মেগা প্রকল্প ও আবাসন খাত : কিন্তু চট্টগ্রামে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো প্রায় শেষের পথে। এসব প্রকল্প আবাসন খাতে অন্তত চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়বে বিনিয়োগের পরিমাণএমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ শেষ। লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। বেটার্মিনাল, রিং রোড ও মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের ইকোনমিক জোনের কাজ চলমান। অক্টোবরে ঢাকাকক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। কক্সবাজারে আইকন রেলস্টেশন, মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভাসমান এলএমজি টার্মিনাল নির্মাণসহ অনেক প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চাপ বাড়বে।

সরকারের এসব প্রকল্পের কারণে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো নগরের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন উপজেলাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। গড়ে উঠছে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। ফলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আবাসন খাতে বিনিয়োগের হার বাড়বে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা।

আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, করোনায় ব্যবসাবাণিজ্য পুরোটাই স্থবির ছিল। তবে আবাসন খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহস জোগাচ্ছে সরকারের নানা উদ্যোগ। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় নতুন করে আশার আলো দেখছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা। আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে আবার বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ারও চিন্তাভাবনা করছে সরকার।

রিহ্যাব, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সদস্যভুক্ত ৮৩টি কোম্পানির বর্তমানে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রায় সাড়ে ৩শ’টি প্রকল্পের কাজ চলমান। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি হবে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ফ্ল্যাট। চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তর করা হবে ক্রেতাদের।

আবাসন ব্যবসায়ীরা ক্রেতাকে টার্গেট করে তাদের নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রামের প্রতি মানুষের মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। পাশাপাশি সরকারের মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান এ অঞ্চলে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এর আশেপাশেই মানুষ বসবাস করতে চাইবে। তাতে নতুন চাহিদা তৈরি হয়। সে চাহিদা পূরণেই কাজ করে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা নিজস্ব কৌশলে বাজার সম্প্রসারণ করে চলেছে।

রিহ্যাব চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী জানান, আবাসন শিল্পে আরো চাঙাভাব আনতে হলে সরকারকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি কমাতে হবে। ন্যূনতম কর দিয়ে এই খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরো জানান, ফ্ল্যাট নিবন্ধনে নিবন্ধন ফি, মূল্য সংযোজন কর, স্ট্যাম্প ফি ও গেইন ফি আরো কমাতে হবে। এখন বলতে গেলে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন অনেক কমে গেছে। এক্ষেত্রে পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে এগিয়ে এলে আবাসন কোম্পানি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের দাম অনেক কম হবে। এখন তো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতেই পারেন না। নির্মাণ সামগ্রীর ঊর্ধ্বগতি, অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি’র কারণে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। আমরা আগে থেকে বলে এসেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে কিছু সুবিধা দিলে মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট কোনো ব্যাপার না। আমাদের বড় বাজার মধ্যবিত্তরা। তাদের আবাসন সংকট কিছুটা লাঘব হলে আমরাও স্বস্তি পাব। আমাদেরও তো সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের চাহিদা থাকলেও গ্রাহকরা তা কিনতে পারছে না। সেজন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। এই তহবিল থেকে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে লোন দেওয়া হলে অনেক গ্রাহকই ফ্ল্যাট কেনার বেলায় একটি সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারবেন। আমরা চাই সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে। কেননা, সরকারের একার পক্ষে সবার জন্য আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমরা এতে অংশীদার হতে চাই। মেগা প্রকল্পের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে সরকারকেই মূলত অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

আবাসনের জন্য কৃষিজমি ভরাট হয়ে যাওয়া কিংবা দখল হয়ে যাওয়া এখনই ঠেকাতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার সঙ্গে আমরাও একমত। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে ভবনের ঊর্ধমুখী সমপ্রসারণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আবাসনের জন্য কৃষিজমি ভরাট করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

নগরীতে জমি তো আর বাড়ছে না। যা আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ফলে প্লট কিনে বাড়ি নির্মাণ করার প্রবণতা থেকে মানুষ অনেকটা সরে এসেছে। তাই বহুতল ভবনের কনসেপ্ট অনুযায়ী মানুষ ফ্ল্যাটে আসছে।

অপার সম্ভাবনার নগরী চট্টগ্রাম। বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দেয়া হলে পটিয়াআনোয়ারা হবে উপশহর। আবাসন ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্টের মাধ্যমে আনোয়ারা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। শহর হবে বিস্তৃত। মূল শহরের উপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। এই শিল্পের সাথে জড়িতরা নতুন নতুন কনসেপ্ট নিয়ে আবাসন ব্যবসার গতিকে আরো ত্বরান্বিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

লেখক : সহসম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবাসন খাতে আস্থা ও নির্ভরতায় সিপিডিএল
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় নাশকতার মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার