বলা হয়ে থাকে অগ্নিপ্রসবা বীর চট্টলা। শুধু বীর প্রসবা নয় এ-চট্টলা, এর পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ-সংগীত শিল্পী আরো কতশত মণি-ঋষিও জন্ম নিয়েছেন এখানে। পাহাড়-সাগর-নদীবেষ্টিত এই শহরের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে। বাংলাদেশের এক অনন্য প্রকৃতির লীলাভূমি এই বীর চট্টগ্রাম। কর্ণফুলীর তীরের এই শহরে বসে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতি পেয়েছেন। তাদের নামধাম নিতে গেলে রচনার পরিধি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তাই শিরোনামে উল্লিখিত দ’ুজন কথাসাহিত্যিককে নিয়েই এই রচনার স্বল্প আলোচনা।
সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পূর্ণ করতে অদ্যাবধি দু’জনেই সমানে কলম পিষছেন। তবে বিশ্বজিৎ চৌধুরী কলম না পিষলেও তিনি কম্পিউটারের কী বোর্ডে আঙুল রাখেন। আর অপরদিকে হরিশংকর জলদাস জেলপেন দিয়ে লেখেন। তিনি লেখেন দাগটানা বাইন্ডিং খাতায়। ছোট ছোট জ্বলজ্বলে তারার মতো লেখায় ভরিয়ে তোলেন খাতা। প্রতিটি উপন্যাসের মূল পাণ্ডুলিপি ফাইল বন্দি করে সযত্নে রেখে দেন।
হরিশংকর জলদাস জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫৩ সালের ৪ মে। বিশ্বজিৎ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৬০ সালের ১ আগস্ট। আবার এও একটি বিষয় যে, দ’ুজনেরই গ্রাম চট্টগ্রামের পতেঙ্গা। সমুদ্রের কাছাকাছি গ্রামে জন্ম নিয়ে দুজন হৃদয়ে সমুদ্রকে ধারণ করেছেন। উত্তর দক্ষিণ পতেঙ্গা যাই বলি না কেন, একই গ্রামের দু’জনেই চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে রেখে চলেছেন তাদের স্বীয় প্রতিভার সাক্ষর। দু’জনেই পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। হরিশংকর জলদাস ২০১২ সালে আর বিশ্বজিৎ চৌধুরী বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ২০২১ সালে। হরিশংকর জলদাস ২০১৯ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার-ই লাভ করেছেন। বিশ্বজিৎ চৌধুরীও এগিয়ে চলেছেন ক্রমশ একই গন্তব্যে। দু’জনে সমানতালে পাঠকের চিত্ত হরণ করতে পারদর্শী।
দুই
হরিশংকর জলদাস লেখালেখি করতে এসেছিলেন প্রচণ্ড মনঃপীড়া নিয়ে। কৈবর্তসমাজের সংগ্রামী জীবন তাঁর। প্রতি পদে পদে পেয়েছেন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। সে-সবের অর্ন্তদাহই তাঁকে লিখতে বাধ্য করেছে। এ-যাবৎ তার গ্রন্থসংখ্যা সত্তরের কাছাকাছি। তিনি লিখেছেন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-আত্মজীবনী। এরই মধ্যে আত্মজীবনী ‘নোনাজলে ডুবসাঁতার’(২০১৮) পাঠক তাঁর সম্পর্কে বিশদ জেনেছেন।
তিনি মূলত প্রান্তিক সমাজের রূপকার। সমাজের নিচুতলার মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা, ক্লান্তি-অবসাদ ঘাম-পুঁজ তার লেখায় অনবদ্য রূপ লাভ করেছে। তিনি শহুরে ড্রয়িংরুমের কাহিনির চাইতে নিগৃহিত মানুষের কষ্টের ছবি ফুটিয়ে তুলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। সমাজে যারা অপাংক্তেয় তাদের নিয়ে তিনি কাহিনি নির্মাণ করেন। তিনি যে সমাজ ব্যবস্থা কৈশোরে-তারুণ্যে দেখে এসেছেন তা নিতান্তই শোষিত সমাজের চিত্র। সে সমাজের বুক ভাঙা আর্তনাদ চেপে রাখা মানুষের ব্যর্থ স্বপ্নের বেদনার আখ্যান রচনা করেন তিনি। তাঁর গল্পে আখ্যানে অপমানিত হওয়া মানুষের সাক্ষাৎ মেলে।
এ-বিষয়টি অনেকেই হয়তো জানেন না তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে মাছদের নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসটির নাম সুখলতার ঘর নেই। প্রথমা প্রকাশন গ্রন্থটি ২০১৯ সালে প্রকাশ করে। এখানে তিনি মাছদের একটি সমাজচিত্র এঁকেছেন। সে-সমাজে মানুষের মতো মাছেদের আধিপত্য নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়। ক্ষমতা নিয়ে মারপিট হয়। সুন্দরীদের দখল করতে চায় কেউ বাহুবলে। সেখানেও জোর করে ধর্ষণ করা হয়। অদ্ভুত কুশলতায় সাগরের নিচের একটি আখ্যান রচনা করেছেন তিনি।
তিনি কৈবর্ত জীবনের সুখদুঃখ, ও অমানবিক পরিশ্রমের বিষয়টুকু তুলে এনেছেন। প্রেম ভালোবাসা স্বপ্ন দেখা ও ভাঙাগড়ার সঙ্গে কৈবর্তদের সংগ্রামী জীবনের অতুলনীয় কাব্য হয়ে উঠেছে তাঁর এ-উপন্যাসগুলো। এগুলো হলো ‘জলপুত্র’(২০০৮), ‘দহনকাল’ (২০০৯), ‘প্রস্থানের আগে’(২০১৯)। ‘জলপুত্র’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এ-উপন্যাসের হাত ধরেই তিনি সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জলপুত্র গঙ্গার সংগ্রাম অপরদিকে কৈবর্তনারী ভুবনেশ্বরীর সংগ্রাম মিলে মিশে একাকার হয়েছে। স্বামীহারা ভুবনেশ্বরী পরবর্তীতে পুত্র গঙ্গাহারা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্রগামী জেলেদের বারমাস্যা যেমন উঠে এসেছে তেমনি এ-উপন্যাসে জেলেদের পৌষপার্বণের বাঙালি মানমানসিকতার পরিচয় ফুটে ওঠে। জলপুত্র অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তবে এ-উপন্যাসটিকে অনেকেই চলচ্চিত্রে রূপদান করতে চেয়েছেন। হয়তো কোনোদিন তা সত্যিই দেখা যাবে। মহাভারতে কাহিনি নিয়ে এ-পর্যন্ত এ-পারে যারা উপন্যাস লিখেছেন তাদের মধ্যে হরিশংকর জলদাস-ই অন্যতম।
চট্টগ্রামের বিলুপ্ত সাহেবপাড়াকে তিনি উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এই পতিতাপল্লির নারীদের ক্লেদাক্ত জীবনের ছবি তিনি মর্ম দিয়ে এঁকেছেন। উপন্যাসটির নাম ‘কসবি’(২০১১) তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলো হলো-
রামগোলাম (২০১২), হৃদয়নদী (২০১৩), মোহনা (২০১৩), আমি মৃণালিনী নই, (২০১৪), প্রতিদ্বন্দ্বী, এখন তুমি কেমন আছ (২০১৫), সেই আমি নই আমি, (২০১৬), একলব্য, (২০১৬), রঙ্গশালা (২০১৭), ইরাবতী (২০১৭), অর্ক, (২০১৭), মৎস্যগন্ধা(২০২০), দুর্যোধন (২০২১), কুন্তির বস্ত্রহরণ(২০২১), বিনোদপুরের বিনোদিনী (২০২১)।
হরিশংকর জলদাস এই সময়ের কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে এই সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যক হিসেবে তিনি অন্যতম। রাশভারী, গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হরিশংকর জলদাস তাঁর লেখনীতে ও বিষয় নির্বাচনে খুঁতখুঁতে। তিনি বেছে বেছে জীবনের গভীর থেকে তুলে আনেন মানুষের ক্লেদাক্ত জলরঙের ছবি।
তিনি প্রবন্ধ দিয়ে শুরু করেছিলেন। তারপর গল্প ও উপন্যাসে হাতেখড়ি। সংসারে অভাবের কারণে কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে মাছ ধরেছেন হরিশংকর। স্বল্প শিক্ষিত বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পড়াশোনা করার আগ্রহটি জাগিয়ে রেখেছিলেন। মূলত তিনি বাবা আর ঠাকুমা পরাণেশ্বরীদেবীর অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকাতে পেরেছিলেন। যুবক বয়সেও তিনি সমুদ্রের নোনাজলে ডুবসাঁতার কেটেছেন। টেনেছেন নৌকার দাঁড়। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার সুযোগে বাংলা সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গের সঙ্গে ভাব করেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু তাঁর সমস্ত ভাবনাজুড়ে ছিল নদী-জল-মাটি আর সমুদ্রকূলের ঐ কৈবর্তসমাজ। তাই তাঁর লেখনীতে কৈবর্ত নামক ব্রাত্য প্রান্তজনদের জীবনচর্যা, তাদের বিকাশ বিদ্রোহ, তাদের হাহাকার প্রাপ্তির ইতিহাস লিখে যাচ্ছেন তিনি। জেলেদের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিণতি নিয়ে একটি অভিসন্দর্ভও রচনা করেন তিনি। ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্তজনজীবন’। দলিত প্রান্তজনের জীবন হরিশংকরের কথাসাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ।
বিষয়ভেদে তাঁর উপন্যাসের ভাষা ও চারিত্র্য পাল্টে যায়। তিনি তাঁর উপন্যাসে শুধু কাহিনি লেখেন না, সমাজকেও লেখেন। শুধুমাত্র জেলেজীবন নয়, তাঁর গল্পের চরিত্ররা নানা পেশা থেকে উঠে এসেছে। কখনো তারা সমাজের নিচু স্তরের জেলে, চাষী, শিক্ষক, গৃহিনী, দোকানদার, শিক্ষিতজন, কিংবা সমাজের মান্যগণ্য কেউ। তাদের মনের সংগুপ্ত কিংবা তাদের প্রাত্যহিক আচার-আচরণের নিটোল বর্ণনা তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। অনেকটা যেন হরিশংকর আমাদের আটপৌড়ে জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ জলদাসীর গল্প(২০১০)। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ছোটগল্পগ্রন্থ হলো লুচ্চা(২০১২), হরকিশোরবাবু, (২০১৪), কোনো এক চন্দ্রাবতী, (২০১৫),মাকাল লতা(২০১৫), চিত্তরঞ্জন অথবা যযাতির বৃত্তান্ত, (২০১৬), ছোট ছোট গল্প (২০১৮), ক্ষরণ(২০১৮),সেরা দশ(২০১৮),কুন্তীর বস্ত্রহরণ(২০১৮), ছোট ছোট গল্প (২০১৯), অনার্য অর্জুন (২০১৯), গল্পের গল্প (২০২০),আছে তো দেহখানি(২০২০), মনোজবাবুদের বাড়ি(২০২০), আহব ইদানিং(২০২০), জলধরের কীর্তি (২০২০)
এ-পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় সত্তরটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ২০২৩ বইমেলাতেও দুটি ভিন্নধর্মী উপন্যাস প্রকাশের তালিকায় রয়েছে। একটি ষোলো বাই সতেরো লাইভলেইন অন্যটি মহাভারতের কর্ণকে নিয়ে কর্ণ।
তিন
বিশ্বজিৎ চৌধুরী একজন গুণি লেখক। তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তাঁর উপন্যাসগুলো হলো নার্গিস (২০১৪), গোপন একটি নাম (২০২১), ফুটো (২০১৮), হে চন্দনা পাখি(২০১৬), বাসন্তী, তোমার পুরুষ কোথায়? (২০১৫), দূর-সম্পর্ক (২০১৭), তুমি কি ভালোবেসেছিলে?, খুন ও আনন্দ কুসুম(২০২২)।
‘নার্গিস’ উপন্যাস বিশ্বজিতের অনবদ্য সৃষ্টি। ‘জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব,- সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো, আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ-দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না। তোমার অভিযাত্রা শুভ হোক।’
বলতে দ্বিধা নেই, ইতিহাসের নার্গিসকে আর তার অফুরন্ত অনুভবকে বিশ্বজিৎ চৌধুরী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। নার্গিস, আজিজুল হাকিম, হাশেম মাস্টার, আলী আকবর খান এমন কি নজরুলের চরিত্রটি অংকনের মধ্যেও লেখকের যত্নের ছাপ লক্ষ করা যায়। পাঠকের অনুভূতিতে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নার্গিস বেঁচে থাকবে- এই প্রত্যাশা অনায়াসে করা যায়।
‘ফুটো’ উপন্যাসে উঠে এসেছে আদি চট্টগ্রামের ইতিকথা, এর পুরনো ও সমকালীন জীবনধারা, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা আর নব্বইয়ের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন। এসব কিছু মিলেমিশে উপন্যাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিরেট সময় ও সমাজবাস্তবতা নয়, উপন্যাসের মূল উপজীব্য প্রেম। এই প্রেমই গভীর অন্ধকারে আলো ফেলে তুলে আনে মানুষের মনস্তত্ত্ব। ফুটোর মনস্তত্ত্ব পাঠককে ভাবাবে, আর পাঠশেষে অনভূতি শূন্য করে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে এক নতুন উপলব্ধির মুখোমুখি।
ছাত্র অবস্থায় গল্প পড়ার নেশায় ভালো গল্প খোঁজ করতাম। কারণ নিজেও তখন বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প লিখতে শুরু করেছি। সেই সময়কালের চট্টগ্রাম শহরে যার গল্প আবিষ্কার করি পাঠ্যতালিকায়, তিনি হলেন প্রিয় অগ্রজ বিশ্বজিৎ চৌধুরী। প্রথমেই হাতে পেয়েছি তাঁর কবিতা, তারপর কিশোর গল্প, ছোটগল্প, এরপর উপন্যাস। সব শাখাতেই তিনি পারদর্শী। তিনি কুশলী শিল্পী- এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সেই সময়ের পঠিত একটি গল্প এখনো মনে দাগ কেটে আছে- নূর আলী লেডিস টেইলার্স।’ নূর আলীর একটা গল্প আছে… শুরুটা এমনই করেছিলেন গল্পকার। স্মৃতিতে নূর আলীর জীবনের গুঢ় জমাট বেদনার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরেছিল। প্রায় তিন দশক পর যখন গল্পটি আবার পাঠ করে কিছু লিখতে বসলাম তখনও আশ্চর্য হয়ে একটা বিষয় অনুভব করলাম ত্রিশ বছর আগের সেই গল্পটি ঠিক একইভাবে আকৃষ্ট করেছে। গল্পকারকে সাধুবাদ দিতেই হয়, একটি গল্পকে কোন কৌশলে রচনা করলে তার স্বাদ পাঠকের মনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অবিকৃত থাকে তার কলাকৈবল্যবাদ সম্পর্কে তিনি জেনে নিয়েছিলেন।
নূর আলী মাস্টার ক্লাস এইট পাস। সন্দীপবাসী নূর আলী যখন গ্রামে সেলাই মেশিন নিয়ে জাঁকজমকভাবে বসেছিলেন তখন তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের দুদিন আগেই কনে তার বড়ভাই দুসন্তানের জনকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ তাদের ধরে এনে বিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটি হাসতে হাসতে সতীনের ঘরে প্রবেশ করেছিল দেখে নূর আলীর আর গ্রামে থাকতে ইচ্ছে হয়নি। এক ধরনের অভিমানবশতই সে গ্রাম ছেড়েছিল। গ্রামে তার পিছুটান বলতে মায়ের অশ্রুবিসর্জন বিষয়টি ছিল, নচেৎ অন্যকিছু নয়।
এরপর নূর আলী শহরে চলে আসে। বন্দর এলাকায় তার সেলাই মেশিন নিয়ে বসে। দীর্ঘদিনের কাজে সে উন্নতি করে। আস্তে আস্তে সে তার দোকানের নাম পাল্টে নূর আলী লেডিস টেইলার্স রাখে। মেয়েদের কাঁচুলি সেলাই এবং তার পরিমাপ যতই নূর আলীকে উত্তেজিত করুক নূর আলী তার মান সম্মান কোনো বিসর্জন হতে দেয়নি। কিন্তু অশ্রুরাণী নামের একটি অনাথ মেয়ে কিভাবে যেন তার রান্নার দায়িত্ব পেয়ে গেল। কিছুদিন পর মেয়েটির এক মাসতুতো ভাই এসে নূর আলীর জীবনটাই পাল্টে দেবার ব্যবস্থা করল। ষাটোর্দ্ধ নূর আলীর জীবনে আবার দোলা লাগে। কিন্তু এখানে ভাগ্য নূর আলীর সঙ্গে প্রতারণা করে। বিয়ের দুদিন আগে নূর আলী শহরে কেনাকাটা করতে গেলে রাত করে ফিরে আসে। ঘরের সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে সে পেছন দিয়ে এসে ফুটো দিয়ে যে দৃশ্য দেখতে পায় তাতে নিজের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
অশ্রুরাণী আর তার মাসতুতো ভাই নেপাল শারীরিক ক্রিয়ায় লিপ্ত। নূর আলী তাদেরকে বিয়ে দিয়ে লোকের কাছে বাহবা কুড়ায়। তার দীর্ঘদিনের শহরের সবকিছু ছেড়ে নূর আলী গ্রামের পথে পা বাড়ায়। নূর আলীর মহৎ হয়ে উঠার পেছনের গল্প পাঠকমাত্রই জানতে পায়, আর কেউ নয়।
এ গল্পে নর-নারীর সম্পর্ক জটিল। নূর আলীর সম্পর্কবিবর্জিত জীবনে গ্রাম আর শহরের দুটি নারীর গোপন সম্পর্কের কাছে নূর আলীর জীবন বিপন্ন। এর কারণেই নূর আলীর জীবনে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে নূর আলীর মহত্ব প্রকাশ পেয়েছে। নূর আলীর জীবনে যে দুটি কনে এসেছে তারা পূর্ব থেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। যার দরুণ নূর আলীর আর সংসার করা হয়নি।
তাঁর ছোটগল্প গ্রন্থ হলো-বিবাহবার্ষিকী ও অন্যান্য গল্প, সম্ভ্রমহানির আগে ও পরে, স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প, পাথরের মূর্তির মতো, নির্বাচিত গল্প, সেরা দশ গল্প, দুধারি তলোয়ার, শাহজাদির শয্যা(২০২১)
কিশোর গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, লিন্ডাজনসনের রাজহাঁস, পাখির জন্য খোলা আকাশ ও কান্না হাসির মুক্তা হীরা।
চার
চট্টগ্রামের সাহিত্যাকাশে অনেকেই সাহিত্য সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের লিখনী সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধ হয়ে জাতীয় ধারায় অবদান রাখুক। হরিশংকর জলদাস ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী চট্টগ্রামের গৌরব। তাঁদের সৃষ্টির পথ অবারিত হলেই এ-চট্টগ্রাম গৌরবান্বিত হবে। এই দুই কথাসাহিত্যিকের আগামীর পথ চলা হোক আরো বিস্তীর্ণ। সুস্থ থাকুন আমাদের কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষ হরিশংকর জলদাস ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী।