চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান

মর্জিনা আখতার | রবিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সাগর, নদী, পাহাড় বিধৌত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। এ অঞ্চলের মানুষের মন উদার, মহৎ ও সৌন্দর্য পিপাসু। একটু অবকাশ পেলেই এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে এখানকার মানুষ খুঁজে বেড়ায় দর্শনীয় স্থান। পেতে চায় প্রকৃতি থেকে সজীবতা ও মানসিক প্রশান্তি। কিছু কিছু দর্শনীয় স্থানের আছে ঐতিহাসিক ও ধর্ম বিষয়ক ঐতিহ্য। চট্টগ্রামে আপন রূপ-সুষমায় শোভিত হয়ে আছে অনেক দর্শনীয় স্থান।
ফয়’স লেক
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় অবস্থিত কৃত্রিম হ্রদ। ১৯২৪ সালে আসাম, বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এই হ্রদ খনন করা হয়। সে সময় পাহাড়তলী রেল হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ রেল প্রকৌশলী ফয়’র ( ঋড়ু) নামে। ফয়’স লেক নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কনকর্ড কর্তৃক নির্মিত এই বিনোদন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের জন্য হ্রদে নৌকাভ্রমণ, রেস্তোরাঁ, ট্র্যাকিং এবং কনসার্ট এর আয়োজন এর ব্যবস্থা আছে। এখানে বিরল প্রজাপতির পাখি আছে। হরিণ পার্কে হরিণ আছে। এর পাশেই চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। মনোরম পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আকর্ষণে দেশী বিদেশী পর্যটকগণ এখানে ছুটে আসেন। চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালী হিলের অবস্থান এই লেইকের কাছাকাছি।
ডি সি হিল
চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননের বৌদ্ধমন্দির সড়কে এর অবস্থান। বর্তমানে এর নাম ‘নজরুল স্কোয়ার’। এখানে বিভিন্ন সময় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানাবিধ অনুষ্ঠান, বইমেলা ও দিবসভিত্তিক নানাবিধ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও সারা বছর শরীর সুরক্ষার জন্য সকাল বিকাল বিভিন্ন মানুষ হাঁটেন।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী/আদিবাসী/উপজাতি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বাদামতলীর মোড় সংলগ্ন এলাকায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রদর্শিত শিল্পকর্মে রয়েছে তাদের প্রচলিত জীবনের চালচিত্র।
চেরাগি পাহাড়
কথিত আছে কোন এক আউলিয়া চেরাগ হাতে এই পাহাড়ে এসেছিলেন। তাই এর নাম চেরাগি পাহাড়। বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার বিচরণক্ষেত্র হিসেবে এটি সুপরিচিত।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি
এটি কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি গ্রেভস কমিশনের একটি সৌধ, যেটি সাধারণ মানুষের কাছে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই সমাধিসৌধ তৈরী করে। সূচনালগ্নে এখানে ৪০০টি সমাধি ছিল। বর্তমানে ৭৩১টি সমাধি আছে।
কোর্ট বিল্ডিং
চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং চট্টগ্রাম শহরের পরীর পাহাড়ে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক ভবন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৩ সালে চট্টগ্রামকে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল ঘোষণা করে। এসময় প্রশাসনিক কাজের জন্য দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর আয়তন ১৫৩০০০ বর্গফুট ও কক্ষ সংখ্যা ছিল শতাধিক। এখান থেকে জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও আদালতের কার্যাবলী পরিচালিত হয়।
বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার
এটি চট্টগ্রামে নাসিরাবাদের একটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ইরানের বিখ্যাত পার্সিয়ান সুফি বায়েজিদ বোস্তামীর নামে গড়ে উঠা এই মাজার চট্টগ্রামবাসী ও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই সমাধির অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনা থেকে আবিষ্কার করা হয়।
সি আর বি হিল
সিআরবি হলো চট্টগ্রামে আর একটি প্রাণের জায়গা। অসংখ্য বৃক্ষের ঘেরায় সবুজ পাতার সামিয়ানার নীচে সবাই ছুটে যায় বুক ভরে শ্বাস নিতে। একে বলা হয় চট্টগ্রামের ফুসফুস, কেউ কেউ কেউ বলেন অঙিজেনের ঘাঁটি। এখানে শিরিষ তলায় বাঙালির প্রাণের উৎসব, বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান পালিত হওয়ায় জায়গাটি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব
সমুদ্র আর পাহাড় মিলে অপূর্ব একটি স্থান। মাঝখানে হ্রদ, দুই পাশে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনানী। ঘননীল পানিতে বোটে চড়ে ভ্রমন পিপাসুরা অনেক আনন্দ পায়। পাশেই আছে পুষ্পিত বাগানের মাঝে আধুনিক সাজে সজ্জিত গলফ ক্লাব।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত
বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও জনপ্রিয় হলো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় এটি অবস্থিত।
চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির
সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় হিন্দু ধর্মামলম্বীদের তীর্থস্থান। সুবিশাল সমুদ্র অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সীতাকুণ্ডকে করেছে অনন্য সুন্দর।
সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক
সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অনেক জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সবুজ বনানী শোভিত অসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা। এর অপরূপ সৌন্দর্য্যে নয়ন মন দুটোই মুগ্ধ হয়।
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত সীতাকুণ্ডে অবস্থিত। স্থানীয় মানুষের কাছে এই সৈকত ‘মুরাদপুর বীচ’ নামে ও পরিচিত।
বাশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত
এটি ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত। পাহাড়, লেক, ঝর্ণা, প্রাচীন স্থাপনাসহ বহুমুখী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এ উপজেলা। এখানেও রয়েছে একটি অপূর্ব সমুদ্র সৈকত।
পারকির চর
চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এটা মূলতঃ কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার একটি উপকূলীয় সমুদ্র সৈকত। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
স্বাধীনতা পার্ক
স্বাধীনতা পার্ককে ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলা হয়। পুরো বাংলাদেশের সকল জাতি গোষ্ঠীর আদলে এবং এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের আলোকে তৈরী হয়েছে এ পার্ক।
মহামায়া লেক
বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ মহামায়া। ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এই লেকের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ি ঝর্ণা। স্বচ্ছ পানির জলাধারের চারপাশ যেন সবুজ চাদরে মোড়ানো, যা দেখতে খুবই দৃষ্টিনন্দন। গোধূলি লগ্নে নীলিমায় সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করে। এটি চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে অবস্থিত।
চালন্দা গিরিপথ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চালন্দা গিরিপথ। গিরিপথটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭শ ৫৩ একর আয়তনের মধ্যে অবস্থিত। অ্যাডভেঞ্চার আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের কাছে এখন তাদের নতুন নাম চালন্দা গিরিপথ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ঝুপড়ির পাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার উৎপত্তিস্থল বা ছড়ার পানি ধরে পশ্চিম দিকে ঘণ্টা খানিক হেঁটে গেলে প্রাকৃতিক বিস্ময় চালন্দা গিরিপথের দর্শন পাওয়া যায়। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে হিমশীতল অনুভূতি শরীরকে ছুঁয়ে যায়। দুই পাহাড়ের মাঝখানে প্রকৃতির তৈরী রাস্তায় এগিয়ে যেতে সমানভাবে হাত পায়ের ব্যবহার করতে হয়। পাহাড়ের ঢালে ঢালে বর্ণিল চিত্র যেন অজানা রহস্য। প্রতিটি পদক্ষেপই শিহরণ জাগানিয়া।
এরকম আরো অসংখ্য নান্দনিক ও দর্শনীয় স্থান বাণিজ্য নগর ও দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর চট্টগ্রামকে করেছে আরো গুরুত্বপূর্ণ। পুরো দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে চট্টগ্রামের অনেক আদর ও কদর রয়েছে। রূপের উৎকর্ষতার কারণে চট্টগ্রামকে অনেকেই ‘প্রাচ্যের রানী’ নামে অভিহিত করেন। এ কারণে চট্টগ্রামবাসী হিসেবে আমরা ও গৌরব বোধ করি। শুধু তাই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সভ্যতা ও প্রগতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সকল ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম চিরকাল এগিয়ে। তাই সবসময় তদারকি ও পরিচর্যা করে দর্শনীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে তা অক্ষুন্ন রাখা সংশ্লিষ্ট সকলের ও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভুলে গেলে চলবে না, চট্টগ্রাম আমার, আপনার, সকলের।

লেখক : প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রম অভিবাসনে মধ্যস্থকারীদের আইনি কাঠামোতে আনা হবে
পরবর্তী নিবন্ধআইনস্টাইনের ব্রেনের মূল্য