বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে (অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদ থেকে উনিশ শতকের প্রথম পাদ) কোলকাতা এবং তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কবিওয়ালা নামে এক শ্রেণীর কবির আবির্ভাব হয়েছিল। বিষয়ভিত্তিক পালাগানে মুখে মুখে পদরচনার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এসকল কবিওয়ালাদের সাহিত্যপ্রয়াসের লক্ষ্য। এন্থনি ফিরিঙ্গি, ভবানী বণিক, গোজলা গুঁই, ভোলা ময়রা, নিতাই বৈরাগী প্রমুখ বড় বড় প্রতিভাবান কবিওয়ালা বাংলা লোকসাহিত্যের এই ক্ষেত্রে আবির্ভূত হলেও ভাবের অগভীরতা তৎসঙ্গে বিষয়ের রুচিহীনতার অপবাদ নিয়ে কবিওয়ালাগণ উনিশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলা সাহিত্যের সামাজিক অঙ্গন থেকে অন্তরালে হারিয়ে যান। কিন্তু চট্টগ্রামে কবিওয়ালাদের এই ধারা বিগত শতকের পুরো সময় জুড়ে বেশ দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছিল। এঁদের পরিবেশনা চট্টগ্রামে সাধারণভাবে কবিগান নামে সুপরিচিত। কবিগান চট্টগ্রামের লোকজীবনে বিনোদনের এক অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গত শতকের শেষার্দ্ধের মাঝমাঝি সময় পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। সে সময় সমাজের জমিদারস্থানীয়, বিত্তশালী ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের বিবাহ কিংবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে কবি গানের আয়োজন হতো। আপামর জনসাধারণ এই কবিগান উপভোগ করার জন্য পরম আগ্রহে জমায়েত হতেন। চট্টগ্রামে কবিয়ালদেরকে সম্মানসূচক ‘সরকার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিয়ে বাড়িতে আনন্দের বাড়তি আয়োজন হিসেবে এই কবিগান গ্রামেগঞ্জে বেশ প্রচলিত ছিল। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে মাইকের আবিষ্কার এবং বিয়ে বাড়িতে উচ্চৈস্বরে মাইক বাজানোর রেওয়াজ শুরু হলে আস্তে আস্তে কবিগান গ্রামীণ সামাজিক বিনোদনে তার গুরুত্ব হারাতে থাকে। অবশ্য এখনো তা একেবারে হারিয়ে যায়নি, বিভিন্ন উপলক্ষে চট্টগ্রামের গ্রামে গঞ্জে অনুষ্ঠিত হবার সংবাদ এখনো মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় আসে। বর্তমান শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত কবিগাইয়েগণ চট্টগ্রামে বেশ সংগঠিত ছিলেন।
কবিগান যদিও বিশেষ কোন কবিই রচনা করেন, তাঁদের রচনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লোকউপাদান থাকে। কারণ প্রথমতঃ স্মৃতিশ্রুতির মাধ্যমে বাহিত লোকসঞ্চয় থেকে ব্যাপক ভাবে উপকরণ আহরণ করা ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে কোন কিছু রচনা করা সাধারণভাবে একটু কঠিন। দ্বিতীয়তঃ যে সকল শ্রোতা তাঁদের কবিতা উপভোগ করেন, তারা লোকজ ধারায়ই প্রশিক্ষিত, আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয়। তা ছাড়া এগুলো রচিত হয় যেমন মুখে মুখে, মানুষ ও প্রজন্মপরম্পরায় তা ধারণ এবং সঞ্চালনও হয় স্মৃতিশ্রুতির বাহনেই। আবার অক্ষরজ্ঞানহীন সাধারণ মানুষ এই সাহিত্যের উপভোক্তা হওয়ার কারণে কবিগানের ভাষাও হয়ে থাকে যথাসম্ভব মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। এসমস্ত বিষয় বিবেচনা করে আমরা কবিগানকে অনায়াসে লোকসঙ্গীতের আওতাভুক্ত করতে পারি। তা ছাড়া আদর্শ বাংলা ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করলেও কবিয়ালদের ভাষায় চট্টগ্রামী বিশিষ্ট শব্দ, শব্দবন্ধ, উপমারূপক অলঙ্কার ইত্যাদি ব্যাপকভাবে স্থান করে নেয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাভাষার চট্টগ্রামী উচ্চারণই তাঁরা নিঃসঙ্কোচে অনুসরণ করেন। তাঁদের গানে সবচাইতে বেশি জোর পড়ে বক্তব্যের উপর। এসকল কারণে কবিগানের পরিপূর্ণ স্বাদগ্রহণে গ্রামের নিরক্ষর আম জনতার কোন কষ্টই হয় না। সুতরাং নানা কারণে কবিগানের লোকিক পরিপ্রেক্ষিত অস্বীকার করার উপায় নেই।
কবিগানকে কবির লড়াই বলাই ভাল, একসময় এটাকে তাই বলা হত এবং কবির গানে দুই পক্ষের কবির হারজিতই ছিল মুখ্য বিষয়। দর্শকরাও নামজাদা কবিদের কে হারে কে জেতে, সেটি প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে পরম কৌতূহল এবং চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে দলে দলে সমাবিষ্ট হতো কবিগানের আসরে। অবিমিশ্র একটি লড়াইয়ের আবহ টিকিয়ে রাখার আয়োজনে কোন ফাঁক রাখা হতো না কোথাও। অনুষ্ঠানের আগে পর্যন্ত যুধ্যমান পক্ষদ্বয়ের কেউই জানতেন না লড়াইয়ে তাঁর প্রতিপক্ষ কে। উভয় কবি এবং তার বায়েনদোহারদের সঙ্গে চুক্তি এমন গোপনভাবে সম্পন্ন হতো যাতে অপর পক্ষ ঘুণাক্ষরে এবিষয়ে কিছু জানতে না পারে। শুধু তাই নয়, কোন্ বিষয়ে লড়াই হবে এবং কে কোন্ পক্ষ নেবেন, তাও সযত্নে অনুষ্ঠানের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত গোপন রাখা হতো উভয়পক্ষের নিকট থেকে। গানের জন্য উভয় পক্ষের জন্য চৌকি কিংবা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে স্বতন্ত্র উঁচু মঞ্চ তৈরি করা হত এবং ‘পাল্টা’য় অংশগ্রহণ করতেন যে দুইজন কবি, সম্মানপ্রদর্শনে তাঁদের কোন পক্ষের যাতে কোন ইতরবিশেষ না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হত। কবিগান কী পরিবেশে হতো, সে সম্পর্কে একটি বিবরণ আমরা কবি ওহীদুল আলমের কাছে পাই। আমরা সেটি উদ্ধৃত করছি-
কোন বড় লোকের বাড়িতে বিয়েশাদি উপলক্ষে উঠানে বা নিকটস্থ খোলা ময়দানে শামিয়ানা টাঙিয়ে মাঝখানে দুজন কবির সঙ্গে কবিতার লড়াই চলে – এরকম একটি খোলা মঞ্চ। চারদিকে লোক বসার জন্য ফরাস বিছানো। দুইপাশে দোহারীদের বসার স্থান।
কবিগণ অনুষ্ঠানস্থলে আসতেন যথাসময়ে এবং প্রায় আধমাইল দূরে থাকতেই শোনা যেতে থাকত ঢোলকাঁসার বাজনার মাধ্যমে তাদের সমারোহপূর্ণ আগমনী বার্তা। এই সময় এবং অনুষ্ঠান শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত কোন দলের কোন বাদক অন্য দলের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখা হত যত্নের সঙ্গে। উভয় পক্ষ সভাস্থলে উপস্থিত হলে গানদাতা কিংবা সমাজের কোন সম্মানী ব্যক্তিত্ব গানের বিষয়বস্তু এবং কোন্ কবি কোন্ পক্ষে অবস্থান নিয়ে লড়াই করবেন, তার ঘোষণা দিয়ে দিতেন। সাধারণতঃ নারী বনাম পুরুষ, গ্রাম বনাম শহর, আধুনিক যুগ বনাম প্রাচীন যুগ, যুদ্ধ বনাম শান্তি, শরীয়ত বনাম মারফত, ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র, ধনী বনাম দরিদ্র, বিজ্ঞান বনাম সাহিত্য, গুরু বনাম শিষ্য, সত্য বনাম কলি, ধর্ম বনাম বিজ্ঞান, স্বর্গ বনাম নরক, আসমান বনাম জমিন, গণসংস্কৃতি বনাম বুর্জোয়াসংস্কৃতি ইত্যাদি ছিল কবিয়ালদের পালার কয়েকটি জনপ্রিয় বিষয়। মূল কবিকে সম্মানিত করার জন্য কায়দাকৌশল ও রীতিরেওয়াজের প্রচলন ছিল। ঘোষণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে মূল কবি আসর নিতেন না। প্রথমে যে কোন এক পক্ষের ঢোলক তাঁদের নির্দিষ্ট মঞ্চে উঠে ঢোলের মহড়া অর্থাৎ কিছুক্ষণ ঢোল বাজিয়ে ঢোল বাজনায় তাঁর ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রদর্শনী দেখিয়ে যেতেন। তার ‘পাল্টা’ জবাব দেবার জন্য অন্য পক্ষের ঢোলক এসে অনুরূপভাবে তাঁর ঢোল বাজনার কসরত প্রদর্শন করতেন। এর পরে আসতেন আবার ঢোলক এবং কাঁসি নিজস্ব প্রদর্শনী দেখানোর জন্য এবং তার কসরতের যোগ্য জবাব দেবার জন্য আসত অপর পক্ষের ঢোলক ও কাঁসি। কবিগানে ঢোলককাঁসিদের সম্মান কিংবা দক্ষতাও কোনক্রমেই অবহেলার যোগ্য বিষয় ছিল না। পরলোকগত চট্টগ্রামের অসাধারণ প্রতিভাবান ঢোলক ঁবিনয়বাঁশী জলদাস কবিয়াল রমেশশীলের ঢোলকদলের সদস্য ছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিটি পক্ষ তাদের ঢোলককাঁসির সঙ্গে দোহারও সঙ্গে মঞ্চে এসে তাদের মহরত প্রদর্শন করতেন। দোহারগণ সাধারণতঃ কবিগণের সহকারী ও প্রায়শঃই শিষ্য হয়ে থাকেন। তারা ‘ডাকমালশি’, ‘টপকা’ ইত্যাদি ছন্দে ও সুরে নিজ নিজ দলের কবির মাহাত্ম্য তুলে ধরতেন। ‘দু’ দলের ডাকমালশি সমাপ্ত হলে একদলের কবিয়াল সঙ্গীসহ আসরে উঠে প্রতিপক্ষদলের উদ্দেশ্যে সখীসংবাদে ও ‘দূতীসংবাদ’ ‘মাথুর’ কিংবা ‘মান’ এই ধরনের কোন ‘চাপান’ দেন। প্রতিপক্ষদলের কবিয়ালের উত্তরস্বরূপ একটি গান বেঁধে দেন এবং সে গানটিও তাঁর সঙ্গীরা আসরে গেয়ে শোনান। এর পর নিজেরা আরেকটি গানের চাপান দেন। এভাবেই কবির লড়াই শুরু হয় ও চলতে থাকে। প্রথম চাপানের পরই দলের মূল কবিয়াল আসরে ওঠেন মূল নায়ক হিসেবে।’ ( নূর উল আলম:২০০৩) মূলকবি যখন তার গান শুরু করেন, তখন তিনি তা করেন বন্দনা দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা, গুরু, দেশ, অলিআল্ল্লাহ প্রমুখের প্রতি যথাযথনিয়মে শ্রদ্ধা নিবেদন করে (‘প্রভুরে পশ্চিমে মানম আমি মক্কা হিন্দুস্থান/তার পশ্চিমে মানম আমি করবল্লা ময়দান’।) তিনি ‘মুখছড়া’ উপস্থিত করেন। এই মুখছড়াকে ঘোশাও বলে থাকে। ‘ঘোশা’ ‘ধুয়া’ শব্দের চট্টগ্রামী প্রতিশব্দ। কবি প্রথমে তার দোহার তথা সহকারী গায়কদেরকে একটি ঘোশা বা ধুয়া ধরিয়ে দেন। দোহাররা ঢোল এবং কাঁসা সহযোগে এই ঘোশা বারংবার গাইতে থাকে। মুখছড়ার ভাষা অনেকসময় হতো বেশ আক্রমণাত্মক বা শ্ল্লেষাত্মক (‘তোমার মুখে এমন কথা সাজে না, দ্বন্দ্বকে ভাবিলে মন্দ মিলন ছন্দ বাজে না’ কিংবা ‘মাঝি সাবধান, নদীতে পড়েছে ভাঁটা জোরে মার টান’ ইত্যাদি) হয়ে থাকে। একেকটি বক্তব্যাংশ সম্পন্ন হওয়ার পর দোহাররা আবার সেই ঘোশা গাইতে থাকলে কবি কিছুটা বিশ্রাম নেন কিংবা পরবর্তী বক্তব্যাংশ মনে মনে ভেবে নেন। প্রদত্ত ঘোশার ছন্দ কবি তাঁর অংশে যথাসম্ভব অনুসরণ করবার চেষ্টা করেন। নিচে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় ঘোশা তুলে ধরা হল-
১) মরি হায়রে হায়, দুঃখে জীবন জ্বলে
হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচটিক্কা ছাগলে।
২) আমার নাগর বন্ধু শ্যাম
তোমার জন্য আমি কলঙ্কী হৈলাম।
৩) আমার ভাবতে গেল দিন
আওলা সূতার তামারে মুই টাইনাম কতদিন।
নিজের বিষয় অবলম্বন করেও অনেক কবি তাৎক্ষণিকভাবে ঘোশা তৈরি করেন। ‘দেশবাসী ভাই/নারী নির্যাতনের কথা এখন বলে যাই’- সেরকম একটি ঘোশা।
এইভাবে পর্যায়ক্রমে আসে কবিদ্বয়। রংপাঁচালী, একপদী, ত্রিপদী ইত্যাদি নানা ছন্দে কবিরা তাঁদের বক্তব্য ও যুক্তি অপরের সামনে উপস্থিত করতে থাকেন। পরিশেষে থাকে ‘যোটক’ পর্ব। দ্রুত তালের এই পর্বে উভয় কবিই মঞ্চে উপস্থিত থাকেন এবং এই পর্বেই কবিদ্বয়ের জয়পরাজয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই পর্বে দোহাররা তালের ফাঁকে ফাঁকে ‘ভাল বেশ বেশ’ ধুয়া গাইতে থাকেন।
কবিগান যথাসময়ে শুরু হলেও তা যে কখন শেষ হবে, তা বলা খুব কঠিন ছিল। প্রায়শই দেখা যেত কথার মারপ্যাঁচে কবিগণ এমন ভাবে জড়িয়ে পড়তেন যে, কেউই প্রতিপক্ষের নিকট হার মানতে চাইতেন না। তাই লড়াই অনেকসময় চারপাঁচদিনেও শেষ হতো না। দর্শকরাও হারজিত প্রত্যক্ষ করার প্রত্যাশায় দিনের পর দিন দিনদুনিয়া ভুলে আসর জুড়ে বসে থাকত। সেই পরিস্থিতিতে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষকে পুনরায় কাজে ফিরিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে গ্রামের কর্তা ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ করতে হত। উভয়পক্ষকে জয়ী ঘোষণা করে তাঁরা লড়াইয়ের মধুর সমাপ্তির ব্যবস্থা করতেন। কখনো কখনো এমন ঘটনাও শোনা যেত যে, রণে ভঙ্গ দিতে ইচ্ছুক কোন কবি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার বাহানায় সেই যে সরে পড়ত, আর ফিরে আসত না।
আজকাল কবিগানের প্রতিযোগিতার সেই চরমভাব আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে কবির লড়াই অনেকটাই প্রীতিপূর্ণ ও আপোষমূলক। আজকাল কবিগান অনুষ্ঠিত হয় অনেকটাই প্রচারকাজের প্রয়োজনে। তাই কবিগানের আগের সেই জৌলুস বর্তমানে অবলুপ্ত। সব নিয়মই হয়তো ঠিক আছে কিন্তু হারিয়ে গেছে কবিগানকে ঘিরে গ্রামীণ সমাজের সেই উত্তেজনা। হারজিতের যোটক পর্বে কবিদ্বয় আজকাল আপাতঃদৃষ্টিতে বিপরীত বিষয় দুটোর উপযোগিতা ও পারস্পরিকতা স্বীকার করেন এবং উভয়ের আপাতবিরোধের অসারতা তুলে ধরেন। সমাজে সাধারণতঃ যে সকল তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে মানুষে মানুষে হিংসাহানাহানি হয়ে থাকে, সে সকল প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়েই বর্তমানে কবিয়ালরা পালা করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিতে ‘যুদ্ধ বনাম শান্তি’ বিষয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউটে কবিগানের একটি জমজমাট আসর বসেছিল। শান্তির জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন আছে, প্রতিপক্ষের এমন একটি বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে একজন কবি যে চরণ উপস্থিত করেছিলেন, তা আমার স্মৃতিতে এখনো টিকে আছে। কবি বলেছিলেন – ‘আগুনে আগুন নিভে/এই কথা যেজন ভাবিবে/ আগুনে জ্বলিয়া পুড়ি মরে’। ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ বিষয়ের মত স্পর্শকাতর বিষয়েও কবির গান হতে দেখেছি। তবে সে ক্ষেত্রে হিন্দুর পক্ষ নিতেন কোন মুসলমান কবি এবং মুসলমান পক্ষ নিতেন কোন হিন্দু কবি। নানা শাস্ত্র সম্পর্কে প্রভূত অধ্যয়ন ছিল কবিয়ালদের, একটি আসরে কবিয়াল ইয়াকুবকে হিন্দুপুরাণ থেকে এবং ফনি বড়ুয়াকে কোরান হাদিস থেকে প্রচুর দৃষ্টান্ত দিতে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছিলাম। সাধারণ মানুষের উপর তাঁদের খুব প্রভাব থাকে। নিজদের প্রভাব খাটিয়ে সমাজে বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে সমপ্রীতি পুনঃস্থাপনে কবিয়ালগণ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেন। সমাজে কবিয়ালদের এই প্রভাব লক্ষ্য করেই অনেক ক্ষেত্রে প্রচার কাজেও কবিয়ালদেরকে নিযুক্ত করে থাকে প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা প্রশাসন। আইয়ুব খানের আমলে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রচারকল্পে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে কবি গানের বেশ বড় আসর বসানো হয়েছিল। একইভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ তথা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ের উপরও কবি গান হতে শুনেছি।
সন্দ্বীপের আজগর আলী ছিলেন এই অঞ্চলের আমাদের জানামতে সবচেয়ে প্রাচীন কবিয়াল। (অন্য এক সূত্রমতে চট্টগ্রামের কবিগানের জনক কধুর খীলের নবীন ঠাকুর। তাঁর সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানতে পারি নাই।) তিনি পটিয়ায় প্রবাসজীবন যাপন করতেন এবং এই অঞ্চলেই কবিগান গেয়ে বেড়াতেন। তিনি একই এলাকার করিম বখশকে (১৮৭৯-১৯৩৮) কবিগানে দীক্ষা দিয়েছিলেন। করিম বখশ কবিয়াল হিসেবে অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর বহু শিষ্য হয়েছিল। কথিত আছে তিনি নাকি কখনো কবির লড়াইয়ে পরাজিত হন নি । মনীন্দ্র দাশ, রসিকচন্দ্র নাথ, রমেশ চন্দ্র নাথ, দুর্গাকুমার শীল, সারদা শীল, অবর্ণ শীল, দুদু মিয়া তাঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্ল্লেখযোগ্য। তিনি যে তাঁর সমকালের সকলের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন, এটি বোঝা যায় তাঁর উদ্দেশ্যে সমকালের অনেক কবির প্রশস্তিবাণীতে। নিচে তার কয়েকটির প্রথম চরণ এখানে উল্ল্লেখ করছি-
১) কবিয়াল বাজারে তাঁর বাজে জয়ডঙ্কা
কবির নামেতে সবের মনে জাগে শঙ্কা।
২) গিয়ে দেখলাম সেই সভাতে করিম বক্স আসরেতে
গায়েন এমন সুন্দর কবিগান
প্রথম তাঁর রূপ দেখি তুলনাতে দেখাব কি
যেমন পূর্ণমাসীর চান। ( -সাবের সরকার)
৩) আমরা যারা বর্তমানে গাই কবিগান
সবার ভিতর আছে তাঁর অযাচিত দান। (-রাই মোহন বড়ুয়া )
কবিয়াল করিম বখশের কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বহু রচনা সংরক্ষিত হয়নি বলে আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। ওহীদুল আলমের ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে সংকলিত তাঁর বিপুল সংখ্যক রচনার অল্প কয়েকটি চরণ আমাদের এই ধারণা দেয় যে তিনি সত্যই এক অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন কবিয়াল ছিলেন।
সমসাময়িক কালের খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে রমেশ শীল ( ১৮৭৭-১৯৬৭; বোয়ালখালী থানার গোমদণ্ডী গ্রাম ) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লেখাপড়ায় তিনি প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেন নি এবং শৈশব কাল থেকেই তরজা আর কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। রমেশ শীল সমকালীন অনেক কবিয়াল অপেক্ষা তুলনামূলকভাবে অনেক প্রাগ্রসর ছিলেন; সমকালীন রাজনৈতিক গতিধারা সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সচেতনতা ছিল । অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, ১৯২২ এর বিখ্যাত রেল ধর্মঘট, বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বহু বিষয়ে তিনি গান রচনা করে এবং গেয়ে তিনি এদেশের সংগ্রামী মানুষের মনে সাহস যুগিয়েছেন। তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার জন্য তাঁকে ১৯৫৪ সনে কারাবরণ করতে হয়েছিল। বুলবুল ললিত কলা একাডেমী ১৯৬২ সালে তাঁকে শ্রেষ্ঠ লোককবির সম্মানে ভূষিত করেছিল। তাঁর অসামপ্রদায়িক চেতনার জন্য তিনি এদেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন। তরুণ বয়সেই তিনি মাইজভাণ্ডারের পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত প্রচুর মাইজভাণ্ডারি গান ভক্তদের মধ্যে বিপুলভাবে সমাদৃত। তবে রমেশ শীলের সমাজ ও রাজনীতিসচেতনতার জন্য তাঁর শিষ্য ও অন্যতম সহযোগী কবিয়াল ফণি বড়ুয়ার (১৯১৪-২০০১) নাম বিশেষভাবে উল্ল্লেখ্য। রাউজানের পাঁচখাইন গ্রামের অধিবাসী ফণি অতি অল্প বয়সে জীবিকার তাড়নায় রেঙ্গুন প্রবাসী হয়েছিলেন। সেখানে মতিলাল বড়ুয়া নামে একজন সৌখীন কবিয়ালের সংস্পর্শে এসে কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হন। দেশে ফিরে তিনি যথেষ্ট অর্থকষ্ট সহ্য করে রমেশ শীলের কাছ থেকে হাতে কলমে কবিগান শেখেন এবং তাঁরই স্নেহানুকূল্যে পেশাদারী কবিগানে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বিশিষ্ট কম্যুনিস্ট নেতা আবদুস সাত্তারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সম্ভবত সেই সুবাদে তিনি মার্ক্সবাদী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন । সমসাময়িক কালের চট্টগ্রামের মাস্টারদার ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডও তাঁকে দেশ ও সমাজসচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে। চট্টগ্রাম শহরের সন্নিকটস্থ পাহাড়তলী গ্রামে অনুষ্ঠিত একটি পালায় তিনি সর্বপ্রথম দেশের সংগ্রামী নেতা ও মানুষের বন্দনা করে গান ধরলে তা বঙ্কিম সেন প্রমুখ তখনকার খ্যাতিমান কম্যুনিস্ট নেতাদেরকে আকৃষ্ট করে। তাঁদের সকলের চেষ্টায় রমেশ শীল এবং তাঁর অন্যান্য শিষ্যগণ রাম-রাবণ, একাল-সেকাল ইত্যাদি থেকে এই অঞ্চলের কবিগানকে মুক্ত করার ব্যাপারে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। এই প্রসঙ্গে রমেশশীলের অপর শিষ্য রাই গোপাল দাশের (১৯১৮-১৯৮৭) কথাও উল্ল্লেখ করতে হয়। বোয়ালখালীর ধোরলা গ্রামের এক প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান একসময় কবিগায়ক হিসেবে যথেষ্ট নামডাকের অধিকারী হয়েছিলেন। রমেশ শীলের মৃত্যুর পরে তিনিই ফণি বড়ুয়ার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। কবিয়াল হেদায়েত ইসলামের সঙ্গে চট্টগ্রামের কবিগায়কদের সংগঠিত করার কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
কবিয়াল হিসেবে রাউজানের সাবের সরকার (জন্ম আনুমানিক ১৯০৬- গশ্চি গ্রাম)ও সমসাময়িককালে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁরই ছাত্র ইয়াকুব আলী ( ১৯৩১-? ) একসময়ে চট্টগ্রামের কবিগানের জগতে যথেষ্ট যশের অধিকারী হয়েছিলেন। হাইস্কুলের কয়েকটি ক্লাসমাত্র পড়ে তরুণ বয়সে জীবিকার সন্ধানে তিনি বার্মা ও আসাম গিয়েছিলেন। কিন্তু বিফল মনোরথ হয়ে দেশে ফিরে এসে কবিয়াল সাবের সরকারের পুঁথি বিক্রির কাজ নেন এবং তাঁরই সংস্পর্শে ও অনুপ্রেরণায় তিনি কবিগান শুরু করেন। বাংলা একাডেমিসহ চট্টগ্রামের বাইরের অনেকগুলো শহরে নানা বিষয়ে কবিগান করে তিনি প্রভূত সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। কবিয়াল ইয়াকুব আলী বহুদিন বেতারের সঙ্গে যুক্ত থেকে বেতারেও বহু কবিগানের অনুষ্ঠান করেছেন। ১) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় পল্লীগীতি; ২) চাটগাঁয়ের আঞ্চলিক গান; ৩) মন্দের ছন্দ; ৪) বিচ্ছেদতরঙ্গ এবং ৫) কবিগান – তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের নাম। বেতারে ও সভাসমিতিতে তিনি সরকারি প্রচারকাজ করেছেন। সমসাময়িককালে নিরঞ্জন দাশ ( জন্ম আনুমানিক ১৯১৩ ), শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী ( ১৯১৭ ), নজু মিয়া, মনীন্দ্র সরকার (১৯০০-২০০০), নুর আহমদ সরকার (১৯১৪-১৯৮৫), রাইগোপাল দাশ (১৯১৮-১৯৮৭), আহমদুর রহমান, বিভূতিরঞ্জন নাথ, রাখাল মালাকার, রাখাল দাশ, মানিক শীল, সারদা বড়ুয়া (ফটিকছড়ি), মোহাম্মদ সৈয়দ ( জন্ম ১৯৩৬; আনোয়ারা থানার শিলাইগড়া অঞ্চল), রাই মোহন বড়ুয়া, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ( পটিয়ার দৌলতপুর)), মোহাম্মদ নুরুল হক ( আনোয়ারা থানার ভীমরুল অঞ্চল ), মহেন্দ্রলাল দাশ ( পটিয়া থানার মহিরা ), জীবনকৃষ্ণ দাশ ( কানুনগো) প্রমুখ কবি হিসেবে কমবেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আজ থেকে বছর বিশেক আগেও যাঁরা এই ধারার সাংস্কৃতিক কর্মের সঙ্গে নিজদেরকে যুক্ত রেখে যন্ত্রসংস্কৃতির ্আগ্রাসন থেকে এই ধারাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডাঃ এম. আর. আলী, নুরুল আলম, চক্রপাণি ভট্টাচার্য, কল্পতরু ভট্টাচার্য, মোশতাক আহমদ, মানিক শীল, খুকীরাণী শীল ( মানিক শীলের সহধর্মিণী), দিলীপ ভট্টাচার্য, মাধুরী ভট্টাচার্য, কালামিয়া ফারুকী, বাবুল বিশ্বাস, মোহাম্মদ ইউসুফ প্রমুখের নাম উল্ল্লেখযোগ্য। এঁদের অনেকে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।
বর্তমানে বিলীয়মান চট্টগ্রামের অসাধারণ সামাজিক বিনোদনের এই ধারাটিকে জনসচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনার মাধ্যমে কি আবার সজীব ও সচল করে তোলা সম্ভব? চলুন না, বিষয়টা একটু ভেবে দেখি।
লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, কক্সবাজার
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি