চট্টগ্রামের আওয়াজ কি ঢাকা শুনতে পাচ্ছে না

সিআরবি ইস্যু

জসীম সিদ্দিকী | শনিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:৩০ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় পিপিপি এর ভিত্তিতে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীসহ বিশিষ্টজনেরা। নগরীর প্রাকৃতিক ‘ফুসফুস’ ও ‘অঙিজেন’ ভাণ্ডার আখ্যা দিয়ে ওই এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ না করার দাবিতে তারা বিরামহীনভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। তাছাড়া ইতোমধ্যে এলাকাটিকে ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে বন্দর নগরীর মহাপরিকল্পনায় সিআরবি ‘সংরক্ষিত এলাকা’ হওয়ায় বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশও দেওয়া হয়েছে। সবার দাবি একটাই পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করতে গেলে শতবর্ষী অনেক গাছ কাটা পড়ার পাশাপাশি এখানকার সবুজ নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রয়েছে ১৯৭১ এ পাঞ্জাবীদের বেয়নেটের খোঁচায় নিহত রেল হাসপাতালের পিয়ন শহীদ আবুল হাশেমের কবর। বলা হচ্ছে- ‘এই মাটি শহীদের স্মৃতিধন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সিআরবি তথা পাহাড়তলী ছিল বিপ্লবের সূতিকাগার। সেসব স্মৃতি সংরক্ষণে রেলওয়ে উদ্যোগ নেয়নি। অথচ শহীদের কবর, শহীদের নামে কলোনি, শহীদের নামে যে সড়ক সেই জমি তারা বেসরকারি হাসপাতালকে বরাদ্দ দিয়েছে।’
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকগণ এরই মধ্যে নাগরিক সমাজ, সিআরবি রক্ষা কমিটি ইত্যাদি নামে সংগঠনের ব্যানারে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। বিবৃতি দিয়েছেন, গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করেছেন, স্মারকলিপি দিয়েছেন। চট্টগ্রামের বড় বড় সব সংগঠন ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতাও ঘোষণা করেছে। এত আন্দোলনের মাঝেই রেলের দায়িত্বশীল বড় কর্তারা তাদের অনড় অবস্থানের কথা দৃঢ়চিত্তে বেশ কয়েকবারই জানান দিয়ে নাগরিকদের রোষানলেও পড়েছেন। চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হওয়া এই সিআরবি রক্ষা আন্দোলন এখন চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলাগুলোতেও কর্মসূচি পালন শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃতির প্রাণ রক্ষার এ দাবির অগ্রভাগে রয়েছেন কিন্তু ক্ষমতাসীন দলেরই একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। তবে দ্বিমত পোষণ করছেন মাত্র দুয়েকজন। তাদের বিরুদ্ধে আবার প্রকল্পের পক্ষে স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগও ইতোমধ্যে নেটিজেনরা তুলেছেন। যে কথা না বললেই নয়; যারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের দাবি হচ্ছে তাদের কেউই কিন্তু হাসপাতাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে নন; সবাই চট্টগ্রামে হাসপাতাল হোক চান, কিন্তু সিআরবির মত প্রাকৃতিক নৈসর্গিক জায়গা ধ্বংস করে নয়।
হ্যাঁ, আজ থেকে যদি বছর আট-দশেক আগে সিআরবি এলাকায় এ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হতো, মনে হয় আজকের মতো চট্টগ্রামবাসী ফুঁসে উঠতো না। কারণ তখন সিআরবি এলাকাটি এখানকার মানুষের কাছে খুবই ভীতিকর এলাকা তথা ছিনতাই স্পট বলেই চিহ্নিত ছিল। কোনো যাত্রীকে নিয়ে যদি কোনো টেঙি বা রিকশা ওই পথ ধরে যেতে চাইতো তাহলে যাত্রীদের সাথে গাড়ির চালকের কথা কাটাকাটি বা মারধরের ঘটনাও ঘটতো। গা ছমছম করে উঠত যে এলাকার কাছে গেলে সেখানকার সেই দুর্নামই ঘুচিয়ে দিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই। এলাকাটিতে আলোকায়ণসহ নানা ধরনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে এটিকে মানুষের কাছে আপন বানিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের স্পটটি থেকে ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীসহ বাজে ছেলেদের আড্ডাকে বিতাড়িত করা হয়েছে। বছরের পর বছর অবহেলিত ও প্রাকৃতিক নৈসর্গ্যের সেই দৃষ্টিনন্দন স্পটটিতে মানুষের জন্য প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে কিন্তু এই আওয়ামী লীগের সরকারই। আর সেই সরকার আবার এখন এই জায়গাটিকেই ধ্বংস করতে চাইছে, সেটা মারাত্মক দুঃখজনকই বটে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের দুয়েকজন শীর্ষ নেতার সাফাইতে ক্ষুব্ধ নগরবাসীকে চরম হতাশাও পেয়ে বসেছে। নীরব প্রশ্ন জেগেছে তাদের মনে। আর সেটি হচ্ছে- সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দীর্ঘ এতো দিনেও কোনো ধরনের সিগনাল আসছে না কেন? যারা রক্ষা করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা সবাই সরকার দলেরই লোক। আবার যারা বিরোধিতা করছেন তারাও কিন্তু সরকার দলের। আবার যারা চুপ করে আছেন তারাও সরকার দলের। নিরপেক্ষ নগরবাসীর জানার বিষয় হচ্ছে- চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে; সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যদি হয় সিআরবিতেই হবে হাসপাতাল প্রকল্প – তখন আন্দোলনে থাকা সরকার দলের নেতৃবৃন্দ পিছু হটবেন কীভাবে? আর তারা যদি সিআরবিকে শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে না পারেন তখন তারা কী করবেন?
আরেকটি বিষয় নগরবাসীর মনে জেগে বসে আছে- সিআরবি রক্ষায় চট্টগ্রামে সরকারি দলের নেতারাই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন এ আন্দোলন মাসের পর মাস ধরে চলছে? সংশ্লিষ্টদের কেউ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি হ্যালো করছেন না কেন? চুপ করে নেতারা আবার পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে বাকবিতন্ডায়ও জড়াচ্ছেন? দীর্ঘ আন্দোলনের নানা দিক বিশ্লেষণে সর্বশেষ উপলব্ধি এও হতে পারে যে, একটি ইস্যু জিইয়ে রেখে চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠকে সরকার দল আসলে তাদের নিজেদের দখলেই রাখতে চাইছে। যার জন্য অবিরত আন্দোলনই চলছে।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে, রাজনীতির মাঠ হোক বা আর যা-ই হোক ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন আপনারা আমার দল নৌকা মার্কার প্রার্থীদের ভোট দিন। চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজ হাতে নিলাম। সেদিনের ঘোষণা মতে নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে চট্টগ্রামের জন্য দু’হাত উজাড় করে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা ধরনের প্রকল্প দিয়েছেন। সেসব প্রকল্পের কাজ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে সরকারের ইমেজকে প্রথমসারিতে নিয়ে গেছে। যার জন্যই সিআরবির মতো একটি ছিনতাই স্পট চট্টগ্রামবাসীর কাছে প্রাণের স্পটে পরিণত হয়েছে। আর সেই প্রাণের স্পটটি রক্ষায় আজ তারা মাঠেই পড়ে রয়েছেন। এ আন্দোলন আর কত দিন চলবে বা এর শেষ কোথায় তা জানতে চায় নগরবাসী। তারা জানতে চায়- চট্টগ্রামের আওয়াজ কি ঢাকা শুনতে পাচ্ছে না?
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে