ঘরে ফেরা

গরম তেলের ঝলসানি

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৩১ জুলাই, ২০২৩ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

(শেষ পর্ব)

রিভারসাইড হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে আমাকে একটা হোটেলে তুলে দিলো। আমার সেজভাইভাবী সন্ধ্যাবেলা হোটেলে এলেন আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন বলে। নিউপোর্ট নিউজের হোটেল থেকে আরলিংটনে ভাইয়ের বাসা প্রায় ১৭০ মাইলের উপরে, আড়াই থেকে তিন ঘন্টার ড্রাইভ। তখনো আমি অজমুর্খ, অ্যামেরিকার হাইওয়ে সিস্টেম, গাড়ি চালানোএগুলো কিছুই বুঝি না। ভাই শাঁ শাঁ করে চালিয়ে গভীররাত নাগাদ তাদের সুউচ্চ এপার্টমেন্টে পৌঁছালেন। প্রায় বিশপঁচিশতলা বিল্ডিং, কতশত ভাড়াটিয়া!

ভাই ছিলেন ব্যাচেলর, মাত্র মাসখানেক হলো বিয়ে করে ভাবীকে এখানে এনেছেন। তার মধ্যে আমিও এসে হাজির। যাহোক, তিনজনে মিলে সেখানে ভালোই দিন কেটেছিলো। ভাইভাবী আমার খুবই যত্ন করেছিলেন। ক্ষতস্থান পরিষ্কার, ব্যান্ডেজ বদলে মলম লাগিয়ে নতুন ড্রেসিং করা। অনেক কিছুই ভাই নিজ হাতে করেছিলেন। একে উনি ডাক্তার নন, তার উপরে আমার কুৎসিত ক্ষতস্থান ও রসপুজ ইত্যাদি ওনাকে কষ্ট করে সহ্য করে যেতে হতো। আবার ছোটভাইয়ের কষ্ট যাতে না হয়, আমি যাতে ব্যাথা না পাইসেদিকেও অনেক সজাগ থাকতেন।

ভাইভাবীর সেবা শুশ্রূষায় ধীরে ধীরে সব ক্ষত সেরে উঠতে থাকলো, শুকিয়ে আসতে থাকলো। যদিও পুড়ে যাওয়ার দাগ অনেকখানিই রয়ে গেছে, তবে ইনফেকশানের ভয় আর নাই। মুখের দাগ অনেকটা চলে গেছে; বলে না দিলে, প্রথম দেখায় কেউ খেয়াল করবে না। এর মাঝে এখানের লোকাল ডাক্তারকেও দেখালাম। সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকতামক্ষতস্থানে যেনো ইনফেকশান না হয়। সেগুলো ঠিকমত শুকাচ্ছে তো? হাসপাতালের পরিবেশ থেকে বাসায় এসে কী ভালো হলো? না খারাপ হলো?

আমি বেকার বসে থাকি সারাদিন, তাই বিকালে একটু হাঁটতে বের হই। অ্যামেরিকার সমাজ, বাড়িঘর, দোকানপাট, শহর দেখি। সবচেয়ে বেশী দেখি সেখানের মানুষজনকে। কত দেশের, কত জাতের, কত ধর্মের, কত বর্ণের মানুষ সেখানে। সকলেই যে যার নিজের মত চলছে, কাজ করছে, খাচ্ছেদাচ্ছে, দিনশেষে বিনোদন করছে। অনেকেই বলে মেল্টিংপট, মানে যেখানে সকলে এসে মিলে গিয়েছে। আমি অবশ্য মেল্টিংপটের চাইতে সালাদবোল বা সালাদের বাটি উপমাটাই যুৎসই মনে করি। মেল্টিংপটে সকলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে, একটা নতুন স্যুপ তৈরি হয়। কিন্তু সালাদের বাটিতে প্রতিটা উপকরণই নিজ নিজ স্বকীয়তা নিজস্ব গুণস্বাদ বজায় রাখতে পারে। অ্যামেরিকা হলো সেরকমই একটা দেশ। আপনি অ্যামেরিকানাইজ্‌ড্‌ হতে পারেন, কিন্তু একইসঙ্গে আপনার শিকড়ও বজায় রাখতে পারবেন।

অধিকাংশ মানুষই ভালো এবং ম্যানার মেনে চলে। প্রয়োজন না পড়লে কারো ব্যাপারে কেউ নাক গলায় না; আবার দরকারে সাহায্য চাইলে, অবশ্যই এগিয়ে আসবে। তাই বলে যে এইদেশ ধোয়া তুলসীপাতা সেটাও নয়; অনেক খারাপ মানুষও আছে, অনেক খারাপ দিকও আছে, বর্ণবৈষম্য ধর্মবৈষম্য ছিলো, আছে এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। প্রতি সমাজেই ভালও আছে আবার মন্দও আছে। এখানেও তাই; তবে ভালোর পরিমাণ হয়তো বেশী, তাই অধিকাংশ মানুষই সুখেশান্তিতে বসবাস করতে পারে। এখানে নির্বিঘ্ননির্ঝঞ্ঝাট জীবনদুর্নীতি ও করাপশান অতি অল্প, বা নাই বললেও চলে। যারা ড্রাগ্‌স্‌গ্যাং ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত, তারা জেনেশুনেই নিজের ক্ষতি করতেই সেই পথে পা বাড়ায়। ভদ্রশিক্ষিতলোকেরাও, বড় বড় পলিটিশিয়ানরাও ক্রাইম করে (white-collar crime); এবং আইনের সাজা সকলেই পায়। আর সবচেয়ে বড় হলোআপনার যোগ্যতা থাকলে, আপনি এদেশে ঠিকই সম্মান ও মূল্যায়ন পাবেন এবং সঠিকস্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন।

গত কয়েক বছর জাহাজে করে আমি দুনিয়ার অনেক দেশই ঘুরাফেরা করেছি। একেক দেশের একেক আকর্ষণ রয়েছে; আবার অন্যদিকও রয়েছে যা হয়তো তেমন ভালো না। কিন্তু অ্যামেরিকা এমন একটা দেশ যেখানে সবই এসে মিলেছেসেজন্যেই দুনিয়ার সকলপ্রান্তের মানুষই এখানে স্থায়ী বসবাস করতে চলে আসে। অনেক উন্নত দেশ থেকেও এখানে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসে। উল্টাপ্রবাহ (মানে, অ্যামেরিকা ছেড়ে দিয়ে অন্যদেশের নাগরিক হওয়া) খুবই কম দেখবেন। বিশ্বের কোনো দেশ হয়তো, শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে ভালো; কিন্তু অন্যকিছুতে পিছিয়ে রয়েছে। অন্য আরেকটা দেশে হয়তো গণচিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো; কিন্তু অন্য আরেকদিকে পিছানো। এভাবেই কিছু না কিছু একটা ঘাটতি রয়েছে। অ্যামেরিকারও ঘাটতি আছে, সবক্ষেত্রেই তো আর অ্যামেরিকা নাম্বার ওয়ান নয়। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে, সুস্থসুন্দর নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চালাতে গেলে, বাচ্চাদের নিরাপদে বড় করতে গেলে, এদেশই মনে হয় সবচেয়ে ভালো। যদিও, অনেকখানি নির্ভর করে বাবামা্থর নিজস্ব নৈতিকতা ও পছন্দের উপরে।

আমাকেও অনেকেই বললো অ্যামেরিকায় থেকে যেতে। বছরকয়েক আগেই প্রেসিডেন্ট রোন্যাল্ড রীগ্যান পলিটিক্যাল চাল হিসাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে লাখে লাখে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের সিটিজেন করে নিয়েছেন। অনেকেই সেরকম আশার প্রলোভন দেখালো যে। মনে শখ জাগলেও, অনেক হিসাবনিকাশ করে দেখলাম আমার এখনো সময় হয়নাইবয়স বেশী অল্প, অভিজ্ঞতা কম, এখানে হুট করে ভালো চাকরি পাবো না। আমাকে শুরু করতে হবে একদম নিচের থেকেএতদিনের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালেখার কোনো মূল্যই থাকবে না। আর কোনই গ্যারান্টি নেই, কতদিনে পছন্দমত সম্মানজনক কাজ করতে পারবো। ভালো কোনো চাকরির ক্ষেত্রে এরা স্বাভাবিকভাবেই এদেশীয়দেরকেই প্রথমে প্রাধান্য দিবেহয় অ্যামেরিকান নাগরিককে অথবা এদেশে পড়ালেখা করেছে এরকম ক্যান্ডিডেটকে। আমি কোত্থেকে এসে হুট করে ভালো চাকরি পাবো? অবশ্য এখানে একটু পড়ালেখা করতে পারলে, সম্ভাবনা বাড়বে বৈকি; কিন্তু এইমুহূর্তে পকেটে টাকাপয়সাও নেই যে পড়ালেখা করবো। গত দুইবছরে ইংল্যান্ডে মেরিনের প্রফেশানাল পড়ালেখা করে, ব্যাঙ্ক খালি। দেশে আব্বাআম্মাও বেশ উৎকন্ঠিতছেলের এতবড় এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো; ওনারা বুঝছেনই না আমি কেমন আছি। কতটুকু ভালো? কতটুকু খারাপ? হাঁটাচলা করতে পারি? মুখের আদল কী হয়েছে? পূর্বজীবনে ফিরে যেতে পারবো কিনা? ইত্যাদি। সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশেই ফিরে যাবো। নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলি, নিজেকে প্রস্তুত করি। যদি কপালে অ্যামেরিকায় বসবাসের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে যাতে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে জীবন কাটাতে পারি, সেইভাবে প্রস্তুত হয়েই আসবো।

এরমাঝে আমাদের এক খালাতো ভাই, মন্টিভাই অ্যামেরিকা থেকে দেশে যাচ্ছেন বিয়ে করতে। আমি আমার কোম্পানিকে ওনার টিকিটের সঙ্গে মিলিয়ে আমারও প্লেনের টিকিট করে দিতে বললাম। দুইজনে অ্যামেরিকার দুই শহর থেকে আলাদা ফ্লাই করে লন্ডনে যাবো; সেখান থেকে একই ফ্লাইটে ঢাকায়। মন্টিভাই একদিন আগে লন্ডনে পৌঁছে, চব্বিশঘন্টার একটা শর্টট্রিপে বার্মিংহ্যামে আমার চতুর্থ ভাই ডঃ ইকবাল আমিন ও তুহিনভাবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তুষারঝড়ে পথে আটকে গেলেন। এর ফলে আমাদের আর একসঙ্গে ঢাকায় পৌঁছানো হলো না।

কিন্তু আমি এখনো ঢাকা এয়ারপোর্টে সেদিনের কথা মনে রেখেছি। আমাদের দুইজনকে রিসিভ করতে আব্বাআম্মা, ভাই, মামা অনেকেই এসেছিলেন। সেসময়ে আমার জাহাজে চাকরির উপলক্ষ্যে পাঁচছয়মাস পরপরই আমি বিদেশ যেতাম। আব্বাআম্মা সেজন্যে বারেবারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আমাকে সিঅফ বা রিসিভ করতে আসতে পারতেন না। প্রথম দুই একবার করেছিলেন; তারপরে ওনাদের কষ্ট হয় দেখে আমিও মানা করেছিলাম। কিন্তু এইবারে ওনারা ভয়ে, উৎকণ্ঠায় ও দুশ্চিন্তায় আর চট্টগ্রামে বসে থাকতে পারেন নাই। আমাকে দেখেই আব্বাআম্মা বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদলেন। ওনারা বলছিলেন, আমার পুড়ে যাওয়া চেহারা কেমন হয়েছে? সেটা কি ওনারা সহ্য করতে পারবেন কিনা? এই ধরনের খারাপ চিন্তাগুলোই ওনাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু, আল্লাহর অশেষ রহমত। ততদিনে আমি অনেকটা সেরে গিয়েছি। উন্মুক্ত মুখে, হাতে ইত্যাদিতে ভালোমত খেয়াল না করলে, পুড়েছি যে, সেটা বুঝা যাবে না। হাল্কা কালচে, বা কোথায়ও সাদাটে দাগ রয়েছে শুধুমাত্র।

এখন তেত্রিশ বছর পরে, আমি নিজের শরীরে পুড়ে যাওয়ার দাগ বলতে গেলে খুঁজেই পাই না। বাঁ দিকে গলার কাছে, যেখানে প্রথম আঘাত (বা তেলের ধারা) পড়েছিলো, সেখানের চামড়ায় এখনো অল্প দাগ রয়েছে; এবং সে জায়গার চামড়াটাকেও আমার নিজেরই একটু অন্যরকম লাগে। গরমকালে, বেশী রোদে সেই জায়গাটা চিড়বিড় করে। শীতকালেও শুকনা বাতাসে শুকিয়ে অল্পস্বল্প চুলকানোর মত হয়। দুই কানের চামড়ায় হাত দিলে বুঝতে পারি বাঁ কানের উপরের চামড়াটা ডান কানের চাইতে বেশ পাতলা এবং সেনসিটিভমনে হয় অল্প একটু ঘষলেই রক্ত বের হবে। কিন্তু এগুলো তো কিছুই না, যদি সেই ১৯৯০এর অক্টোবর মাসের দিনটার সঙ্গে তুলনা করি। আল্লাহ্‌েক সেজন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ্‌ সব্বাইকে একটা না একটা ঘটনার মাঝ দিয়ে, প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে দেন; এবং অনেক কিছুই জানিয়ে দেন, বুঝিয়ে দেন। যারা বুঝবার তারা বুঝে, আর যারা অবুঝ তারা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আমার জীবনের সেটাই ছিলো একটা বড়সড় টার্নিং পয়েন্ট।

টলিডো, ওহাইও, ২০২৩

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিনু কাহারের থেটার
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় মডেল মসজিদ উদ্বোধন