গুপ্তধনের লোভে সর্বস্বান্ত

মায়ের কারণে টাকা হারানো প্রবাসী এখন জেলে ভিসার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে স্বর্ণ মানিকের প্রতারণার জাল

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি | সোমবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের গুদারপাড় বেতছড়ি গ্রামের দিনমজুর আবদুল মান্নানের ছেলে কাতার প্রবাসী মো. মামুন (২৫)। গুপ্তধনের লোভে তার মা কুলছুমা বেগম ছেলের কষ্টে আয় করা টাকা কাউকে না জানিয়ে তুলে দেন প্রতারক চক্রের হাতে। ছেলে বিদেশ থেকে এসে বিষয়টি জানতে পেরে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চালান। তবে উল্টো প্রতারক চক্রের করা অপহরণ ও চাঁদাবাজি মামলায় দুই মাস ধরে জেল খাটছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে বছরখানেক আগে প্রবাসী মামুনের মায়ের সঙ্গে বাঁশখালীর ছনুয়া গ্রামের সৈয়দ আহম্মদের ছেলে আহম্মদ কবির মানিক ওরফে স্বর্ণ মানিকের পরিচয় হয়। স্বর্ণ মানিক তাকে প্রলোভন দেখিয়ে গুপ্তধন পাইয়ে দেয়ার কথা বলেন। ওখানে থাকবে স্বর্ণমুদ্রা। গুপ্তধন পেতে গোপনীয়তা রক্ষা করে বিভিন্ন মাজারের দোহাই দেন প্রতারকরা। তারা কৌশলে প্রলুব্ধ করেন কুলছুমা বেগমকে। একপর্যায়ে প্রতারক মানিক এক বছরের ব্যবধানে তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন প্রবাসী ছেলের পাঠানো ৭ লক্ষাধিক টাকা। শুধু তার কাছ থেকে নয়, রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর বেতছড়ি গ্রামের বেশ কয়েকজন মহিলার কাছ থেকে একই কায়দায় অন্তত অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান ওই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ বেলাল।
বেলাল জানান, কয়েক মাস আগে মামুন দেশে এসে প্রতারকের হাতে মায়ের টাকা হারানোর বিষয়টি জানতে পারেন। তিনিসহ এলাকার কিছু পরিবার আমাকে বিষয়টি জানালে আমরা র‌্যাব-৭, সিপিসি-৩ এর কোম্পানি কমান্ডার বরাবর অভিযোগ করতে গিয়ে জানতে পারি, প্রতারক স্বর্ণ মানিকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। মীরসরাই এলাকার বেলায়েত হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী একই দিন র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করতে আসেন। স্বর্ণ ও কষ্টি পাথর দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ২৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এমনকি তাকে বাঁশখালীতে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে দুদিন আটকে রেখে আরো দশ লাখ টাকা দাবি করে। কমান্ডার তার অভিযোগটি লিখিত আকারে নেন এবং প্রতারককে ধরার ব্যাপারে তৎপরতা চালাবেন বলে জানালে আমরা চলে আসি।
এদিকে দুই মাস আগে মামুনসহ প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের কাছে স্বর্ণ মানিকের র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর আসে। তারা আদালতে গিয়ে স্বর্ণ মানিকের ভাই কামাল উদ্দিনসহ দুই প্রতারককে দেখতে পান। একজন পালিয়ে গেলেও তারা কামালকে ধরে ফেলেন। তারা প্রথমে আদালত পুলিশের কাছে যান। সহযোগিতা না পেয়ে তাকে রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদে এনে তাদের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া টাকাগুলো ফেরত দিতে বলেন। বিষয়টি মীমাংসার জন্য তাকে পরিষদে আনা হয় বলে জানান মামুনের মা কুলছুমা বেগম। এরপর প্রতারক কামালের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ইসলামপুর ইউনিয়নে বৈঠক করে হাতিয়ে নেয়া টাকাগুলো ফেরত দিতে বলেন।
এদিকে কামালকে অপহরণ করে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি অপহরণ মামলা করে কামালের পরিবার। পরে সিভিল ড্রেসে পুলিশ এসে প্রতারক কামালকে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নিয়ে যায় এবং প্রতারণার শিকার মামুন ও বেলায়েতকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে।
ইসলামপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আরফাত হোসাইন বলেন, প্রতারক কামাল, স্বর্ণ মানিকসহ একটি চক্র আমার ওয়ার্ডের অনেক নিরীহ পরিবারের কাছ থেকে নানা প্রলোভনে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারক কামালকে এলাকায় নিয়ে এলে আমি তাকে পরিষদে নিয়ে যাই এবং তার পরিবারকে ভুক্তভোগীদের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে বলি। কিন্তু তারা উল্টো অপহরণ মামলা করে প্রবাসী মামুনকে ফাঁসিয়ে দেয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, প্রতারক কামালকে ইসলামপুরের গহীন জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ তাকে পরিষদে সবার সামনে থেকে নেয়া হয়েছে। মামুন ভালো ছেলে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে প্রতারক চক্রের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কোতোয়ালী থানার এসআই মেহেদী হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ইসলামপুর থেকে কামালকে উদ্ধার এবং মামুন ও বেলায়েতকে গ্রেপ্তার করেছেন বলে জানান তিনি। মামলাটির তদন্ত চলছে বলে উল্লেখ করেন। তাকে পাহাড় থেকে নাকি পরিষদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই বিষয়ে জানতে চাইলে তার বক্তব্য দেয়ার এখতিয়ার নেই বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ বেলাল বলেন, একদিকে স্বর্ণের কয়েনের লোভ দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতারক চক্র। অন্যদিকে তাদের মিথ্যা মামলায় জেল খাটছে কাতার প্রবাসী মামুন। কাতারে তার ভিসার মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানের এমন বিপদে অসহায় হয়ে পড়েছেন তার স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবা। প্রতারক চক্রের কারণে একটি পরিবার আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
মামুনের মা কুলছুমা বেগম বলেন, আমার কারণে ছেলের কষ্টের টাকা প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে। এখন টাকা ফেরত নিতে গিয়ে উল্টো ছেলে মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গেছে। ঘটনার তদন্তপূর্বক আমার ছেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি এবং যারা আমাদের সাথে প্রতারণা করে ফাঁসিয়েছে তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
অপহরণ মামলায় আদালতে মামুনের পক্ষের আইনজীবী নুরুল হক তালুকদার বলেন, আমরা নিরীহ প্রবাসী মামুনের জামিনের আবেদন করেছি। আগামীকাল ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. জেবুন্নেচ্ছা মহোদয়ের আদালতে (ফৌজদারী মিস মামলা নং-৩৫০১/২০২২) এর শুনানি করা হবে। আশা করি একজন নিরীহ প্রবাসী সঠিক বিচার পাবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে ১১ ফার্মেসিকে জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচন আজ