গুন্ডুইল্লা

এমরান চৌধুরী | বুধবার , ১৪ জুলাই, ২০২১ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

‘সারাক্ষণ বুবু আর বুবু!
বুবুর জন্য এতই যদি তোর দরদ, তার শ্বশুর বাড়ি গিয়েই থাকলে পারিস।’
‘তাই থাকব। আমি এক্ষুনি বুবুর ওখানে চলে যাব।’ এই কথা বলেই স্পঞ্জের সেন্ডেল জোড়া হাতড়িয়ে নিয়ে হন হন করে উঠোনে নেমে পড়ল গুন্ডুইল্লা।
কদিন আগে তার বড় ভাই রাঙ্গামাটি থেকে তার জন্যে এক জোড়া নতুন সেন্ডেল এনেছে। টুকটুকে লাল ফিতা। এখনও পরা হয়নি। মা কত করে বলেছিল, ‘এতদিন ছিঁড়েপাটা সেন্ডেল পরেছিস, এখন এগুলোই পর। শুনেনি। আজ হুট করে তা বের করে নিল। বুবুকে না দেখিয়ে কী এত সুন্দর সেন্ডেল পরা যায়!’
‘ওমা, এই তো দেখছি সত্যি সত্যি যাবে।’
‘এই না, যেতে বললে?’
মা গুন্ডুইল্লার স্বভাবের কথা জানে। ছেলেটা বুবু বলতেই পাগল। দু’একদিন বুবুর শ্বশুর বাড়িতে যেতে না পারলে তার চেহারাটা কেমন যেন হয়ে যায়। মনে হয় আষাঢ়ের ঘনঘোর মেঘ তার সারা মুখ ঢেকে রেখেছে। একবার জিদ চাপলে আর রক্ষে নেই। যা বলবে তা-ই করবে। এতটুকুন ছেলেটা কোথা থেকে এত জেদ পেল বুঝে আসে না তার।
তবু একবার থামাবার চেষ্টা করতে মা তার পিছু পিছু ছুটল।
বলল, ‘গুন্ডু, একটি কথা শোন বাবা। এই ভর দুপুরে কোথাও যেতে নেই। দুপুরে কত জায়গায় কত কিছু থাকে। তোর যদি কিছু একটা হয়ে যায় আমার বড্ডো ভয় করছে। ঐ যে কাঁকন দিঘির ঘটনাটা তোর মনে নেই, একবার রাতে তোকে বলেছিলাম।’ মা দেখল, তাকে ফেরানো যাবে না। শেষে তাই বলল, ‘দুপুরের ভাতটা হলেও খেয়ে যা।’ বলেই মা তাকে আগলে দাঁড়াল। কিন্তু কার কথা কে শুনে। এই হাত ধরে তো ঐ হাতে শুরু করে ধস্তাধস্তি। এভাবে মা তার সাধ্যমতো চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই আটকানো গেল না।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভেবেছিল সেন্ডেল দুটো পায়ে দিয়েছে। এখন দেখল সেন্ডেল জোড়া তার হাতে। ডান হাতে শক্ত করে ধরে আছে লুঙ্গির গিট।
‘একি! তুইতো লুঙ্গিটাও ভালো করে পরিসনি। একটু দাঁড়া লুঙ্গিটা পরিয়ে দিই।’
‘না, পরাতে হবে না।’ বলেই এক লাফে নেমে পড়ল আলপথে। অঘ্রাণের আধা পাকা ধান ক্ষেতের আল বেয়ে হেঁটে চলল সুর সুর করে। মা তখনও ডাক দিয়ে বলছে, ‘গুন্ডু সেন্ডেল পর, নইলে কেঁডাটেডা ফুটবি।’
গুন্ডু যখন বুবুর বাড়ি পৌঁছল তখন বুবু পুঁইয়ের মাচান থেকে শাক তুলছিল। দৌড়ে বুবুর পায়ের কাছে গিয়ে টুপ করে সালাম করল। সালাম করার আগে সেন্ডেল জোড়া মাটিতে রেখে বাম হাতে লুঙ্গির গিট্টু ধরে রাখল যাতে খুলে না যায়।
‘এই রে দুষ্টু! মায়ের সাথে রাগ করে এসেছিস বুঝি।’
‘না।’
‘তবে।’
মা বলেছে, ‘বুবুর জন্য এত দরদ হলে তুইও তার শ্বশুর বাড়িতে চলে যা।’
‘তুই কী বললি?’
বললাম, ‘তাই যাব।’
‘একদম ঠিক বলেছিস।’ বলেই বুবু তার লুঙ্গির গিট্টু খুলে আবার সুন্দর করে পরিয়ে দিল। এ সময় বুবু দেখল তার বাম হাতে এক জোড়া সেন্ডেল। পুরো পথে সে একবারের জন্যেও তা পরেনি।
‘কিরে! পায়ের সেন্ডেল হাতে কেন?’
‘জানিস বুবু! তোকে দেখাব বলে পায়ে দিইনি।’
‘তাই বলে খালি পায়ে হাঁটবি। পথে কাঁটা থাকে। কাঁচের টুকরো থাকে, পেরেক থাকে, আরও কত কি! কোনো একটা পায়ে ফুটলে কেমন হতো?’
‘পায়ে দিলে তো ওগুলো পুরান হয়ে যেতো। তখন তোকে কি দেখাতাম?’
পাগলা ভাইটি আমার! বলেই তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল বুবু।
বিকেল বেলা বুবু রাতের রান্নার জন্য তরকারি কুটছিল। এ সময় সে পিড়া নিয়ে বুবুর পাশে বসল।
‘আচ্ছা বুবু একটা কথা বলব?’
‘একটা কেন দু’ দশটা বল! একটা কথায় কি তোর পেট ভরবে?’
‘ভরবে বুবু।’
‘ভরলে, বল।’
‘আমাকে সবাই গুন্ডুইল্লা ডাকে কেন?’ মা ডাকে গুন্ডু। তুইও ডাকিস। আমিন নানুও ডাকে।’
‘ওহ! এই কথা। এটাতো সবাই আদর করে ডাকে।’
‘তাই বলে গুন্ডুইল্লা!
‘শুনিসনি আমাদের পুব বাড়ির চেমুনির মা তার ছেলেকে কী নামে ডাকে!’
কী নামে?’
‘কালামানিক।’ তেমনি এই নামটাও তোকে আদর করে দিয়েছিল তোর আলুবোখারা ভাবী।’
আলুবোখারা ভাবীর নাম নিতেই গুন্ডুর চক্ষু দুটোতে ফড়িং নেচে উঠল।
আলুবোখারা ভাবী তাকে খুব ভালোবাসে। ডর বদ্দা শহর থেকে যা কিছু আনে সবটাই তাকে খেতে দেয়। একা খায় না। সেই ভাবীর আলুবোখারা খুব পছন্দ। উপরের তুলতুলে অংশ যেমন মজার তেমনি বিচির ভেতরেরটাও। তাই গুন্ডু আশা ভাবীকে আলুবোখারা ভাবীই বলে।
‘তো কেন দিয়েছিল বুবু?’
‘ছোটবেলায় তোর পেটটা ছিল ক্রিমির আড়ত।’
‘আড়ত মানে!’
‘আড়ত মানে গুদাম। যেখানে চাল,ডাল, গম,আটা রাখা হয়।’
‘আমার পেটটাও কী গুদাম!’
‘গুদাম না হলেও ডোলের মতো ছিল?’
‘তার মানে কেশুয়া গ্রামে যত ক্রিমি ছিল সব তোর পেটে ছিল। এই ক্রিমি তাড়াতে ফনি ডাক্তারের সিরাপ আর ইসা খাঁ’র চার আনার পুরিয়া এক দুই বছর নয় পুরো তিন বছর খাওয়াতে হয়েছিল।‘
‘এখনতো আমার পেট ছোট হয়ে গেছে। এখনও ডাকে কেন?’
‘সামনে থেকে আর ডাকবে না!’
‘খন থেকে?
‘মা বলেছে তোকে আগামী বছর স্কুলে দেবে। স্কুলের খাতায় তোর সুন্দর নামখানা উঠবে। সে নাম ধরে ডাকবে সবাই। গুন্ডু বলে আর কেউ ডাকবে না। আলুবোখারা ভাবীও না।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবা ং লা দে শে র পা খি
পরবর্তী নিবন্ধকখন কী করব