গাছের ছায়ায় ঘুম

আকবর হোসেন রবিন | সোমবার , ২ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের বাড়িতে ছোট-বড় দুটো পুকুর আছে। ছোট পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে কবরস্থান। অন্য তিন পাড়ে বড় গাছ খুব একটা নেই। তবে দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ কবরস্থানে কিছু বড় বড় গাছ সবসময় থাকে। সেজন্য কবরস্থানে গাছের ছায়া পড়ে। পুকুরপাড়ের এই কবরস্থান দেখতে অনেক সুন্দর। শুধু আমাদের বাড়ির করবস্থান না, যে-কোনো বাড়ির পুকুরপাড়ের কবরস্থানগুলো খুব সাজানো-গোছানো থাকে। দেখতে সুন্দর হয়।
যারা গ্রামে মারা যায় তাদের অনেক সৌভাগ্য। গাছের ছায়ায় যুগের পর যুগ ঘুমাতে পারে। মন চাইলে পাশের কবরে শুয়ে থাকা প্রিয়জনদের ডেকে গল্প শোনাতে পারে। শুয়ে শুয়ে পুকুরের পানির তরঙ্গ উপভোগ করতে পারে। মাছরাঙার চুপচাপ বসে থাকা কিংবা শূন্যে ডানা ঝাপটিয়ে ঝপাত করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের দৃশ্যও দেখতে পারে।
নামাজ শেষে বাড়ির ছেলেপেলে-মুরুব্বিরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে। চোখ ভেজায়। কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তিরা এসব নীরবে দেখতে পারে। বুঝতে পারে কিছু মানুষ মৃত্যুর অনেক বছর পরেও তাদের শূন্যতা অনুভব করে, খুব ভালোবাসে। কিন্তু শহরের কবরগুলো কেমন যেন কৃত্রিমভাবে তৈরি। পাশে পুকুর নেই। গাছের ছায়া নেই। গল্প করার জন্য পরিচিত কোনো মানুষ নেই। পাশে শুয়ে থাকা মানুষগুলো কেউ উত্তরবঙ্গের, কেউ হয়তো দক্ষিণবঙ্গের।
এতে সমস্যা পোহাতে হয় ইন্ট্রোভার্টদের।
সেদিন আমি দুই ছোট ভাইকে নিয়ে সাগরপাড় যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে হঠাৎ এক জায়গায় একটা গাছের দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি আটকে গেল। ত্রিকোণাকৃতি একটা মাছের ঘের। তার পাশে কিছুটা কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি সাইজের নাম না জানা একটা গাছ। আমার মনে হলো, ওই গাছের নিচে একটা কবর হলে মন্দ হয় না। মৃত ব্যক্তি আরামে শত শত বছর শুয়ে থাকতে পারবে। খুব ইচ্ছে করছিল ওখানে গিয়ে গাছের তলে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘেরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি।
আমার পাশে থাকা ছোট ভাইদের গাছটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘দ্যাখ, কবরের জন্য এটা একদম পারফেক্ট একটা জায়গা। তাই না?’ আমার কথা শুনে ওরা খানিকটা চুপসে গেল। আমি ওদের চেহারায় বিরক্তি ও ভয়ের মিশ্র অনুভূতি দেখতে পেলাম।
আচ্ছা, মৃত্যুকে মানুষ এত ভয় করে কেন? কবরস্থান দেখলেও অনেকে ভয়ে কাঁপে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নাকি অনেকের গা ছমছম করে। কিন্তু কই, আমার তো কখনো এমন ভয় কিংবা গা ছমছম হয়নি। অথচ বাড়ির কবরস্থানের পাশ দিয়ে রাত-বিরাতে কত হেঁটেছি। আমার দাদিও অনেক হাঁটতেন। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলে যেতেন ঢেঁকিশাক খুঁজতে। ঢেঁকিশাক দাদির খুব পছন্দের ছিল। প্রায় এক সপ্তাহ পরপর উনি শাক খুঁজতে বের হতেন। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। কিন্তু দাদি এখন আর হাঁটতে পারে না। কবরে শুয়ে শুয়ে শুধু দেখেন।
কবরস্থানের দুটো গাছে ঝুলে আছে ঢেঁকিশাক। সেগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কবরের ওপরে এসে ছায়া দিচ্ছে। মাছরাঙা ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে এসে গাছের ডালে বসছে। অর্ধেক মাছ খাচ্ছে। বাকি অর্ধেক মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। বর্ষার শুরুতে পুকুর থেকে কিছু কৈ মাছ পাড় বেয়ে ওঠে আসে কবরে। দাদি কৈ মাছ ভাজা খেতে খুব পছন্দ করতেন। আচ্ছা, এটা কি মাছেরা জানে?

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধঊনপঞ্চাশ বাতাস… একটি দর্শক-অনুভব