গলি থেকে রাজপথ চলছে জুয়া

বিপিএল নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে অনেকে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:২৬ পূর্বাহ্ণ

দেশের ফুটবল ঐতিহ্যের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে। একই ভাবে চলছে হকি, কাবাডি, দাবা, ভলিবল, আর্চারি, সাঁতার, ম্যারাথনসহ অন্যান্য খেলার উন্নয়নে পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। তবে একথা বলাই যায়, ক্রিকেটই এখন দেশের মানুষের কাছে ধ্যানজ্ঞান। আর এক ধরনের অসাধু চক্র মানুষের আবেগভালোবাসাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই হাজার হাজার টাকার ফলাফল বাজি, ওভার বাজি, রানবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলছে। নগরীতে ৫/৭ কোটি টাকার হাতবদল হচ্ছে এসব জুয়ার আসরে। সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা ঘটেছে ইতোপূর্বে। ঘটেছে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও। অন্যদিকে সবকিছু হারিয়ে পারিবারিক কলহে নষ্ট হচ্ছে সম্পর্ক। কেউ আবার পরিবারকে জিম্মি করে জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক অপরাধে। পাড়ামহল্লার অলিগলি, বাজার থেকে শুরু করে নগরীর অভিজাত হোটেলগুলোতেও চলছে বিপিএল নিয়ে জুয়া। চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ, সেলুন, রিকশা গ্যারেজ ইত্যাদি কেন্দ্রিক ক্রিকেট জুয়ার আসর বসছে প্রতিদিন। এসব আসরে যোগ দেওয়া বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। শিক্ষার্থী বা উঠতি তরুণও কম নেই। তারা জুয়ার আসরে এসে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছে। আয়ের সহজ পথ হিসেবে অনেকে বেছে নিয়েছেন জুয়া খেলাকে। তাতে উল্টো সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে তারা। অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে সিন্ডিকেটবদ্ধ জুয়াড়িদের পকেট। নগর জুড়ে এখন জুয়া খেলার রমরমা বাণিজ্য চলছে। পুলিশ এক স্থানে হানা দিলে একদিন বন্ধ থাকার পর জুয়াড়িরা অন্য স্থানে নতুন আসর খুলে বসছে। নগরীতে জুয়ার আসরগুলো উচ্ছেদে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়ের স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও অভিযোগ রয়েছে অনেক স্থানে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে দায় সারছে পুলিশ, আবার অনেক স্থানে অভিযানের কথা আগেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবু এ কথা ঠিক যে অভিযান চলছে নগর জুড়ে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (সদর) আব্দুল ওয়ারীশ এ প্রসঙ্গে বলেন, পাড়ায় পাড়ায় চলতে থাকা বাজি বা জুয়ার ব্যাপারে আমরা কিছু প্রমাণ পেয়েছি। তবে এলাকাবাসীকেও বিষয়টি নিয়ে আরো সচেতন হতে হবে। যদি কারও কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে অ্যাকশন নেব এবং অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ক্রিকেট অঙ্গনে ‘স্পট ফিঙিং’ আর ‘বাজির দর’ বহুল আলোচিত দুটি শব্দ। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের ওপর নজরদারি বাড়ানো কিংবা স্পট ফিঙিং প্রতিরোধে আইসিসি কত না প্রযুক্তির শরণাপন্ন হচ্ছে ইদানিং। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জুয়াড়িদের রোখার এই প্রচেষ্টার ফাঁক গলে খেলা নিয়ে জুয়া চলছে এখন গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই। আধুনিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত অথচ জনপ্রিয় সংস্করণ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট। বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিগব্যাশ, বিপিএলযাই হোক না কেন জুয়ার জ্বরে আক্রান্ত হয় গোটা দেশ। চলতি বিপিএল টুর্ণামেন্টও বাদ যায় কেন ? তাই জুয়াড়িরা বসে নেই। কোন টিম জিতবে তাতো আছেই, কে কত উইকেট পাবে, জিতলে রানে জিতবে না উইকেটে, নির্দিষ্ট একটি ওভারে রান কত হবেইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে চলছে জুয়া।

চার ছয়ের খেলা টি টুয়েন্টি ক্রিকেট। বিপিএল টুর্ণামেন্টে প্রায় সমশক্তির দল হওয়ায় বাজির বাজার সরগরম। জুয়াড়িরা মনে করছে ম্যাচে যে কেউ জিততে পারে। বিপিএলে বাজির নেশায় লাখ টাকা হারিয়ে এই জুয়া খেলার ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসা সাব্বির (ছদ্মনাম) নামের একজন এই সর্বনাশা জুয়া সম্পর্কে বলেন, টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলার সময় নগরীর পাড়ামহল্লায় আড্ডায়, সেলুন, ফ্লেঙিলোড কিংবা চায়ের দোকানে অনেক লোক একসঙ্গে খেলা দেখে। আসলে এর বেশির ভাগই জুয়ার আসর। এ খেলায় ছাত্র, বেকার, ব্যবসায়ী সবাই জড়িত। ১০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে একপর্যায়ে চলে হাজার হাজার টাকার জুয়া। ব্যক্তিগত পর্যায়েও জুয়া হয়। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জুয়ার কেনাবেচাও হয়। এ লোভেই নিঃস্ব হচ্ছে শত শত তরুণ। সুদে টাকা নিয়ে জুয়ায় নামার নজিরও আছে।

নগরীতে বিপিএলকে ঘিরে আছদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, সদরঘাট, পাথরঘাটা, স্টেশন রোড, নালাপাড়া, ফিশারীঘাট, হাজারি গলি, নেভাল টু আগ্রাবাদ, জিইসি, চকবাজার, বাকলিয়া ডিসি রোড, তুলাতলী, বৌবাজার, দিদার মার্কেট, ইপিজেড এলাকায় জুয়ার আসর বসছে নিয়মিত। ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে কত রান হবে, /১০ ওভারে কত রান হবে, টোটাল রান কত হবে, কোন প্লেয়ার বেশি রান করবে সব কিছুতেই চলে বাজি।

সরেজমিনে গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে নগরীর আছদগঞ্জ ও ঘণ্টা খানেক পর হাজারীগলি গিয়ে বিপিএল নিয়ে রমরমা বাজির দৃশ্য চোখে পড়ে। কাছে ভিড়তেই দেখা যায় হাতবদল হচ্ছে টাকা। ফোনে রেট জেনে বাজি ধরছেন শাহজাহান (ছদ্মনাম) নামে একজন। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘বিরক্ত করবেন না তো, মেজাজ খারাপ আছে, মাত্রই টাকা হারালাম।’ চায়ের দোকানে জড়ো হওয়া ১৫১৬ বছরের এক রেস্তোরাঁ কর্মী জানালেন, তাঁর এক সহকর্মী গত দুই দিনে সাড়ে আট হাজার টাকা বাজিতে হেরেছেন। অথচ তার মাসিক বেতন সাকুল্যে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।

নগরীর গোয়ালপাড়ার পোশাক শ্রমিক রফিক জানায়, রিগ্যান নামে এক তরুণের মাধ্যমে সে এ খেলার নেশায় মেতেছে। গতকাল শনিবার একদিনেই হারিয়েছে লাখ টাকা। কীভাবে এই জুয়া খেলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে এটাকে ‘ইস্টু’ খেলাও বলে। প্রথম দিকে এই খেলা ছিল কোন দল জিতবে? এটার ওপর বাজি ধরতো সবাই। আস্তে আস্তে ওটার সঙ্গে শুরু হয় কোন খেলোয়াড় কত রান করবে? কত ওভারে কত রান হবে, পাওয়ার প্লেতে কত রান আসবে, এই ক্রিকেটার হাফ সেঞ্চুরি না কি সেঞ্চুরি করবে, মোট রান কত হবে, টসে কোন দল জিতবে?- এসব নিয়ে’ একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন ধরুন ভারতপাকিস্তান খেলার দর ধরা হয় সমান। অর্থাৎ এক হাজার টাকা জুয়ায় জিতলে দুই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আবার ভারতওয়েস্টইন্ডিজের খেলার দর ১০:১৫। অর্থাৎ ওয়েস্টইন্ডিজের পক্ষে যারা এক হাজার টাকা বাজি ধরেছিলেন, জিতলে তারা আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ভালো দলের সঙ্গে খারাপ দলের খেলা হলে দর কষাকষিটা হয় ভিন্নভাবে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের খেলা হলে বাজির দর হয় ১:৩। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ১০০ আর আয়ারল্যান্ডের পক্ষে ৩০০ টাকা। সরেজমিনে অনুসন্ধানের সময় প্রতিবেদকের আচরণে সন্দেহ করে এক জুয়াড়ি। দৃষ্টি আড়াল করতে ৫০০ টাকাকে ৫ আর ১০০০ টাকাকে ১০ টাকা সংকেত হিসেবে পর্যায়ক্রমে জুয়ার অঙ্ক নির্ধারণ করে। খেলা শেষে এজেন্ট তার সুবিধাজনক স্থান ও সময়ে পরাজিত জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী জুয়াড়ির কাছে হস্তান্তর করে। এজেন্টরা জয়ী জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা হস্তান্তরের বিনিময়ে কমিশন পায় বলেও জানা যায়। ক্রিকেট নিয়ে জুয়া নতুন নয়। ২০১৪ সালে ঢাকায় ধরা পড়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জুয়াড়ি অতনু দত্ত। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানতে পারে, ওই জুয়ার সঙ্গে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিটের কর্মকর্তা ধরম সিং যাদব জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রামে এ জুয়া খেলোয় সর্বস্বান্ত হয়ে হাজারীগলির এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া রেয়াজউদ্দিন বাজারের এক দোকান মালিকের সন্তান ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে লাভলেন মোড়ে।

পরিসংখ্যান বলে, পাশের দেশ ভারত এবং পাকিস্তানে স্পট ফিঙিংসহ বাজির প্রভাব অনেক বেশি। বিশ্বে পাঁচটি বাজিকর বা জুয়াড়ি অধ্যুষিত দেশের মধ্যে থাকবে এই দুই দেশের নাম। বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের দেশে বাজিটা এসেছে এই দুই দেশ থেকেই। আর ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচেকানাচে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিম পাহাড় থেকে ২০০ ফুট খাদে গাড়ি
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের সঙ্গে স্থায়ী অংশীদারত্বকে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র : জো বাইডেন