খোঁজ মিলেছে আবু ত্ব-হা আদনানের

বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন : ডিবি

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ১৯ জুন, ২০২১ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

দশ দিন আগে রংপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে নিখোঁজ আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের খোঁজ মিলেছে বলে জানিয়েছে তার পরিবার। তার শ্যালক মো. জাকারিয়া বলেছেন, গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর ত্ব-হা রংপুরে তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসেন বলে তারা খবর পেয়েছেন। ধর্মীয় বক্তা হিসেবে পরিচিত ত্ব-হা এতদিন কোথায় কীভাবে ছিলেন, সেসব বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
রংপুর মহানগর পুলিশের ক্রাইম ডিভিশনের উপ-কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, আবু ত্ব-হাকে পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে যে তিনজন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তারাও যার যার বাড়ি ফিরে গেছেন। এ মুহূর্তে এইটুকু তথ্য আছে। পরে আমরা বিস্তারিত জানাব।
ত্ব-হা দুপুরের দিকে রংপুর মহানগরীর মাস্টার পাড়া এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে আসেন জানিয়ে তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে ও প্রতিবেশী মোহাম্মাদ মোনায়েব সাংবাদিকদের বলেছেন, বিকাল ৩টার দিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ গাড়িতে করে নিয়ে যায়। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর কোতোয়ালী থানার ওসি আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, বাড়ি ফিরে আসার পর ত্ব-হাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ডিবি কার্যালয়ে ফটক বন্ধ রাখায় সাংবাদিকরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। পরে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরে ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ত্ব-হা বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।
রপুরের এক সময়কার ক্রিকেট খেলোয়াড় ত্ব-হা পড়াশোনা করেছেন কারমাইকেল কলেজে। দর্শনে স্নাতকোত্তর করে বাড়ির পাশে আল জামেয়া আসসালাফিয়া মাদ্রাসায় তিনি পড়াশোনা করেন। অনলাইনে আরবি পড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে তিনি জুমার খুতবা দেন বলে পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য। তিনি ধর্মীয় বক্তা হিসেবেও পরিচিত; ফেইসবুকে তার পেইজের অনুসারীর সংখ্যা ৫২ হাজার।
ত্ব-হার পারিবারিক বাড়ি রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের আহলে হাদিস মসজিদ এলাকায়। তিনি প্রথম স্ত্রী হাবিবা নূর, দেড় বছরের ছেলে ও তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে শালবন মিস্ত্রীপাড়া চেয়ারম্যান গলিতে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। আর ঢাকার পল্লবীর লালমাটিয়া এলাকার এক বাসায় থাকেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। ওই বাসার নিচতলার দুটি ফ্ল্যাটে একটি বালিকা মাদ্রাসা রয়েছে, আবু ত্ব-হা যার মূল উদ্যোক্তা।
তার মা আজেদা বেগম ১১ জুন বিকালে রংপুর কোতোয়ালী থানায় জিডি করেন, সেখানে বলা হয়, তার দুদিন আগে গাড়িতে করে তিন সঙ্গীসহ ঢাকা যাওয়ার পথে ‘নিখোঁজ হন’ আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান। তার খোঁজে স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, র‌্যাব সদরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার, যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাবিকুন্নারের জমা দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গত ৮ জুন রংপুর থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো গ ৩৩-৪৩৪২) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন আবু ত্ব-হা। তার সঙ্গে ছিলেন আব্দুল মুহিত, মোহাম্মদ ফিরোজ ও গাড়িচালক আমির উদ্দীন ফয়েজ। গাড়িটিসহ এদের চারজনেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কথা ঘুরতে থাকার মধ্যে সাবিকুন্নাহার বলেছিলেন, ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে আলেমদের একটি পক্ষের সঙ্গে তার মতবিরোধ তৈরি হয়। এসব কারণে তিনি পরিচিত আলেমদের কাছে সাহায্য চেয়েও কোনো সাড়া পাননি। বরং সাধারণ মানুষ ও অনুসারীরা আদনানকে ফিরে পেতে অনলাইনে অনেক বেশি সোচ্চার।
সাবিকুন্নাহার জানিয়েছিলেন, রংপুরের বাড়ি থেকে ওইদিন বগুড়ায় একটি ধর্মীয় সভায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার স্বামীর। এরপর ঢাকায় আসার কথা ছিল। বিকেল ৪টার দিকে রংপুর থেকে একটি গাড়িতে করে বগুড়ার উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। ওই গাড়িটির মালিক রংপুরের আমির উদ্দীন, তিনিই চালান। রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ফোনে তিনি জানান, দুটি মোটরসাইকেলে চারজন তার গাড়িটিকে অনুসরণ করছে। পরে হয়ত ভয়ে বা উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি বগুড়ার সভায় যোগ না দিয়ে ঢাকার পথ ধরেন। রাত আড়াইটার দিকে গাড়ি গাবতলী পৌঁছেছেন বলে স্ত্রীকে জানান ত্ব-হা। এরপর থেকেই আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
পরে ফেইসবুক লাইভে এসে সাবিকুন্নাহার বলেছিলেন, ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার পর তার কাছে দুটি সন্দেহজনক কল এসেছিল। একটা অপরিচিত নম্বর থেকে বলা হয়েছিল, আদনানকে ছাড়াতে টাকা লাগেবে। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। ওই নম্বর পরে বন্ধ পাওয়া যায়। আর অনেকদিন ধরে বন্ধ আবু ত্ব-হার একটি পুরনো নম্বর থেকেও ফোন করে একজন পুরুষ কয়েকবার জানতে চান, সাবিকুন্নাহার তার স্ত্রী কিনা। কিন্তু সাবিকুন্নাহার তার পরিচয় জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়া হয়।
তবে ত্ব-হার হোয়াটসঅ্যাপ মাঝে মাঝে খোলা হচ্ছিল, অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য অনলাইন থেকে আবারও অফলাইন হয়ে যাচ্ছিল বলে সে সময় জানিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সাবিকুন্নাহার রাজধানীর দারুস সালাম থানায় গেলেও তখন পুলিশ মামলা বা জিডি নেয়নি বলে জানিয়েছিলেন।
এ বিষেয়ে দারুস সালাম থানার ওসি তোফায়েল আহাম্মেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আবু ত্ব-হা আদনান কোথা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সে বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় তার অভিযোগ গ্রহণ করা যায়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দুদিন আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আবু ত্ব-হাকে উদ্ধারে পুলিশ ‘কাজ করছে’।
বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন : আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান ব্যক্তিগত কারণে গাইবান্ধায় তার বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। গতকাল দুপুরে তাকে রংপুরে তার প্রথম স্ত্রীর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর রংপুর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বিকালে সংবাদ সম্মেলনে রংপুর মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি অ্যান্ড ক্রাইম) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ত্ব-হা রংপুর নগরীর কলেজ রোডে চারতলা মোড়ে প্রথম স্ত্রীর ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। এরপর তাকে সেখান থেকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ব্যক্তিগত কারণে আদনান ও তার দুই সফরসঙ্গী ও ড্রাইভার আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি গাইবান্ধায় তার বন্ধু সিহাবের বাড়িতে এতদিন অবস্থান করছিলেন। যেহেতু ব্যক্তিগত বিষয় তাই সেটি প্রকাশ্যে আনছি না আমরা। তবে এর পেছনে কোনো অপরাধ নেই বলেও আদনান পুলিশকে জানিয়েছেন।
তিনি জানান, নিখোঁজের দিনই তিনি ঢাকা থেকে গাইবান্ধায় ফিরেছেন। বাকি তিনজনকে বুঝিয়ে, অনুরোধ করে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তারা আত্মগোপনে ছিলেন। ব্যক্তিগত কারণটা কি? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু মারুফ হোসেন বলেন, যার যেটা ব্যক্তিগত বিষয় সেটা এভাবে প্রকাশ করতে পারি না।
দুজন মোটরসাইকেলে তাকে ফলো করছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু মারুফ বলেন, এটা তার ধারণা ছিল। এর তো তেমন কোনো ভিত্তি নেই। দেশ বা সরকারকে বিব্রতকর করতে এমন কিনা সেটাও আমরা যাচাই করে দেখছি। তবে সেরকম কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না বলে মনে হচ্ছে।
উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ বলেন, আবু ত্ব-হা শিক্ষিত ছেলে, তাই মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন, যাতে তাকে ট্র্যাক করা না যায়।
নেওয়া হলো আদালতে : আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান ও তার দুই সঙ্গীকে গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম হাফিজুর রহমানের আদালতে নিয়েছে মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ। রংপুর মেট্রোপলিটন উপপুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) আবু মারুফ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, যেহেতু নিখোঁজ বিষয়ে এ থানায় জিডি করা হয়েছিল তাই তাকে আদালতে বিচারকের কাছে নেওয়া হয়েছে। এখন তাদের আবেদন অনুযায়ী বিচারক পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন।

জবানবন্দি দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরলেন : আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান ও তার দুই সঙ্গীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের নির্দেশের পর তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। গতকাল রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের কড়া পাহারায় আদালত থেকে তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ত্ব-হার মা ও মামা আমিনুল ইসলামের জিম্মায় তাকে হস্তান্তর করা হয়।
আমিনুল ইসলাম এ সময় বলেন, আদালত থেকে পরিবারের অভিভাবক হিসেবে আমাদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমি ও আবু ত্ব-হার মা অভিভাবক হিসেবে এসেছি। আমাদের জিম্মায় তাকে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৪ মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৮