খুঁজে পাওয়া গেল সেই আংকেলকে

সুপ্তি মল্লিক হত্যায় নতুন মোড়

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে সেই ‘আংকেল’কে। গৃহবধূ সুপ্তি মল্লিক হত্যার ঘটনায় তাকে প্রথম থেকেই সন্দেহ করছিল পুলিশ এবং সুপ্তির বাপের বাড়ির লোকজন। সুপ্তির বাবা সাধন কুমার মল্লিক মেয়ের হত্যাকারী হিসেবে মামলার এজাহারে অভিযোগ করেছিলেন, স্বামী বাসুদেব চৌধুরী ও ভাসুর অনুপম চৌধুরী তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে তার মেয়েকে খুন করিয়েছে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও পুলিশ জানতে পেরেছিল, ঘটনার দিন দুপুরে সুপ্তিদের বাসায় ৩০/৩২ বছরের এক লোক এসেছিল। প্রতিবেশী একজন জানতে চাইলে সুপ্তি বলেছিলেন, তার আংকেল। সেই আংকেল ১৪ জানুয়ারি ঢাকার আশুলিয়া নিশ্চিন্তাপুর থেকে ধরা পড়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। পুলিশ জানতে পারে, সেই ব্যক্তি সুপ্তির আংকেল নন, প্রাক্তন স্বামী। নাম জাকির হোসেন। তাকে ও তার পরিবারকে সুপ্তির মা-বাবাসহ পুরো পরিবার আগে থেকেই চিনে। জাকিরের স্বীকারোক্তিতে বের হয়ে আসে পুরো ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে গতকাল পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর ইন্সপেক্টর সন্তোষ কুমার চাকমা আজাদীকে বলেন, লাশ উদ্ধারের পর থানা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই ছায়া তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে মামলাটি পিবিআই অধিগ্রহণ করে পুরোপুরি তদন্তভার নেয়। তিনি বলেন, বৃত্তের বাইরে যাওয়া মানে ধ্বংস ডেকে আনা। সুপ্তির করুণ পরিণতি তারই সাক্ষ্য দেয়। তিনি কী করেননি? প্রেম করে পালিয়ে গেছেন। ধর্মান্তরিত হয়ে জাকিরকে বিয়ে করেছেন। তিন মাস সংসার করে ভালো লাগছে না বলে জাকিরকে ডিভোর্স দিয়ে ফিরে এসেছেন। তার পরিবার এসব ঘটনা লুকিয়ে বাসুদেবের সাথে বিয়ে দেয়। সংসার করার ফাঁকে আবারো জাকিরের সাথে যোগাযোগ করে সম্পর্ক গড়েছে। আর শেষ পরিণতি হিসেবে তার হাতেই খুন হয়েছে। বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাথায় খুন হন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাধন কুমার মল্লিকের একমাত্র মেয়ে সুপ্তি মল্লিক। নগরীর ডবলমুরিং থানার পানওয়ালা পাড়ার নাসিমা মঞ্জিলের চতুর্থ তলার একটি বাসা থেকে গত ৪ নভেম্বর রাত ১২টার দিকে সুপ্তির (২২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ প্রথম থেকেই ধারণা করছিল তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। প্রাথমিক কিছু আলামতও তারা সংগ্রহ করেছিল। পিতা সাধন মল্লিকের অভিযোগের ভিত্তিতে ডবলমুরিং থানা পুলিশ স্বামী বাসুদেব চৌধুরী ও ভাসুর অনুপম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছিল।
স্বামীসহ সুপ্তি যে ভবনে থাকতেন সেই চারতলা বিশিষ্ট নাসিমা মঞ্জিলের ৫৩ নম্বর ফ্ল্যাটে প্রথম থেকে থাকতেন সুপ্তির ভাসুর অনুপম চৌধুরীর পরিবার। পরে সেখানে স্ত্রী সুপ্তিকে নিয়ে উঠেন স্বামী বাসুদেব। সুপ্তির প্রতিবেশী ফাতেমা পারভীন রিয়া ঘটনার পরদিন আজাদীকে জানিয়েছিলেন, ঘটনার দিন অর্থাৎ বুধবার বেলা তিনটার দিকে সুপ্তি আমাদের বাসার দরজায় আসেন। আমি ভেতরে ও সুপ্তি দরোজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তিকে সুপ্তিদের ঘরে আসতে দেখি, বয়স আনুমানিক ৩০/৩২ বছর হবে। কে জানতে চাইলে সুপ্তি বলেন, উনি আমার আংকেল হন। ১২টার দিকে জানিয়েছিলেন ভাত খেতে আসবেন। এখন এসেছেন। এ সময় সুপ্তি আমাকে অনুরোধ করে দুই কাপ চা করে পাঠাতে। আমার মেয়ে চা বানিয়ে দিলে তাকে ডেকে দুই কাপ চা দিই। বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ মনে হলো সুপ্তিদের বাসাটা কেমন জানি নীরব। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাইরে এসে দেখি দরজার সামনে পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দা উল্টে দেখি দরজা বাইরে থেকে আটকানো আছে। বার কয়েক সুপ্তির নাম ধরে ডাকাডাকি করেও সাড়া পাচ্ছিলাম না। পাশের বাসার ভাবীকে ডেকে বিষয়টি জানালাম। তিনি দরজার ফুটো দিয়ে ভেতরে সুপ্তির স্যান্ডেল দেখেন। স্যান্ডেল ভেতরে থাকলে দরজা বাইরে থেকে আটকাল কে? হঠাৎ মনে পড়ল সুপ্তির আংকেল ডাকা সেই লোকটির কথা। আমরা ফোন করে ভবনের ইনচার্জ আজিজ সাহেবকে বিষয়টি জানাই। এরপর ভবনের দারোয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াছ আসেন। পরে তিনি ও অপর একজন মহিলা দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে দেখেন পেছনের বেডরুমে সুপ্তি চিৎ হয়ে শুইয়ে আছেন। মহিলারা গায়ে হাত দিয়ে দেখেন তিনি মারা গেছেন।
সুপ্তির পিতা সাধন কুমার মল্লিক জানান, তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে সুপ্তি বড়। গত ১৩ আগস্ট সুপ্তির সাথে পটিয়ার বাসুদেব চৌধুরীর বিয়ে হয়। বাসুদেব জামালখানে একটি ওষুধের দোকানে চাকরি করে। বিয়ের পর সুপ্তিকে সে পটিয়ায় গ্রামের বাড়ি নিয়ে যায়। বিয়ের পর আমার মেয়ে জানতে পারে বাসুদেবের সাথে আরো কয়েকটা মেয়ের পরকীয়ার সম্পর্ক আছে। সুপ্তি এর প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্ন সময় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। মেয়ে বিষয়টি আমাকে জানালে আমি তাকে ধৈর্য ধরতে বলি। বিয়ের দশ দিন পর সুপ্তিকে তার স্বামী পানওয়ালাপাড়ায় নাসিমা মঞ্জিলের ৫৩ নং ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে বাসুদেবের বড় ভাই অনুপম চৌধুরী থাকতেন। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসুদেব আমার স্ত্রীকে ফোন করে বলে, সুপ্তির সাথে বিকাল চারটার দিকে তার কথা হয়েছিল। এরপর সে ফোন ধরছে না। আপনারা কেউ একজন পানওয়ালাপাড়ার বাসায় আসেন। এ কথা বলে ফোন কেটে দেয়। আমরা রাত আটটার দিকে পানওয়ালাপাড়ার বাসায় এসে খাটের উপর মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পাই। আমরা থাকাবস্থায় পুলিশ আসে।
তিনি বলেন, প্রতিবেশীদের কাছে যা শুনেছি, তাতে আমি নিশ্চিত বাসুদেব ও তার ভাই অনুপম মিলে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তৃতীয় কাউকে দিয়ে আমার মেয়েকে খুন করিয়েছে।
সুপ্তির ছোট ভাই প্রসেনজিৎ মল্লিক জানান, বিয়ের ১০ দিনের মাথায় সুপ্তি জানতে পারে, বাসুদেবের সাথে তার বড় ভাই অনুপমের শালীর সম্পর্ক ছিল। সুপ্তির সাথে কারও সম্পর্ক ছিল কিনা জানতে চাইলে প্রসেনজিৎ বলেন, আমার বোন রাঙামাটি কলেজে পড়ার সময় এক মুসলিম যুবকের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক দুই থেকে আড়াই বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। তবু বিষয়টি বিয়ের আগে বাসুদেবকে জানানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এতে তার কোনো আপত্তি নেই।
পিবিআই ইন্সপেক্টর সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, সুপ্তির বাবা ও ভাই যে মুসলিম ছেলের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল, সে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন সুপ্তি নিজেই। সেই ছেলেটিই হলো লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার বাহার উদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন। বাহার উদ্দিন সুপ্তির পিতার সাথে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেখান থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে জানাশোনা। কাপ্তাইয়ে বসবাসের সুবাদে ২০১৪ সালে সুপ্তির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে জাকিরকে বিয়ে করেন। তিন মাস সংসার করার পর সুপ্তি জাকিরকে ডিভোর্স দেন। ২০২০ সালের ১৪ আগস্ট বাসুদেবকে বিয়ে করার পর পুরনো প্রেম জেগে ওঠে। সুপ্তির স্বামী, ভাসুর এবং ভাসুরের স্ত্রী না থাকা অবস্থায় জাকির পানওয়ালাপাড়ার ফ্ল্যাটে আসতেন। সুপ্তি জাকিরের সাথে আলাদা একটি ফোন নম্বর থেকে যোগাযোগ করতেন।
মহানগর হাকিম শফিউদ্দিনের আদালতে জবানবন্দিতে গ্রেপ্তার জাকির বলেন, ঘটনার দিন তিনি ওই বাসায় আসেন। তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়। একসময় সুপ্তি তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাকিরকে জোরাজুরি করতে থাকেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে সুপ্তি তাকে চড় মারে। জাকির আর মেজাজ সামলাতে পারেননি। বিছানায় থাকা গামছা দিয়ে সুপ্তির গলায় প্যাঁচ দেন। সুপ্তি মারা গেলে সুপ্তির ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যান। সিম খুলে ফেলে দেন। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে নিজের মোবাইলের সিমও ফেলে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না।

এদিকে সুপ্তির পিতার করা মামলায় গত ৫ নভেম্বর থেকে সপ্তির স্বামী বাসুদেব ও ভাসুর অনুপম জেল খাটছেন। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের পর তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। তাদের কী হবে জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর সন্তোষ জানান, জাকির আদালতে জবানবন্দিতে বলেছে, সে একাই সুপ্তিকে খুন করেছে। আমরাও তদন্তে সুপ্তির স্বামী ও ভাসুরের কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। সে অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন দেব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটাকা ভাঙতি না পেয়ে দোকান ভাঙচুর
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাতের গাড়িতে হামলার অভিযোগ