কেটে গেছে নব্বই বছর

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | শনিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

অধিকাংশ নারী জানেন না যে, পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা একদিন মাতৃতান্ত্রিক ছিল। মায়েদের কর্তৃত্বে পরিচালিত হতো পরিবার ও সমাজ। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রথম পর্বে মায়েদের এ প্রভাব স্থায়ী ছিল বহু শত বছর।
ক্রমে গোত্র ও সমপ্রদায় যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ার ফলে পেশী শক্তির উত্থান হলো। এভাবে পুরুষদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়ে পুরো সমাজ চলে যায় তাদের আয়ত্ত্বে। সে প্রাধান্য ও আধিপত্য হাজার বছর ধরে অব্যাহত।
সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সমাজে এতটাই পাকাপোক্ত যে বর্তমান সময়ের কোন কোন নারীও স্মরণে, মননে এই মানসিকতায় পরিপুষ্ট। তারই উদাহরণ হয়ে গেলেন, রেইনট্রি মামলায় বিচারকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ১১ নভেম্বর এই মামলার ৫ আসামীর ৪ জনই ধর্ষণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া সত্ত্বেও আসামীদের সবাইকে মুক্তির আদেশদানের সাথে সাথে এই বিচারক পর্যবেক্ষণ দেন যে ৭২ ঘন্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই ৭২ ঘন্টা পর পুলিশ যেন কোন ধর্ষণ মামলা গ্রহণ না করে।
সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে যে-দেশে নারীরা নির্মম নির্যাতন সহ্য করেও মুখ খুলেনা, সেদেশে ৭২ ঘন্টা পর মামলা না নেওয়ার এমন মন্তব্য একদিকে যেমন ধর্ষকদের উৎসাহিত করে, তেমনি অন্যদিকে ভুক্তভোগী নারীদের নূন্যতম বিচারপ্রাপ্তির আশাকে আরও ক্ষীণতর করে তুলে।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজ পুরুষশাসিত বলে নারীরা অবহেলিত এবং নারীরা অবহেলিত বলেই তাদের এই পশ্চাৎপদতা। নারীর পশ্চাৎপদতার এই শেকল ভাঙতে পারে নারীই। সৌভাগ্যপ্রসূতভাবে কোন পুরুষ নারী স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হতে পারেন বা উন্নতির জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু এতে কখনোই নারী জাতির সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই যদি হতো তবে শত পর্দার পাহারায় থেকেও বেগম রোকেয়াকে কখনো নারী জাতির শমস-উল-উলামা হতে হতো না।
বেগম রোকেয়া রন্ধন গগনে শামসুন্নাহার, নজমুন্নাহারের ছড়াছড়ি দেখেছেন। আর এই ছড়াছড়ি সাহিত্য গগনে দেখার তীব্র মনোবাসনা তিনি পুষতেন হৃদয়ের চোরাকুঠুরিতে। কিন্তু একথা দুঃখজনক হলেও সত্যি বিভিন্ন বৈচিত্রপূর্ণ কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও সাহিত্যাঙ্গনে নারীর উপস্থিতি মাত্র হাতে গোনা। অভিজ্ঞতার অভাব, পারিবারিক ব্যস্ততা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূলতা, পারিবারিক অসম্মতি ইত্যাদি কারণে সাহিত্যে নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য নয়।
বেগম রোকেয়ার একটি লেখায় অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতকের নারীদের কাজের বিস্তৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপেন। হ্যাঁ আরও একশ বছর পেরিয়ে এলেও বাঙালি নারীর পায়ের চিহ্ন ঘরের বাইরে বেশিদূর যেতে পারেনি। অন্যান্য দেশের নারীরা যখন সফলতার সাথে মহাশূন্য অভিযান থেকে ফিরে আসছে তখন আমাদের দেশের কিছু শিক্ষিত পুরুষও চান তার অর্ধাঙ্গী যেন উচ্চশিক্ষিত না হয়। প্রথমত উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের শিক্ষা শেষ করতে গিয়ে বয়স বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত উচ্চ শিক্ষিত হলেই সে রোজগার করে সংসারের সচ্ছলতার সমধিকারী হতে চাইবে। তার চেয়ে বরং অর্ধাঙ্গীনিটি যদি হন ভালো কাপড় কাঁচুনি, ভালো রাঁধুনি তাতেই মঙ্গল।
সেই মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া তাঁর দুর্বলভূজা ভগিনীদের নিয়ে আরেকটি রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তাঁর সেই আহবানে সাড়া দেওয়া দূরে থাক, আমাদের অনেক ভগিনীর পক্ষে সে আহ্বানটুকু শোনারও সৌভাগ্য হয়নি। কেননা তারা সদাব্যস্ত থাকেন হয় সন্তানের কান্না থামানোতে নয়তো পতি দেবতার রসনা বিলাসে নানা ব্যঞ্জন সৃষ্টিতে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা নারীর এ মৌলিক কাজগুলো কখনোই সমাজ কতৃক স্বীকৃতি পায়নি। বরং নুন থেকে চুন খসলেই ঝরে পরে কিছু উত্তপ্ত বাক্য-‘কি কর শুনি সারাদিন? ঘরে বসে শুধু ছেলেমেয়ের দেখাশুনা আর চুলা ঘাটা বইতো নয়। সময়মত ভাতটা পর্যন্ত পাওয়া যায় না।’
তখনকার পরিস্থিতিতে ভাষ্য ছিল, শিক্ষিত হলেও মেয়েদের চাকরি করা বেমানান। সুতরাং কিছু লোকের চোখে নারী শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। আর এখনকার পরিস্থিতিতে ভাষ্যটাকে একটুখানি উল্টিয়ে দিলেই বলা যায়, মেয়েদের চাকরি করা সম্ভব কিন্তু সেই রোজগারের অন্নে যে বাবা-মা প্রতিপালিত হয়, সমাজে তাদেরকে দেখা হয় হেয় চোখে। চুরি, খুন, সন্ত্রাসী, ডাকাতি, রাহাজানি করে যোগাড় হওয়া অন্নে যতটুকু মর্যাদার গন্ধ থাকে, একটি মেয়ের রোজগারে যোগাড় হওয়া অন্নে সে মর্যাদার লেশমাত্রও থাকে না। স্বয়ং বাবা-মাও তাদের রোজগেরে মেয়েকে নিয়ে গর্ববোধ করার পরিবর্তে মেয়ের আয়ের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় বলে হীনম্মন্যতায় ভোগেন।
বেগম রোকেয়া তাঁর মতিচুর গ্রন্থের একাংশে উল্লেখ করেন ‘অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লানবদনে ক্ষমা করিয়া থাকে। কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্ত মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোন কল্পিত দোষ শতগুণ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ শিক্ষার ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শতকণ্ঠে বলিয়া থাকে স্ত্রী শিক্ষাকে নমস্কার।’
ভগিনীর সেই ব্যঙ্গার্থক নমস্কার বাঙালি সমাজে আজ আরও বেশি প্রদর্শিত। এই একবিংশ শতকে এসেও কোন মেয়ের উপর যখন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে অথবা নাম উঠে ধর্ষিতার খাতায়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে কানের কাছে মুখ লুকিয়ে সমস্বরেই বলে- ‘এক হাতে কি তালি বাজে, কি দরকার ছিল মেয়েদের এত পড়ানোর !’
তবুও প্রত্যাশা ভগিনী- তোমার ঘুম ভাঙুক। জয় হোক তোমার ন্যায্য অধিকারের। বুঝে নাও তুমি তোমার হিস্যা।
কবি ফারহানা ইসলাম রুহীর ভাষায়ই বলি-
‘আমি প্রশ্ন করি তাঁকে!
হে নারী !
তুমি কি দেবদূত?
কোত্থেকে পাও তুমি এমন কঠিন প্রেষণা?
নারী বলে উঠেন! আমি নিতান্তই সাধারণ মানবী!
চাই না শুনতে কারো অনুযোগ! কটু কথা !
না কোন খোঁটা, অবজ্ঞা, উপহাস আর তাচ্ছিল্যো ভরা আচরণ,
না বিবেকের দংশন!
যদিও বলে তবুও শুনি, সারাদিন বসে বসে করিটা কি? ’
বেগম রোকেয়ার প্রয়াণের পর কেটে গেছে আরো নব্বইটি বছর। এ নব্বই বছরে বাঙালি নারী সমাজ যেন ১৯৩২ সাল থেকেও আরও বেশ খানিকটা পশ্চাৎধাবন করেছে। এই বিভীষিকাময় সময়ে ভগিনী রোকেয়া মুক্তির প্রদীপ হাতে আমরা আর একবার তোমার অপেক্ষায়-
ভগিনী তোমার করুণ চরণখানি
হেরিনু আজি এ অরুণ কিরণরূপে
ভগিনী তোমার মরণ হরণ বাণী
নিরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসিক্সটিন ডেইজ অফ একটিভিজম: ‘অরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’