কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ড. মো. জামাল উদ্দিন | রবিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। আর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনসহ কৃষি বিভাগ/সংস্থাসমূহ বিভিন্ন রকম কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বাড়াতে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার নানামুখী কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমিগুলো আবাদযোগ্য করার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে এবং মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং করছে। উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিসের পক্ষ থেকে জমি অনাবাদি না রাখতে হাটহাজারীতে মাইকিং করতেও দেখা গেছে।

চট্টগ্রামে সরকারিবেসকারি প্রতিষ্ঠানের অনাবাদি জমিতে সবজি বাগান করার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। পাশাপাশি অনাবাদি জমিতে সবজি চাষের মাধ্যমে যারা অগ্রগতি দেখাবেন তাদের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, বন বিভাগ, সিভিল সার্জনসহ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে তাদের চত্বরের পতিত জমিতে সবজি চাষের জন্য নির্ধারিত টার্গেট দেওয়া হয়েছে। এটি নি:সন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমি পতিত না রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয়ও নির্দেশনা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১৮ মাসের জন্য ৪ শতাংশ সুদে কৃষকরা এ তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে ধান চাষ, মৎস্য চাষ, শাকসবজি, ফল ও ফুল চাষ, পোল্ট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্যও এ ঋণ নেয়া যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে। বৈশ্বিক সংকটে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এহেন পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক দিক।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম! এ অঞ্চলের কৃষি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, মহুরী, ফেনী, হালদা, সাংগু, মাতামুহুরী, বাকখালী ও ইছামতি নদী এ অঞ্চলের কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ। জাতীয় অর্থনীতিতে এ অঞ্চলের কৃষির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সীতাকুণ্ডের সীম, হাটহাজারীর পুতা বেগুন, হালদা মরিচ, দোহাজারীর আলু, চন্দনাইশের কাঞ্জননগর পেয়ারা, কালিপুরের লিচু, নোয়াখালী/লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন, মহেষখালীর পান, টেকনাফের সুপারিসহ মাছ, লবন ও সামুদ্রিক সম্পদ এ অঞ্চলকে করেছে আরো পরিচিত। স্থানীয় অতি জনপ্রিয় এসব ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কৃষককের আয় বাড়ানোরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কৃষির প্রতি রয়েছে মানুষের অসীম দরদ! কৃষির টেকসই উন্নয়নে ও এসডিজির লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনতে পারলে সুফল মিলবে বেশি। কৃষি বিভাগ ও কৃষি গবেষণাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভূমির বন্ধুরতা, সেচ সমস্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নগরায়নের ফলে কৃষি জমি কমে যাওয়া, কৃষি জমির মূল মালিকের অনুপস্থিতি বা এবসেন্টি ফামিং, শ্রমিক সংকট, মজুরী বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ বেশি, ফসলের পোকা ও রোগবালাইয়ের আক্রমন, অনাবাদি জমির আধিক্যতা, বাজার কাঠামোর দূর্বলতা ও সুষ্ট বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব এ অঞ্চলের কৃষির অন্যতম সমস্যা হলেও কৃষির অগ্রযাত্রা থেমে নেই।

অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনতে উপজেলাভিত্তিক কৃষক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনাবাদি বা আবাদযোগ্য বা অব্যবহৃত জমির পরিমান নির্ধারণ পূর্বক উক্ত জমিতে কী কী ফসল চাষ করা যেতে পারে তা ঠিক করা দরকার; স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে অনাবাদী জমির ম্যাপিং (জিআইএস ব্যবহার করে) করা; অনাবাদি জমির জন্য শস্য পঞ্জিকা প্রস্তুতকরণ ও ব্যাপক প্রচার করা; কৃষকদের এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়োজনীয় উপকরণ (বীজ/চারা, সার ও কৃষি যন্ত্রপাতি) সহায়তা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা ও চলমান রাখা দরকার। অনাবাদি জমিতে সম্ভাব্য উৎপাদন কত হতে পারে তা হিসাব করে এগোতে পারলে চাহিদা মাফিক উৎপাদন করা ও বাজারজাত সহজতর হবে। অনাবাদি জমি আবাদ বিষয়ক কৃষকদের উদ্ভুদ্ধকরণ কার্যক্রম, সরকারি নীতিমালা ও সহায়তার ব্যাপক প্রচারণা চালানো গেলে সুফল মিলবে অনেক বেশি।

অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনতে কৃষকদের মানসম্মত বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাভিত্তিক অনাবাদি জমিতে সুনির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি বিষয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোলা; অনাবাদী জায়গায় যে এলাকায় যে ফসল ভালো হবে তার বাণিজ্যিক চাষাবাদে উৎসাহ ও প্রণোদনা/ উপকরণ সহায়তা প্রদান; বাণিজ্যিক চাষাবাদে আগ্রহী কৃষকদের ব্যাংক লোন প্রদান এবং উক্ত লোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা; লাভজনক শস্য পর্যায় চিহ্নিতকরণ ও বিস্তার ঘটানো; লাভজনক নতুন শস্য পর্যায় প্রবর্তন করা (উদাহরণস্বরূপ, আমনসরিষাবোরো); এলাকার চাহিদা মাফিক ফসল উৎপাদন করা; ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো (এক ফসলকে দুফসলী, দুফসলকে তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করা); জলবায়ু সহনশীল ফসলের আরো জাত উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত জাতসমূহ দ্রুত কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানো; অনাবাদী জমিতে সেচের ব্যবস্থা করার জন্য খাল খনন করা, নিচু জমির পানি নিকাশের জন্য ড্রেনের বা স্লইচ গেট নির্মাণ করা; নিচু জমিতে বিজ্ঞানসম্মত ফসলের আবাদ করা; অনাবাদি উচুঁ এবং ঢালু বা টিলা জাতীয় ভূমিতে কলা, বরই, পেয়ারা, আম, ড্রাগন ফল, মাল্টাসহ অপ্রচলিত ফলের সাথে বিভিন্ন সব্জি আন্ত:ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে।

চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় শস্য বহুমুখীকরণ; শস্য বীমা চালু করা, উপযুক্ত ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরো বিস্তার করা; নগর কৃষি এবং ছাদ বাগানের অব্যবহৃত খালি জায়গাসমূহ পরিকল্পনামাফিক দ্রুত চাষাবাদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিনাসহ দেশের অন্যান্য গবেষণার বহু কৃষি প্রযুক্তি রয়েছে। অনাবাদি জমির জন্য কোনটি উপযুক্ত হতে পারে তা শনাক্ত করে অতিদ্রত বিস্তার ঘটানো দরকার। সর্বোপরি ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যায়ে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা সফল কৃষকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা গেলে তাঁদের উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। উপরোক্ত কাজগুলো সঠিকভাবে করতে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ/সংস্থাসমূহে জনবল বৃদ্ধিসহ সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। পরিশেষে, সম্মিলিত সবার প্রচেষ্ঠার মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এ অঞ্চলের কৃষির জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে, খাদ্য উৎপাদন বাড়বে এবং বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব মোকাবিলা করা সহজতর হবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা , আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে ড. এফ দীপংকর মহাথেরোর একক সদ্ধর্মদেশনা