কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৪ মার্চ, ২০২২ at ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হোক

নদী দূষণ ঠেকাতে কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘একটি বিষয়ে নজর রাখতে হবে- কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্‌গু নদীগুলোর যেন দূষণ না হয়। তিনি বলেন, কর্ণফুলীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।’
কারখানার বর্জে দেশের অধিকাংশ নদী দূষিত হচ্ছে, একথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন অনেক শিল্প কল-কারখানা হচ্ছে। প্রত্যেক শিল্প কারখানায় অবশ্যই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কর্ণফুলী নদী যেন কোনোভাবে দূষিত না হয়, সে ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। সাথে অন্য নদীগুলোরও সুরক্ষা দিতে হবে।’
কর্ণফুলী নদী নিয়ে চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা লিখতে লিখতে, পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করতে করতে এখন ক্লান্ত। এই নদীর দূষণ ও দখলরোধে কার্যত কেউ-ই কিছু করল না। এখন প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার টন তরল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী; যা কর্ণফুলীর সঙ্গে যুক্ত হালদা নদীতেও ছড়িয়ে পড়ে। আরও চার বছর এই হারে চলতে থাকলে দুই নদীর দূষণ চরম আকার ধারণ করবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। ২০১৯ সালে ‘চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণ রোধ, নাব্যতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ দখল রোধকল্পে প্রণীত খসড়া মহাপরিকল্পনা’ অনুসারে নগরীতে ৫০ হাজার স্যানিটারি এবং ২৪ হাজার কাঁচা শৌচাগার আছে। স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় যার প্রায় সব পয়ঃবর্জ্য নালা ও খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ে। সঙ্গে কিছু গৃহস্থালি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যেরও শেষ গন্তব্য কর্ণফুলী।
এই নদী এখন মরে যাচ্ছে দেখার কেউ নেই। একটি শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষের পয়ঃবর্জ্য পতিত হচ্ছে শহরের প্রাণ এবং দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা নদীটিতে তা জেনে যেকোনো সভ্য ও আধুনিক দেশের মানুষ বিস্মিত না হয়ে পারেন না। এই পর্যন্ত এই বাস্তবতা বিরাজ করলেও কেউ এ বিষয়ে কথা বলেননি। বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামে কোনো স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই জেনে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনিই চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীনে ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার -২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবারও তিনি উল্লেখ করেন, ‘চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য প্রকল্প নিয়েছি। ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টারপ্ল্যান করেছি। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশনের প্রথম পর্যায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরও পাঁচটি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার হবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও নির্দেশে ২০১৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম নগরীর ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মহাপরিকল্পনায় পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে ভাগ করে ছয়টি পয়ঃশোধনাগার এবং দুটি ফিকাল স্লাজ শোধনাগার স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প (১ম পর্যায়)’র পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করছে সরকার। ইতিমধ্যে কাজ অনেকদূর গড়িয়েছে। সে শিল্পাঞ্চলে প্রচুর মিঠা পানির প্রয়োজন হবে। সে পানির চাহিদা মেটাতে হালদা নদী থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের একটি প্রস্তাব আছে।
আমি জানি না সে প্রস্তাবের পেছনে কারা আছেন এবং কোন যুক্তিতে তারা হালদার মতো একটি বিশেষ নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহের প্রস্তাব করেছেন। এ বিষয়ে হালদা নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিজ্ঞানীদের কোনোরূপ মতামত নেওয়া হয়েছে কি না জানি না তবে আমি খুব সাধারণ ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানে মনে করি এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ও বিপর্যয়কর হবে পরিবেশ ও প্রাণিবৈচিত্রের ক্ষেত্রে। কারণ হালদা নদী বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র। এ নদী আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। এরপরও বিগত বছরগুলোতে এ নদীর যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়েছে। নদীর উৎসে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, নদীর অনেক বাঁক কেটে সোজা করা হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং মেশিনের মাধ্যমে নদীর বালু তোলা হচ্ছে, নদীতে যন্ত্রচালিত নৌযান চালিয়ে নদীর পানিদূষণ করা ছাড়াও শব্দদূষণ করে মা মাছের ক্ষতি করা হচ্ছে আর এইসবের সঙ্গে কারখানার বর্জ্য মিলে নদীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। আবার এই সময়ে হালদা থেকে মীরসরাইয়ের অর্থনৈতিক জোন বা যেকোনো স্থানে হালদার পানি সরবরাহের মতো ঘটনা নদীর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো হবে।
মিরসরাইয়ে পানির ব্যবস্থা কীভাবে হবে তা আমার পূর্বের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছি। আজ আবার লেখার আগে সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটি অংশের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সেদিন তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটা কথা বলতে চাই, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে। এটা একান্তভাবে দরকার। হাউজিং সোসাইটি ও শিল্প কারখানায় জলাধার যেন থাকে। বর্ষার পানি সংরক্ষণে নজর দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী সমস্যার সঠিক সমাধান দিয়েছেন। পানির জন্য হাহাকার না করে আমরা জলাধার তৈরি করে বর্ষার পানি ধরে রেখে তা ব্যবহার করতে পারি। তাতে আমরা অনেকভাবে লাভবান হবো। জলাধার তৈরি হলে গ্রাম-শহরে বন্যার প্রকোপ কমবে। জলাধারের কারণে মাছের আবাদ বৃদ্ধি পাবে এবং জলাধারের কারণে ভূপৃষ্ঠও শীতল থাকবে। এর ফলে ভূগর্ভে পানি বৃদ্ধি পাবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শের সঙ্গে আমার প্রস্তাবটি যোগ করে দিয়ে বলতে চাই, সীতাকুণ্ড থেকে মিরসরাইয়ের শেষ পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় জলাধার তৈরির পরিকল্পনা নিলে মিরসরাইয়ের শিল্পাঞ্চলের পানির চাহিদা সহজে মেটানো যাবে। এমন উদ্যোগ নিলে সেসব বিশাল এলাকা বেদখলমুক্ত তো হবেই সে সঙ্গে তা পর্যটন এলাকা হিসেবেও গড়ে উঠবে। এর দ্বারা ভূগর্ভেও পানি বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের অদূরদর্শীতার কারণে এখন ভূগর্ভে পানির আধার সংকুচিত হয়ে আসছে, স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। গ্রামের অনেক টিউবওয়েলে এখন পানি ওঠে না। বর্ষা মওসুম যেতে না যেতে অসংখ্য পুকুরও শুকিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরপর দেশে ইরি ধানের চাষ বৃদ্ধি পায়। শুষ্ক মওসুমে তাই ধানখেতে পানির জন্য সারা দেশে রাতারাতি অসংখ্য ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শহর এলাকায় পানির চাহিদা মেটাতে ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবহার। শহরে প্রায় বাড়িতে ডিপ টিউবওয়েল আছে। এই প্রবণতা আজকাল গ্রামেও চালু হয়েছে। অনেক পরিবার এখন পুকুর ব্যবহার করে না। ডিপ টিউবওয়েলের পানিতে আধুনিক শৌচাগার ব্যবহার করে। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখি, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম হচ্ছে, সেখানে পরিবেশবাদী থেকে শুরু করে সচেতন ব্যক্তিরা আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন কিন্তু বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ তিনি এ বিষয়েও সতর্ক করেছেন। একই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায়। তাই ভূগর্ভস্থ পানি যেন না কমে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা হয়তো বাইরে থেকে দেখা যায় না, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করতে পারে।’
অনেক বছর ধরে দেশের সচেতন মহল এই কথাগুলোই বলে এসেছেন। আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেও সেসব বিষয়ে বললেন। এতদিন এমন সুপারিশ উপেক্ষিত হলেও আজ তা উপেক্ষা করার উপায় নেই। একজন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করার দুঃসাহস নিশ্চয়ই করবে না কেউ। এই আশায় বুক বাঁধি।
লেখক : কবি- সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার স্বাধীনতা আমার পতাকা
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম