কাদায় চাপা কৃষকের আশা

সোনাকানিয়ায় অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কাটার ঘটনা চলছে বসত হারানো মানুষের আহাজারি ১০ কোটি টাকার ক্ষতি, দাবি উপজেলা প্রশাসনের

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া | মঙ্গলবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

সাতকানিয়ার সোনাকানিয়ায় এখনো চলছে বসত হারানো মানুষের আর্তনাদ। পানিতে তলিয়ে যাওয়া রোপা বোরো ও মৌসুমী শাকসবজির সাথে কৃষকের বুক ভরা স্বপ্নও কাদামাটির আস্তরণের নিচে চাপা পড়েছে। বাঁধ কাটার পর পানির স্রোতে স্লুইচ গেইট ভেঙে যাওয়ায় অনেক রোপা বোরো ও গম খেত শুকিয়ে যাবে।

স্থানীয়রা বলছেন, মাথা গোঁজাবার ঠাঁই হারিয়ে কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, আবার কেউ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন যাপন করছে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এদিকে, বন বিভাগ অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ কাটার ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

উল্লেখ্য, গত শনিবার রাতে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ও লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া হরিদা ঘোনা এলাকায় সোনাইছড়ি খালের মুখে অবৈধভাবে দেয়া বাঁধ বন বিভাগ অপরিকল্পিতভাবে কেটে দেয়ার পর পানিতে তলিয়ে যায় সোনাকানিয়ার বেশির ভাগ এলাকা। বিশেষ করে সাইরতলী, আচারতলী, কালা মিয়ার পাড়া, দ্বীপের কূল, কুতুব পাড়া ও মঙ্গল চাঁদ পাড়া এলাকার বেশির ভাগ মানুষের বসত ঘরে গভীর রাতে পানি প্রবেশ করেছে। এসময় সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৫৬টি বসত ঘর। এছাড়াও শতাধিক বসত ঘর আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বসত ঘরে রাতের অন্ধকারে হঠৎ পানি প্রবেশ করায় সব কিছু ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবারের। চুলা ভিজে যাওয়ায় তলিয়ে যাওয়া এলাকার অনেক পরিবারে গতকালও খাবার তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে, পানির স্রোতে ভেঙে গেছে ছোটহাতিয়া কালা মিয়ার পাড়ায় সোনাইছড়ি খালে থাকা স্লুইচ গেইট। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কাদামাটির আস্তরণের নিচে চাপা পড়েছে রোপা বোরো, মরিচ, আলু, বেগুনসহ মৌসুমী শাক সবজির খেত। সাইরতলী এলাকার কৃষক জহির আহমদ জানান, আমি ১ কানি জমিতে আলু, ১০ গণ্ডা জমিতে মরিচ ও ১৫ গণ্ডায় বেগুন খেত করেছিলাম। সবগুলো খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। খেতের উপর এখন কাদামাটির আস্তরণ। এ মুহূর্তে খেতের কিছুই অবশিষ্ট নাই। চারা থাকলে এসব জমিতে বোরো চাষ করতে পারতাম। কিন্তু এখন বীজতলায় কোনো চারা নাই। এদিকে, ৩ কানি জমিতে বোরোর চারা লাগিয়েছিলাম। সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। তিনি আরো জানান, আমার কৃষি নির্ভরশীল পরিবার। আলু, মরিচ, বেগুন ও রোপা বোরো সব নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটাবো বুঝতে পারছিনা।

একই এলাকার কৃষক আবদুল কাদের জানান, মুরব্বিদের মুখে শোনা অনুযায়ী বিগত ১ শত বছরের মধ্যে আমাদের এলাকায় বর্ষাকালেও পানি উঠেনি। শুধুমাত্র বন বিভাগের কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের কারণে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার দেড় কানি জমির আলু, ১ কানির মরিচ ও ১০ গণ্ডার বেগুন খেত সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এমন লোকসান পুষিয়ে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। সরকারি ভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা না করলে স্ত্রীসন্তান নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

সোনাইছড়ি খালের পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিঃ এর সভাপতি শামসুল আলম জানান, অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ কেটে দেয়ায় আমরা দুই ধরনের সমস্যায় পড়েছি। এক দিকে পানিতে তলিয়ে যাওয়া রোপা বোরো, আলু, মরিচ ও বেগুনসহ কিছু খেত কাদামাটির আস্তরনের নিচে চাপা পড়েছে। আবার অন্যদিকে স্লুইচ গেইট ভেঙে যাওয়ায় অবশিষ্ট থাকা রোপা বোরো ও গমসহ অনেক খেত পানির অভাবে শুকিয়ে মরবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভেঙে যাওয়া স্লুইচ গেইট এলাকায় খালের উপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে না পারলে শত শত একর বোরো খেত শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।

এদিকে, বসত ঘর হারানো সাইরতলীর জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, ছোট্ট একটি গুদাম ঘরে সন্তানদের নিয়ে দিন কাটাতাম। শনিবার রাতে হঠাৎ পানি প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর তা ভেঙে গেছে। মাটির নিচে চাপা পড়েছে ঘরের সব জিনিসপত্র। খাবারের প্লেইট, হাড়িপাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু এখন মাটির নিচে চলে যায়। ছেলেদের সাথে নিয়ে মাটি সরিয়ে কিছু জিনিস বের করেছি। অধিকাংশ জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে।

আচারতলীর শফিকুর রহমান জানান, আমি অনেকদিন ধরে পঙ্গু। ঘরে বসে দিন কাটায়। এখন ঘরটিও ভেঙ্গে গেছে। এ মুহূর্তে ঘর বাঁধার মতো সম্বল আমার নাই। মাথা গোঁজাবার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে আমি এখন পথের ফকির হয়ে গেছি।

সাতকানিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোঃ কামরুল হোসাইন জানান, সোনাইছড়ি খালের মুখে অবৈধ ভাবে দেয়া বাঁধ কাটার ফলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকায় কৃষি খাতে ৫২ লাখ ৬ হাজার টাকা, প্রাণী সম্পদ খাতে ৫২ লাখ ৬ হাজার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ খাতে ১ কোটি ৮৬ লাখ, মৎস্য খাতে ৩ লাখ ৫০ হাজার, এলজিইডির রাস্তা, অবকাঠামো ও ব্রীজের ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস জানান, আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট পাঠিয়েছি। বিশেষ করে বসত ঘর হারানো মানুষ গুলোর জন্য টিন বরাদ্দ চেয়ছি। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে প্রনোদণা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৩ মেট্রিক টন চাউল ও ২০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেষ সময়ের প্রচারণায় প্রার্থীরা
পরবর্তী নিবন্ধনতুন অণু আবিষ্কার, মানবদেহে দ্রুত বাড়াবে শ্বেতকণিকা