কর্ণফুলী পেপার মিল, দ্রব্যমূল্যের কষাঘাত এবং কর্পোরেট পুঁজি

জসীম চৌধুরী সবুজ | রবিবার , ২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের জন্য নয় তা তখনই এ অঞ্চলের মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করছিল। তাদের শোষণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করে মাঠেময়দানে চষে বেড়িয়েছেন এর সপক্ষে জনমত গঠনে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামে একটি পোস্টার বের করে। সাদামাটা এই পোস্টারে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানে জিনিষপত্রের দামের তফাৎ তুলে ধরা হয়েছিল গ্রাফ আকারে। সেই পোস্টারে একটি বিষয় ছিল চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিল প্রসঙ্গে। আমাদের এখানে উৎপাদিত কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে সেখানে বিক্রি করা হত প্রতি দিস্তা চার আনায়, আর আমাদের এখানে বিক্রি হত প্রতি দিস্তা আট আনা। আমাদের মত সারাদেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে অন্য বিষয়ের চেয়ে এটি বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে সময় স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সিলেবাসে ছিল একটি প্রশ্ন এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাগজকল কোনটি এবং কোথায় অবস্থিত? জবাব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিল।

এই পেপার মিল নিয়ে বাঙালির আবেগ জড়িত। ছয়দফা এবং তারই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটি অধ্যায় কর্ণফুলী পেপার মিল। এটি একটি বৃহদাকার শিল্প প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। পাশাপাশি অবস্থিত কর্ণফুলী রেয়ন মিলের অবস্থাও একই। রেয়ন মিলটি পেপার মিলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন ( পিআইডিসি) চন্দ্রঘোনায় ৪৪২ একর জমির উপর মিল দুটি প্রতিষ্ঠা করে। মূলত প্রধান কাঁচামাল বাঁশের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে চন্দ্রঘোনাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে পেপার মিল উৎপাদনে যায়। কিছুদিন পর দুটি মিলই নামমাত্র মূল্যে তুলে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দাউদ গ্রুপের হাতে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পরিত্যক্ত মিল দুটি জাতীয়করণ করা হয়। কর্ণফুলী পেপার মিলে লেখার কাগজ, ছাপা ও মূদ্রণের কাগজ, মোমের প্রলেপযুক্ত কাগজ, করোগেটেড বোর্ড উৎপাদিত হত। একসময় দেশের কাগজের চাহিদার প্রায় অর্ধেকই যোগান দিত কর্ণফুলী। কালের পরিক্রমায় মিলটির সময়োপযোগী আধুনিকায়ন যেমন হয়নি তেমনি নানা ধরনের অনিয়মদুর্নীতি মিলটিতে বাসা বাঁধায় তা ক্রমেই রুগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিনত হতে থাকে। কাগজ তৈরি হয় বাঁশ ও পাল্পউডের মণ্ড দিয়ে। ২০১৭ সালে বাঁশকাঠের দুষ্প্রাপ্যতার অজুহাতে মণ্ড তৈরির প্ল্যান্টটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিদেশ থেকে মণ্ড আমদানি করে কাগজ উৎপাদনের। কিন্তু মিলটির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) মণ্ড আমদানিতে সফল হতে পারেনি। কার্যত সেই থেকে কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধ রয়েছে। এর যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে ভবনশেডে জং ধরেছে।

সরকারি এই মিলটি বন্ধ থাকলেও বেসরকারি মালিকানায় স্থাপিত পেপার মিলগুলির উৎপাদন ও ব্যবসা এই সময়ে রমরমা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজের বাজারে বড় একটি শিল্প গ্রুপের আাধিপত্য কায়েম হওয়ায় বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকাচট্টগ্রামে যে বইমেলা হয়ে গেল সেখানে আগের বারের চেয়ে অনেক কম বই প্রকাশিত হয়েছে। কাগজের দাম দ্বিগুনেরও বেশি বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশকমুদ্রকরা সঙ্কটে পড়েছেন। বই যা বের হয়েছে তার গড় খরচ বেশি পড়ায় বইয়ের গড় মূল্যও বেড়ে গেছে। উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করতে পারেন নি। মুদ্রণ শিল্প এলাকায় হাঁটাহাঁটি করলে এ নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। বেসরকারি মিল বা গ্রুপকে কাগজের বাজারে মনোপলি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে দিতেই কর্ণফুলী পেপার মিলকে অকেজো করে রাখার কথাও আলোচিত হয়। আবার রুগ্নশিল্প দেখিয়ে মিলটি হাতিয়ে নেওয়ার নেপথ্য তৎপরতার কথাও শোনা যায়।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন কয়েকদিন আগে কর্ণফুলী পেপার মিল পরিদর্শন করে গেছেন। তাঁর সাথে মন্ত্রণালয় এবং বিসিআইসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন। মন্ত্রী আমাদের আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, কর্ণফুলী পেপার মিল আবার ঘুরে দাঁড়াবে। দেশের মানুষের প্রত্যাশাও সেটি। লেখার কাগজ ও মুদ্রণের কাগজ দুটির অগ্নিমূল্যের কারণে শিক্ষার্থীরা গভীর সঙ্কটে। এ কারণে এবার স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের বই মুদ্রণ নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে। নিম্নমানের কাগজে ছাপা হয়েছে অধিকাংশ বই। সরকারি খাতের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধ থাকা মানে কাগজের বাজারে বড় কর্পোরেট গোষ্ঠীর মনোপলি আরও জোরদার হওয়া। কিছুদিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন, বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলির ব্যবসার পরিধি বড়তেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তাদের চালডাল, মুড়িমুড়কি ইত্যাদি ব্যবসায়ও যুক্ত হওয়াটাকে তিনি ইতিবাচক না বলে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলেছেন। এতে করে ক্ষুদ্রপুঁজির ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্যে হচ্ছেন।

ভোক্তা সাধারণ কর্পোরেট পূুজির হাতে কিভাবে জিম্মি হয় তা আমরা এলএনজি গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রেও লক্ষ করছি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ( বিইআরসি) প্রতিমাসে শুনানি করে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সেই মূল্য কেউ মানে না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১শথেকে ২শটাকা পর্যন্ত বেশি মূল্যে বাজারে বিক্রি হয় গ্যাস সিলিন্ডার। ডিলারদের বক্তব্য মিল মালিকরা সরকার নির্ধারিত মূল্য মানেন না। ডিলারদের কাছ থেকে বেশি মূল্য আদায় করে। যে কারণে বেশি মূল্যে তাদের বিক্রি করতে হয়। কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে প্রায় একযুগের বেশি হবে। এর আগে সংযোগ যখন চালু ছিল তখন গ্যাস কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা ডিমান্ড নোটের বিপরীতে অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক শকোটি টাকা নিয়ে সে টাকার লভ্যাংশ ভোগ করছে কর্ণফুলী গ্যাস। সেই টাকায় জিইসি মোড়ে জমিও কিনেছে। কিন্তু সেই আবাসিক গ্রাহকরা না টাকা ফেরত পেয়েছেন, না পেয়েছেন গ্যাস সংযোগ। চট্টগ্রামে আগে বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস আসত। এখন উত্তোলন কমে যাওয়ায় পাইপ লাইনে আর ফিল্ডের গ্যাস আসে না। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল থেকে সাগরের তলদেশে স্থাপিত গ্যাস লাইনে তা এনে সরবরাহ করা হয় বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকদের। দাবি উঠেছিল এলএনজিই যখন সরবরাহ হবে তখন বাসা বাড়িতে সংযোগ দিতে আপত্তি কেন? পাশাপাশি বাস করে এখন নগরীতে যাদের প্রিপেইড মিটার আছে তাদের খরচ হচ্ছে মাসে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, যারা মাসিক বিল দিচ্ছেন তাদের খরচ হচ্ছে ৯০০ টাকা, আর যারা সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন তাদের খরচ হচ্ছে মাসে ৩ হাজার টাকার মত ( মাসে দুটি সিলিন্ডারের হিসাব ধরে)। এত বৈষম্য কেন? বাজারে গেলেই শোনা যায় এবং কর্ণফুলী গ্যাস সংশ্লিষ্টদের অনেকের ভাষ্যমতে এখানেও কর্পোরেট পূঁজি থাবা বিস্তার করেছে। এলএনজি গ্যাস পাইপ লাইনে বাসাবাড়িতে সরবরাহের উদ্যোগ একাধিকবার নিলেও বেসরকারি গ্যাস সিলিন্ডার কোম্পানিগুলোর বাধায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আগামীতেও হবে এ রকম আশার বাণী শোনাতে পারছেন না কোন মহল। দেশের ভোক্তা সাধারণ এখন কর্পোরেট পূঁজির খেয়ালখুশির কাছে অনেকটা অসহায় জিম্মি। সাধারণ শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টির অন্যতম ভরসা ফার্মের মুরগি এবং ডিম নিয়ে যে খেলা চলছে তা কোথায় গিয়ে ঠেকে এ নিয়ে গভীর শঙ্কায় ভোক্তারা। বিভিন্ন বাজারমার্কেটে সরকারের একাধিক দপ্তর নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্য বন্ধের কোন পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। যে কারণে বাজার পরিস্থিতি ক্রমশই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের নিষ্ঠুর কষাগাতে জর্জরিত মানুষের সংসার যে আর এভাবে চলছে না।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এবং মায়াকানন
পরবর্তী নিবন্ধবৃষ্টি আইনে কলকাতাকে হারালো পাঞ্জাব