কর্ণফুলী নিয়ে ভয়াবহ তথ্য

মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত দূষণের জন্য দায়ী ৮৯টি উৎস ও ৩০টি কারণ চিহ্নিত ।। দূষণ রোধ না হলে হরিয়ে যাবে ১৪৪ প্রজাতির উদ্ভিদ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঝুঁকিতে ডলফিনও পরিকল্পিত দীঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বন শিমুল, হলুদ কৃষ্ণচূড়া, ফুলিবেত, কালমেঘ, কাঁটা বিশাল্লা, গঙ্গাতারা, উপকালিস, ছোট ছাতিম, ইছারমূল, অনন্ত মূল ও বেগুনি আমড়াসহ দেশের ৮১টি বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে। তবে শঙ্কার কথা, কর্ণফুলীর ভয়াবহ দূষণের প্রভাবে হারিয়ে যেতে পারে এসব উদ্ভিদ। একই দূষণের কারণে কর্ণফুলীর দুই তীরের অশোক, কুরুজ, শ্যমলতা, চীনালতা, খনা, বরুণ, ফুল ঝুমরি, কালিলতা, গোল তকমা ও ডুলি জবাসহ আরো ৬৩ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হতে পারে। অর্থাৎ কর্ণফুলীর দূষণ রোধ না হলে এ ১৪৪ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে যাবে।
কর্ণফুলী নদীর প্রাণ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণের কারণ নির্ণয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। এতে কর্ণফুলীর বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত দূষণের জন্য দায়ী ৮৯টি উৎস ও ৩০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত দূষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সাতটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নদীতে নির্গত বর্জ্যে মানবদেহ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। তাই দূষণ বন্ধ না হলে উদ্ভিদের পাশাপাশি ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্তির শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে দৈনন্দিন কাজে কর্ণফুলীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর ওপর চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণাকর্মটির নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। ইকোর সভাপতি মো. সরওয়ার আলম চৌধুরী মনি, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহেদ মুরাদ সাকু ও এস এম আবু ইউসুফ সোহেলের সহযোগিতায় গবেষণার সহযোগী নেতৃত্বে ছিলেন ইকোর সায়েন্টিফিক অফিসার ও চবি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, মো. আরিফ হোসাইন, সনাতন চন্দ্র বর্মণ, মো. মোস্তাকিম ও মো. ইকরামুল হাসান। গতকাল গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ঝুঁকিতে ডলফিনও : গবেষণা চলাকালীন শিকলবাহা চ্যানেলে ৩৭, বোয়ালখালী চ্যানেলে ২০ এবং অন্যান্য স্থানে সাতটিসহ ৬৪টি ডলফিনের দেখা মিলেছে। কিন্তু মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত অসংখ্য নৌযান নোঙর করে রাখায় নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা এবং ডলফিনসহ জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আধিক্য থাকা বোয়ালখালী ও শিকলবাহা দূষণ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে এবং এতে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হবে ডলফিন।
ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য : ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, নদীর দুই কূলে অবস্থিত মোট সাতটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নদীতে নির্গত বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করে ল্যাবে বিশ্লেষণ করে মানবদেহ ও প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। এগুলোর মধ্যে অত্যধিক ক্ষারকীয় দ্রবণ, দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য উল্লেখযোগ্য। মোহনা থেকে কালুরঘাটের একটু পর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূষণ, নদী দখল, বর্জ্য পদার্থ ও শহরের ড্রেনের দূষিত পানির মিশ্রণ দেখা গেছে, যার কারণে এই এলাকায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অনেক কম। যেগুলো এখনো টিকে আছে, যদি দূষণসহ দখল বন্ধ না হয় তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রজাতিগুলো হারিয়ে যাবে।
কর্ণফুলীর উদ্ভিদ বৈচিত্র্য : গবেষণায় কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত নদীর পাশে মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে, যা ৩৭৩টি গণভুক্ত এবং ১১৩টি পরিবারের অন্তর্গত। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ১৪৪ প্রজাতির, গুল্ম ৬৯ প্রজাতির, লতা ৫৮ প্রজাতির, বীরুৎ ২৪৪ প্রজাতির এবং পরজীবী বা পরগাছা ১৩ প্রজাতির। শনাক্তকৃত প্রজাতির মাঝে একটি নগ্নবীজী উদ্ভিদ, ৯টি মসগোত্রীয় এবং ২৭টি ফার্ন প্রজাতি রয়েছে। একবীজপত্রী উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে ১১২ প্রজাতি আর দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে ৩৭৯ প্রজাতির।
নদীর মাঝখানে অবস্থিত বাকলিয়া চরে ১৫৫ এবং সবচেয়ে দূষিত এলাকায় (বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে কালুরঘাটের পর পর্যন্ত) পাওয়া গেছে মোট ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ। শনাক্তকৃত গাছের মধ্যে সর্বমোট ৩৫৫টি ঔষধি উদ্ভিদ রয়েছে।
দূষণের ৩০ কারণ : বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত দূষণের ৮৯ উৎসের মধ্যে ৫৩টি শিল্পকারখানা, ১৪টি নৌযান মেরামতের জায়গাসহ বাজার, নালা, খামার, শুঁটকি পল্লী রয়েছে। অবশ্য এর অধিকাংশ মোহনা থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত জায়গায় অবস্থিত। উৎসগুলোর মধ্যে ৭৫টি করে পানি ও বায়ু, ৪০টি মাটি, চারটি শব্দ, ১৮টি তাপীয়, পাঁচটি ধূলি, ১৮টি ভারী ধাতু, ১৫টি প্লাস্টিক এবং ১০টি ভূমিক্ষয়ের জন্য দায়ী।
কর্ণফুলী নদীতে ৮৫টি মার্চেন্ট জাহাজ, ৪০৫টি কোস্টাল জাহাজ, ২৬৪টি মাছ ধরার ট্রলার ও ৯টি টাগ নৌকা, ৯টিসহ বিদেশি জাহাজ ও ট্রলার, সাম্পান, ছোট ছোট নৌকা চলাচল করে। এ সমস্ত নৌযানের ময়লা, পোড়া তেল ইত্যাদি নদীতে সরাসরি ফেলায় নদী দূষিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রাথমিকভাবে শনাক্ত দূষণের ৩০ কারণ হচ্ছে, নগরের বর্জ্য বিভিন্ন নালা দিয়ে সরাসরি নদীর পানিতে মেশা, শুঁটকি তৈরির সময় ব্যবহার করা রাসায়নিক উপাদান (সবিক্রন-৪২৫ ইসি), নদীতীরে পোড়া তেলের ব্যবসা, জাহাজ মেরামত কারখানা থেকে সৃষ্ট উপজাত যেমন পুরনো রং ও মরিচা, অপচনশীল ভাসমান প্লাস্টিক, নদীপাড়ের খোলা শৌচাগার, বাঁধ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, কসাইখানার বর্জ্য, মৃত পশু-পাখি সরাসরি পানিতে নিক্ষেপ, বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা, নৌযান থেকে ফেলা পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্য যেমন খাবারের প্যাকেট, টিস্যু, নৌ দুর্ঘটনার কারণে তেল নির্গমন, অপ্রয়োজনীয় ও নষ্ট মালামাল নদীতে ফেলা, তৈজসপত্র ও কাপড় নদীর পানিতে ধোয়া, নৌকা ও জাহাজ নদীতে পরিষ্কার করা, কৃষি জমি থেকে সার ও কীটনাশক নদীর পানিতে মিশে যাওয়া, নদীতীরে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, নৌকা ও জাহাজ থেকে তেল নদীর পানিতে এসে পড়া, সিমেন্ট কারখানা ও নির্মাণাধীন এলাকা থেকে বালি ও অন্যান্য উপাদান পানির সাথে মিশ্রিত হওয়া, খাদ্য উপজাত কোনো দ্রব্য পানিতে ফেলে দেওয়া, বাণিজ্য উপজাত দ্রব্যসামগ্রী সরাসরি নদীতে ফেলা, রান্নাঘরের ও গৃহস্থালির বর্জ্য সরাসরি নদীতে নিক্ষেপ করা, খামার থেকে পশু খাদ্য ও পশু বর্জ্য নদীর পানিতে ফেলে দেওয়া। এছাড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রং, লবণ ও কাগজ কারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য, নদীতীরে ইটভাটা ও অবৈধ স্থাপনাকে দূষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
দূষণ রোধে সুপারিশ : দূষণ রোধ ও নদীর পরিবেশ ঠিক রাখতে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে গবেষকদল। এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, দূষণ রোধে কঠোর ও পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া নদী দখল বন্ধ করার পাশাপাশি সকল কলকারখানায় সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পলিথিন ও অন্যান্য সামগ্রী নদীতে না ফেলতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বর্জ্যে যাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান না থাকে এবং নৌযান নোঙর যত কম করা যায় তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। নদীর তীরে অপরিকল্পিত বসবাস ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা, নালার দূষিত পানি শোধন করে নদীতে নির্গত করার ব্যবস্থা করা, নদী ভাঙন রোধে উদ্ভিদ লাগানো এবং পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোবাইল চুরি থেকে বিরোধ শ্যালকের হাত কেটে নিল দুলাভাই
পরবর্তী নিবন্ধএই প্রকল্প অন্যত্র সরানো যাবে না