বাঙালি উৎসবপ্রবণ জাতি। প্রবচনে আছে ‘বাঙালির বার মাসে তের পার্বণ’। বরাবরের মত বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ-১৪২৮ উপস্থিত হয়েছে। নতুন সময় আবাহনে বিশ্বকবির প্রত্যাশা ‘মুছে যাক গ্লানি গুচে যাক জরা’। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী এবং উগ্র মৌলবাদীদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের প্রার্থিত পহেলা বৈশাখ এবার গ্লানি-জরাযুক্ত। তবুও এই দুঃসময় উৎরিয়ে সুস্থ ও প্রাণময় সময়ের প্রত্যাশায় আমরা বুক বাঁধি।
ইতিহাসবিদের মতে, বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক সম্রাট আকবর। মূলত খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তিনি বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সে সময় কৃষকশ্রেণির কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী, আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী সৌরসন এবং হিজরী সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের প্রচলন করেন এবং সেই সাথে তিনি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা বারো মাসের নামকরণও করেন। বৈশাখ নামটিও এসেছে ‘বিশাখা’ নামক নক্ষত্রের নামানুসারে। হিজরী ৯৬৩ থেকে বাংলা সন চালু হয়। উল্লেখ্য, ইংরেজি দিনপঞ্জিকার সাথে মিল রেখে বাংলা সাপ্তাহিক দিনের নামকরণও করা হয়।
পহেলা বৈশাখে হালখাতা মূলত ব্যবসায়ীদের উৎসব হলেও এর প্রচলন সম্রাট আকবরের সময় থেকেই। তৎকালীন সময়ে চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে হত এবং পহেলা বৈশাখে ভূমি মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রজাদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করত। এটিকেই হালখাতা বলা হয়। ব্যবসায়ীরা নববর্ষের দিনে পুরনো হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলে। পুরান ঢাকায় বেশ জাকজকমপূর্ণভাবে ‘হালখাতা’ উৎসব পালিত হয়। গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তি, লোকগীতি ও লোকনৃত্যের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে কুস্তি বা বলিখেলার সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হয় মূলত চট্টগ্রামে। নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ বৈশাখী মেলা।যাত্রা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা ইত্যাদি মেলার প্রধান আকর্ষণ। মেলায় নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, মাটির হাঁড়ি, বাসন-কোসন, পুতুল, বেত ও বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, তালপাখা প্রভৃতি পাওয়া যায়। নববর্ষে গ্রামীণ জনপদ ও গ্রামের লোকজনের মধ্যে নতুন খাবার ও পিঠাপুলি পহেলা বৈশাখের অন্যতম অংশ।
“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো” গানের মাধ্যমে রাজধানীর বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়। উৎসবের মূল আয়োজক ছায়ানট। পহেলা বৈশাখ ভোরে এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়। উৎসবের অন্যতম অনিবার্য অংশ ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’। পহেলা বৈশাখ সকালে এ শোভাযাত্রাটি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে এ শোভাযাত্রায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয় বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতিকী শিল্পকর্ম, রঙ-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি বহনের মধ্য দিয়ে।
বাংলা নববর্ষের ধারণা বহু প্রাচীন হলেও ১৯৬৭ সালের আগে নববর্ষ উদযাপনের রীতি তেমনটা জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামলে প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সামরিক সরকার এ ছুটি বাতিল করে। পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ এমনকি আরবি হরফে বাংলা লেখায় প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। আইয়ুব সরকারের শাসন আমলে নববর্ষ পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ১৯৬৪ সালে বাঙালির তীব্র আন্দোলনের মুখে নববর্ষের এ দিনে পুনরায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। শোষণ, নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের প্রতিবাদে রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত বর্ষবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসবে রূপ নেয়।
আকবর ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন শাসক। যার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই রাজনৈতিক আন্দোলন যেখানে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে ছায়ানটের বাঙালি নববর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতিকে স্বকীয়তা দেয়। যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন।
বাঙালির মূলত দুটো পরিচয়: জাতিসত্তায় বাঙালি এবং ধর্মীয় পরিচয়। নববর্ষে যেমন নতুনকে আহবান করে পুরাতনকে ফেলে আসার প্রত্যয় থাকে তেমনি নববর্ষ বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ঋদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের উপর দাড়িয়ে, বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন, তা আজ কিছু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের উগ্র কর্মকাণ্ডের ফলে ব্যহত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন- “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।…এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে”। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশোধনী পাশের দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দীর্ঘ ভাষণে বলেছিলেন- “… আজকের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, আমরা জীবনভর সংগ্রাম করেছি।… এখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা সমাজতন্ত্র করতে চাই, এখানে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে কোনদিন আসতে পারবে না, আমরা তা হতে দেব না ”।
পহেলা বৈশাখ নিছক একটি উৎসব বা আচার নয়। এটি বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। বাঙালির সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসবের দিন পহেলা বৈশাখ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে, সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণও গেছে বহু মানুষের। তবুও পহেলা বৈশাখে প্রাণের টানে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল বাঙালির নববর্ষ উদযাপন। কিন্তু নববর্ষের সেই নতুনত্বের আহবান সত্ত্বেও এবার আমরা সম্পূর্ণরূপে জরা ও গ্লানি কাটিয়ে উঠতে পারবো না, কারণ একদিকে করোনা ভাইরাস অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উগ্র মৌলবাদী হেফাজতে ইসলামের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।
গতবছরের মতো এবারো ১৪২৮ বঙ্গাব্দ উদযাপিত হবে স্বল্প পরিসরে। আনন্দ বিনোদনের সব আয়োজন সীমিত করে। সকল জাতি, ধর্ম বর্ণের মানুষকে থাকতে হবে নিজগৃহে নিরাপদ আশ্রয়ে। মহামারী করোনাকে এড়িয়ে জীবন রক্ষায় এটিই হবে কার্যকর উপায়।
নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব। এদিন আমরা কোনো বিশেষ ধর্ম-বর্ণ নয় বরং একটিমাত্র অখণ্ড বাঙালি সত্তা এই বোধে উত্তীর্ণ হতে পারি। নববর্ষ আমাদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। নববর্ষের প্রেরণায় আমাদের মধ্যকার সুপ্ত মানবিক মূল্যবোধ নতুনভাবে জাগ্রত হয়, মানুষে মানুষে গড়ে ওঠে সম্প্রীতি। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে শুধু উৎসব ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, এটি একটি বাঙালিত্বের অনুভব, চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধর্মীয় রাজনীতির শিকার সেখানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও এর ধারাবহিকতা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমরা যদি নববর্ষের ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারের নেয়া করোনা মোকাবেলায় পদক্ষেপ যথাযথ পালন করি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠি তাহলে আমরা সকল অপশক্তি রুখে দিয়ে বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবো। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ সময়ে দাঁড়িয়ে এ দেশ যেন কোনো জঙ্গি, মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত না হয় সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়;
প্রাবন্ধিক ও গবেষক