করতোয়ার পাড়ে আহাজারি উৎকণ্ঠা

লাশের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫১, নিখোঁজ ২৫

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে তীর্থযাত্রীদের নৌকা ডুবির ঘটনায় দ্বিতীয় দিনে আরও ২৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ৫১ জনে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ২৫ জন। এদিকে করতোয়া পাড়ে নিখোঁজদের স্বজনদের আহাজারি আর শোকের মাতম চলছে। তারা চান, যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়জনের লাশটি উদ্ধার করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক। এ দুর্ঘটনায় গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি জানিয়েছে নদীতে ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ছিল বলে তারা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে।
বিডিনিউজের খবর থেকে জানা যায়, পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর রায় গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বলেন, নৌকা ডুবির ঘটনায় রোববার ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর প্রথম দিনের অভিযান স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সোমবার ভোর থেকে আবার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও পুলিশ। দ্বিতীয় দিন আরও ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে মোট ৫১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দিনাজপুরের আত্রাই নদী থেকে।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর আরও জানান, সোমবার সন্ধ্যা নামার পর দ্বিতীয় দিনের মতো অভিযান স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা করতোয়া নদীর পাড়েই থাকবেন। মঙ্গলবার ভোর থেকে আবার অভিযান শুরু হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতাহতদের তথ্য জানানোর জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। সেখানে নিহতদের নামের পাশাপাশি নিখোঁজের নামও স্বজনদের কাছ থেকে রাখা হচ্ছে।
নিখোঁজের ব্যাপারে জানতে চাইলে দীপঙ্কর বলেন, এখানে মানুষ এসে তাদের নিখোঁজ স্বজনদের নাম তালিকাবদ্ধ করছেন। সেই তালিকায় ৪৫-৪৬ জনের নাম আছে। তবে, আমরা দেখতে পারছি একজনের নাম একাধিকবারও আছে। ফলে ধারণা করছি, নিখোঁজের সংখ্যাটি ২৫ থেকে ২৭ জনের মতো হতে পারে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসন নিহত ৫০ জনের একটি নামের তালিকা সাংবাদিকদের কাছে দেন। এর মধ্যে নারী ২৫ জন, শিশু ১৩ জন ও পুরুষ ১২ জন। নিহতদের মধ্যে বোদা উপজেলার ২৯ জন, দেবীগঞ্জের ১৮ জন, আটোয়ারীর একজন, সদরের একজন এবং ঠাকুরগাঁও সদরের একজন। এরপর আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সবার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে প্রশাসন এরই মধ্যে সব মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে বলেও জানান তদন্ত কমিটি প্রধান।
বিবিসির খবর থেকে জানা যায়, নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন বোদা উপজেলার বটতলী গ্রামের হরিকিশোর এবং কণিকা রানী দম্পতি। তাদের দুই সন্তান অজয় কুমার এবং উজ্জ্বল কুমার রোববার দুপুর থেকেই নদীর পাড়ে বাবা-মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অজয়ের বয়স ১৪ আর উজ্জ্বলের বয়স ২২। বার বার মূর্ছা যাচ্ছে তারা। তাদের মামা রিপন অধিকারী বলেন, দুই ভাই বাব-মায়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উজ্জ্বলকে এখন স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
রিপন অধিকারী বলেন, মহালয়ার অনুষ্ঠান দেখার জন্য তার বোন এবং বোন জামাইসহ তাদের পরিবারের আরো পাঁচজন অর্থাৎ মোট সাত জন ঐ নৌকাতে ছিল। কিন্তু একজন সাঁতার কেটে উঠে এলেও বাকি ছয়জন এখনো নিখোঁজ। এদের মধ্যে অজয় এবং উজ্জলের বাবা-মা রয়েছেন।
করতোয়া পাড়ে নিখোঁজ স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছেন গ্রি বাবু। তার পরিবারের দুজন মারা গেছেন, আর দুজন এখনো নিখোঁজ। তিনি বলেন, আমার শ্যালক এবং তার বোন এখনো নিখোঁজ। আর আমার স্ত্রীর মামী এবং খালার মরদেহ গতকালকেই (রোববার) পাইছি। এখন আমি বাড়ি টিকতে পারছি নে। এই নদীর পাড়ে বসে আছি যদি বাকি দুজনের কোনো হদিশ পাওয়া যায় সেই আশায়।
সোমবার সকালে মাড়োয়া ইউনিয়নের গেদিপাড়া গ্রামের কৃষ্ণ রায় (৫৫) এসেছেন দুই ছেলের লাশের খোঁজে। তিনি জানান, নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন ছেলে জগদীশ রায় (২৫) এবং অষ্ট রায় (২০)। তিনি বলেন, রোববার অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম। ছেলে দুটোরে পাইনি। আজও সকালে আবার এসেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবরই নাই। কী হবে, ভগবান কী রাগ করিছে?
মা বিজু বালা (৫০), কাকীমা সুমি রাণীর (৪৫) খোঁজে করতোয়া পাড়ে এসেছেন মণিকা রাণী (৩০)। তিনি বলেন, মা আর কাকীমা ছিল নিজের বোনের মতো। মা যেমন কোনো ভালো কিছু রান্না করলে আগে কাকীমাকে দিতেন, তেমনি ছিলেন কাকীমাও। তার বাসায় নতুন মেহমান আসলেও সেটা আগে মাকে জানাতেন। তারা তাদের বৌমাকেও মহালয়ার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হায় কপাল! একসঙ্গে তারা নিখোঁজও হয়ে গেলেন। তাদের চিন্তায় বাবা সকাল পর্যন্ত কিছু মুখে দেননি। বাসায় সবাই পাগলপ্রায়।
আরেক তরুণ (২৪) বলেন, রাতেই অনেকেই টর্চলাইট নিয়ে নদীর পাড়ে খোঁজ করেছেন। যদি কারো লাশ ভেসে উঠে। ভোর হওয়ার আগেই অনেকে এসেছেন লাশের খোঁজে। কিন্তু লাশ উদ্ধারের ধীর গতিতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন
উল্লেখ্য, রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।
পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক শেখ মাহবুব ইসলাম জানান, রোববার ২৫ জনের লাশ উদ্ধারের পর রাতে নদীতে তল্লাশি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছিল, সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় নতুন করে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। রাজশাহী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ডুবুরি দলও এখন অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। সকালে করতোয়া এবং পাশের দিনাজপুরের আত্রাই নদীর বিভিন্ন স্থানে মরদেহ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। পরে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা।
নিহতদের স্বজনরা করতোয়া নদীর পাড়ে প্রিয়জনের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের আহাজারিতে সেখানে এক হৃদয়বিদারক অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরেও লাশ না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায় দুপুরে সাংবাদকর্মীদের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, স্রোতের টানে হয়তো অনেক লাশ আশপাশের নদীতে ভেসে গেছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করছে। বোদা উপজেলার পাশেই দেবীগঞ্জ উপজেলা; তার পরেই দিনাজপুরের খানসামা উপজেলা। আজ সেখান থেকে সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ নিখোঁজদের উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে বলেও জানান ওসি।
স্থানীয়রা জানান, বরদেশ্বরী মন্দিরে প্রতি বছরই মহালয়া উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। আশপাশের ৮-১০ জেলার পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন। ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের কারণেই মন্দিরটি এলাকায় বিশেষভাবে পরিচিত। অনেক নারী-পুরুষ মানত আদায় করার জন্য সন্তানদের নিয়ে অনেকে আসেন। প্রতিবারই এই উৎসবে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি থাকে লক্ষ্যণীয়। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।
স্থানীয়দের দীর্ঘদিন ধরেই দাবি ছিল, এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি সেতু নির্মাণের। জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে এলাকাবাসীকে আশ্বাসও দেন। কিন্তু সেতুর ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সেতুটি হলে এখানে জেলার ইতিহাসে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না বলেই মনে করছেন তারা।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আউলিয়ার ঘাটে পূর্ব প্রতিশ্রুতি ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকরের ঘোষণা দেন। এ সময় তার সঙ্গে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানও উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় রেলপথ মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেদনাদায়ক এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং তিনি নিহতদের ও আহতদের পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর আগে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম নিহতদের স্বজনদের ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসায় ১০ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিঠে ডিভাইস, পাখিটি ‘ছাড়িল কে’
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে কিশোরকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা