কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর বিস্ময়ের ভুবন

সাইমন জাকারিয়া | শুক্রবার , ৪ জুন, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি প্রয়াত হলেন ২৪ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রয়াণে এক নির্বাক স্তব্ধতা বাংলা সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের পেয়ে বসেছে। কারণ তিনি তাঁর স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্যে পরিচিতজনদের মধ্যে যেমন প্রিয় ছিলেন তেমনি ভিন্ন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকের চেয়ে আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছিলেন। আজ তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিকর্ম কথা বলে উঠতে চাইছে। মজার ব্যাপার হলো কবি হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি অধিক হলেও ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস “কৃষ্ণপক্ষে অগ্নিকাণ্ড”, পরবর্তীতে “পরাজয়” ও “আয়রে আমার গোলাপজাম” নামে আরও দুটি উপন্যাস প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধসংকলন ‘দ্বিতীয় পাঠ’, ‘মিশ্রমিল’, ‘গদ্যের গন্ধগোকুল’; অনুবাদগ্রন্থ ‘মৌলনার মন: রুমীর কবিতা’; আত্মজৈবনিকগ্রন্থ ‘আমার কুমার’, শিশুসাহিত্য ‘ইল্লিবিল্লি’, ‘নাইপাই’, ‘রাজা হটপট’, ‘ছড়াগদ্য’ প্রভৃতি। তবে একথা ঠিক যে, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ কাব্য প্রকাশের মাধ্যমে তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। এরপর একে একে তার ৩৫টির অধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘যাত্রাপুস্তক’ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রয়াণে ফিরে দেখতে চাই তাঁর কাব্যভুবনে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, বিস্ময় দিয়েই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার ভুবনের সূচনা। কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ দাও বৃক্ষ দাও দিনের শুরুতেই “গাছ” কবিতায় লিখেছিলেন- “সেও এক বিস্ময়! জন্মের কাছাকাছি কোন গাছ / শিকড় ছিঁড়েই দেখে ঝুলে আছে চাঁদ”। এই বিস্ময়বোধের ভেতরে “নক্ষত্র জাগার আগে” কবি প্রশ্ন তুলেছিলেন-
“প্রাণ, তুমি কার কাছে লুকিয়েছো দেহের ভূ-ভাগ?
মাটির শিথান শূন্য গন্ধ-বৃষ্টি দেহে
কোথায় দাঁড়াবে তুমি পূর্ণতার কালে?”
কবির বিস্ময়বোধ এবং প্রশ্ন আমাদের কবিতাটির রহস্যভেদের পথ করে দেয়। আমাদের উপলব্ধি মনে করিয়ে দেয় “জন্মের কাছাকাছি কোন গাছ” হয়তো একটি মানবদেহ, যে কিনা মাতৃগর্ভের “শিকড় ছিঁড়েই” চন্দ্রকলা রূপে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বাউল সাধকেরা এই তত্ত্বের প্রচারক। কবির জন্ম বাউল সাধকদের প্রাণকেন্দ্র ও ভৌগোলিক বৃত্তের মধ্যেই, তাই হয়তো কবি দেহকে গাছ এবং চাঁদের সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। অবশ্য দেহকে গাছের প্রতিরূপে চিহ্নিত করেছিলেন বাউল সাধকদেরই পূর্ববর্তীকালের সাধক সমপ্রদায় তথা চর্যাপদের সাধক কবিরা। অন্যদিকে বাউল সাধকেরা মানবদেহ এবং মানবদেহের প্রকৃতিকে “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে” বলে গান গেয়েছিলেন। আমাদের অনুমান, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলাদেশের সাধক কবি তথা চর্যাপদের কবি ও বাউল কবিদের পরম্পরায় চর্চিত সেই ঐতিহ্যিক ধারাটিকে চেতনে-অচেতনে বহন করে চলেছেন, আর তারই প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতাটির প্রথম স্তবকে।
উল্লেখ্য, এই কবিতার প্রথম স্তবকের দুটি প্রশ্নের সাথে যুক্ত প্রাণ এবং দেহ আমাদের মানবজন্মের মুহূর্তটি মনে করে দেয়; এক্ষেত্রে চর্যাপদে বর্ণিত “কাআ তরু বর” তথা গাছের প্রতীকে দেহকে চিহ্নিত করার বিষয়টি এবং বাউলতত্ত্বে বর্ণিত দেহে লুকায়িত প্রাণশক্তির কথা প্রকাশ করে। এখানে কবি “মাটির শিথান শূন্য” যে “গন্ধ-বৃষ্টি দেহে”র “পূর্ণতার কালে” দাঁড়াবার স্থান শনাক্ত করতে চেয়েছেন, তাতে আমরা আবিষ্কার করি সে দেহ আর কারো নয়, কবির নিজেরই মানবদেহ, যাকে তিনি গাছের প্রতীকে চিহ্নিত করেছেন। কেননা, দ্বিতীয় স্তবকে শুরুতেই কবি লিখেছেন- “সকল শিকড় ছিঁড়ে তবু তুমি বেঁচে আছো পঁচিশ বছর” (প্রাগুক্ত), আমরা প্রায় নিশ্চিত- এটা কবির আত্মবয়ান, আত্মজীবন-কথা। হিসেব করে দেখি, কবির জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর, আর কবির দাও বৃক্ষ দাও দিন শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। (হাবীবুল্লাহ সিরাজী, দাও বৃক্ষ দাও দিন, ঢাকা : মুক্তধারা [স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ], মার্চ ১৯৭৫) অর্থাৎ কবির জন্মের ২৬ বছর পর তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এই দিক বিবেচনা করে একথা বলা যায় এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “গাছ” কবিতাটি তিনি নিশ্চয় পঁচিশ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন। মূলত সেই পঁচিশ বছর বেঁচে থাকার কথাই কবি এই কবিতায় উল্লেখ করেছেন, এখানে কবি নিজেকে চূড়ান্তভাবে গাছের প্রতীকে রূপায়িত করেছেন।
কবির উপলদ্ধিতে পাই, মাতৃগর্ভের শিকড়-ছেঁড়া কবির মানবদেহ “সকল শিকড় ছিঁড়ে তবু” বেঁচে আছে পঁচিশ বছর। তার দৃষ্টে কবির প্রশ্ন ও বিস্ময় একাকার হয়ে যায়, তাই তো কবি লিখেছেন : “আকাশেই তোলো মাথা / পুষ্প-ফুল পেড়ে এনে অনাবিল মেনে দাও তৃণভূমি জুড়ে!”
এখানে কবি গ্রন্থিত করেন মানবিক প্রাণসত্তার কয়েকটি বিশেষ গুণ, তথা রূপ, রস ও গন্ধের নৈর্ব্যক্তিক পাঠ। কবির প্রতীকায়িত বৃক্ষের “সবুজ পাতা”, “কাণ্ড” এবং “ধূসর বাকল” দৃশ্যত রূপের প্রকাশ, সে প্রকাশের গভীরে আছে রসের সঞ্চার ও সুগন্ধের বিস্তার। এমত পর্যবেক্ষণে কবি বিস্মিত ও শিহরিত হয়ে ওঠেন এবং রূপ, রস ও গন্ধের অন্তর্গত সারসত্য হিসেবে বাতাস ও জলীয়বাষ্পের লীলাকে চিহ্নিত করেন, সেই সাথে ঊর্ধ্বমুখী আকাঙ্ক্ষার ভেতর পুষ্প-ফলের দৃষ্টিনন্দন প্রসারকে বন্দনা করেন।
দুই
বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে মানবমহিমার যে-গান অনন্তকাল ধরে জাগরিত ও প্রচলিত রয়েছে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তার একজন বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার। আধুনিক নাগরিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েও তিনি তাঁর আধুনিক কবিতা রচনা-কাঠামোর ভেতর অনেকক্ষেত্রেই ঐতিহ্যিক চিন্তা-ধারাকে ধারণ করেছেন। তাঁর শূন্য, পূর্বে না উত্তরে শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “লালনের ঘোড়া” কবিতাটিতে এর প্রমাণ রয়েছে।
এই কবিতায় বাংলাদেশের লোকায়ত ভাবধারায় লালন সাঁইজির ভাব-দর্শন চর্চা ও তার বিহারের কথা “লালনের ঘোড়া”র চলমান ও তার সঙ্গে মিশিয়ে দেখানো হয়েছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশের বাউলসাধক শিরোমণি লালন সাঁইজির একটি ঘোড়া ছিল, তিনি সেই ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করতেন এবং শিষ্যদের বাড়িতে বিহার করতেন। এই কিংবদন্তিকে আশ্রয় করেই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী “লালনের ঘোড়া” শীর্ষক কবিতাটি রচনা করেছেন। কিন্তু কবিতাটি শুধু কিংবদন্তির বর্ণনার ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা লালন সাঁইজির দর্শন ও ভাবসাধনার সংগ্রামকে গূঢ়ভাষায় প্রকাশ করেছে। কবিতাটির প্রথম স্তবকে কবি লিখেছেন-
“এক চোখে মন-মক্কা, আরেক আঁধার
কী যে দড়, লাগামের হড়বড়
হাড়কাঠি গায়ে পিঠে তুমুল বিহার
গুরুধন্দে বুড়বুড়ি- মাকু খটাখট্‌
ঘোড়ায় জবর চোট
মেলানোর নানা পথে মেশানোর ঠাঁই
আলেক সাঁই!”
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটি রহস্যঘেরা বয়ানে ঠাসা। কবির এই বয়ানের ভেতর বেশকিছু কন্টেঙট এবং সবটেঙট মিশে রয়েছে, উপলব্ধি দিয়ে যা বুঝে নিতে হয়। কবির বর্ণনা থেকে উপলব্ধির পথ দিয়ে এই কয়েকটি পঙক্তিতে লালন সাঁইজির শারীরিক এবং ভাবতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক পরিচয় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন- লালন সাঁইজি বাল্য বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার একটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি এক চোখে দেখতেন এবং তাঁর আরেক চোখে আঁধার ছিল। সরলভাবে কবিতাটির প্রথম পঙক্তির এরকম একটি অর্থ ধরে নেওয়া যেতে পারে, আবার এর আরেকটি অর্থ থাকতে পারে- সমাজের মানুষ তো এক চোখা, আর সেই চোখে তারা মন-মক্কা তথা ধর্মের প্রতি দৃষ্টি গেঁথে রেখেছেন, তারা আর অন্য কিছু দেখতে পান না। এমনই কঠিন ও ঘুণেধরা সমাজের বিরুদ্ধে লালনের পথ মানে এই পথ দিয়েই লালন তাঁর “হাড়কাঠি গায়ে পিঠে”র ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। তাঁতি সমাজের তাঁত বুননের “মাকু খটাখট্‌” আওয়াজের মধ্যে লালন তাঁর ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন, তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল ধর্মের গোঁড়ামিকে ভেঙে দেওয়া এবং ধর্ম দিয়ে বিভক্ত সমাজে মানুষের মহামিলনের রাস্তা নির্ণয়। এই পথের সন্ধানে নেমে এক পর্যায়ে লালন সাঁইজি আবিষ্কার করেন “আলেক সাঁই” শব্দবন্ধ, কবির বয়ানে এই “আলেক সাঁই” হলো- “মেলানোর নানা পথে মেশানোর ঠাঁই”। এভাবেই লালন সাঁইজির দর্শনের মর্মবাণীকে এমন একটি পঙক্তি ও সংজ্ঞায়নে বেঁধে ফেলার দক্ষতায় কবি হয়ে ওঠেন যথার্থ একজন লালন তাত্ত্বিক।
সংখ্যার হিসাবনিকাশ দিয়ে বাংলাদেশের সাধক সমপ্রদায়ের লোকজন অনেক সময় গূহ্যকথা প্রকাশ করে, এটি একটি ঐতিহ্যিকরীতি। লালন ছিলেন এই ঐতিহ্যিকরীতির প্রধান অনুসারী, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী “লালনের ঘোড়া”য় সেই রীতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে লিখেছেন-
“ক্রোশে-ক্রোশে বাহাদুরি, এজমালি নব্বুই কদম
নয় যোগে নিরানব্বুই, খুঁটি ধারাপাত
জমিনে অরূপ নাকি আদমসুরাত!”
পর্যটক লালন সাঁইজির ভ্রমণের বৃত্তান্ত স্মরণ করে কবি তাঁর নানাবিধ পথের বিস্তার এবং তা থেকে তাঁর অর্জনকে ব্যাখ্যা করেছেন উপর্যুক্ত পঙক্তিসমূহে। এরপর কবি প্রকৃতসত্য আবিষ্কারের আনন্দে ঘোরলাগা বোধের ভেতর এমন কিছু পঙক্তি সঞ্চার করেছেন যাতে মানুষের দৃষ্টিভ্রম এবং প্রকৃতসত্য অবলোকনের দুয়ার খুলে যায়। কেননা, পাত্রাপাত্র ভেদে দর্শন-বাণীর অর্থ পাল্টে যায়, তাই বুঝি কবি লিখেছেন-
“যখন যেমন যাত্রা
ঘোড়ায় সওয়ার মর্দ- হাঁটছে লালন
যখন যেমন যাত্রা
ঘোড়ায় সিরাজ বসা- দৌড়ায় লালন
যখন যেমন ভেদ
লালনে আসীন ঘোড়া-মেলালে মেশায়!”
লালন সাঁইজির দর্শন ও সাধন পথের অভিযাত্রাকে কবি দিব্যদৃষ্টিতে সকল ভাবেই মেলাতে মেশাতে সক্ষম হন। এই শিক্ষা তিনি লালন সাঁইজির কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর এ ধরনের কিছু কবিতা পাঠে আমরা প্রতিনিয়ত সচকিত হয়ে উঠি এবং বলতে বাধ্য হই, আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এমত ঐতিহ্যিক চারণ ও গ্রন্থরীতি অতি বিরল। তাই তাঁর কবিতা যথার্থভাবে ঐতিহ্যিক মানদণ্ডের নিরিখে বিশ্লেষিত হওয়া প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেলা প্রশাসকের কাছে সেবা প্রকল্পের প্রতিবেদন পেশ
পরবর্তী নিবন্ধশিকড় সন্ধানে মানুষের ইতিহাস: একটি গবেষণা গ্রন্থ