কবি জসীম উদ্‌দীন স্মরণালোচনা

কামরুল আনোয়ার চৌধুরী | শুক্রবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২২ at ১১:৪৫ অপরাহ্ণ

কবি জসীম উদ্‌দীনের নাম বলতেই স্মৃতিতে ভেসে উঠে শৈশবে স্কুলজীবনে পড়া কবিতা যেমন ‘মামা বাড়ী’ ‘রাখাল ছেলে’ ‘আসমানী’ ‘খুকীর সম্পত্তি’ ‘নিমন্ত্রণ’ প্রভৃতি। স্মৃতিতে এখনো সজীব ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলতে যাই/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামা বাড়ী যাই’ (মামা বাড়ী), ‘রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও’ (রাখাল ছেলে), ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’ (নিমন্ত্রণ) ‘শিউলি নামে খুকীর সনে আলাপ আমরা অনেক দিনে থেকে’ (খুকীর সম্পত্তি) প্রভৃতি। এরকম আরো অনেক ছড়া-কবিতা। কিশোরবেলায় পড়েছি ‘কবর’ কবিতা। মনটাকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে রাখা অতুলনীয় এক শোক কবিতা। এ-কবিতা আবৃত্তি করে অনেক আবৃত্তিকার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকারের স্বীকৃতি বা কৃতিত্ব। ১৯৪৭ সনে পূর্বে অবিভক্ত বাংলায় কবি জসীম উদ্‌দীন ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন কোলকাতা টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক ‘কবর’ কবিতাটি পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়। কবি জসীম উদ্‌দীনের জীবনে বা বাংলা সাহিত্য এটি এক বিশাল অর্জন বা প্রতিভার স্বীকৃতির উজ্জ্বল উদাহরণ। যেমন কৃতিত্ব অর্জন করেছেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। এন্ট্রাস পাস (বর্তমানে এসএসসি) আবদুল করিম কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ও লেখক ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের অকৃত্রিম সহযোগিতার মাধ্যমে। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি ছাড়াও যথেষ্ঠ উপভোগ্য ছিল তাঁর গদ্যগ্রন্থ ‘ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়’, ‘চলে মুসাফির’ ‘যে-দেশে মানুষ বড়’ প্রভৃতি। তাঁর ‘বেদের মেয়ে’ ‘মধুমালা’ বেতার নাটক শুনেছি। পল্লী গ্রামের মনোরম প্রাকৃতিক আবেষ্টনী ও পল্লী গ্রামের জন-জীবনের জীবন প্রবাহের অতুলনীয় রূপকার কবি জসীম উদ্‌দীন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের পর যার নাম অবলীলায় চলে আসে তিনি হচ্ছেন কবি জসীম উদ্‌দীন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে যখন দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন চলছিল তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন-‘শেখ মুজিবুর রহমান/ঐ নাম যেন ভিসুভিয়সের অগ্নী উগারী গান। এ-কবিতা দেশব্যাপী তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন।
বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সাল হতে ভারতের বিভিন্নস্থানে স্বল্প আয়ের বা বিত্তহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে এ কর্মসূচির নাম ‘আবাস যোজনা’। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি টিভি কেন্দ্র ‘দূরদর্শন’-এ আবাস যোজনা কর্মসূচির প্রচারের শুরুতে ঘোষিকা কবি জসীম উদ্‌দীনের ‘আসমানী’ কবিতা প্রথম ছয় লাইন পাঠ করেন, ‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/রহীমুদ্দীর ছোট বাড়ী রসুল পুরে যাও/বাড়ীতো নয়, পাখীর বাসা ভেন্না পাতার ছানী/একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি/ একটু খানি হাওয়া দিলে ঘর নড়বড় করে/ তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। এটুকু পড়ার পর ঘোষিকা বলতে থাকেন কবি জসীম উদ্দীনের আসমানীদের আর এখন সেদিন নেই। প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য মনোরম ও সুবিধাজনক আবাসন ব্যবস্থার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। বোঝা গেল স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও কবি জসীম উদ্‌দীন ভারতে আজও পঠিত ও আলোচিত। ১৯৪৭-এর পূর্বে কোলকাতাতেই কবির সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি ও বিকাশ যেমন তৎকালীন উভয় বাংলার সব কবি লেখকদের হয়েছিল। এ-প্রবন্ধের লেখক নিজে এ-অনুষ্ঠান দেখেছিলেন।
ভারত রাষ্ট্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রদীপ ঘোষ একজন প্রতিভাবান আবৃত্তিকার। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস বাংলাদেশের নেত্রকোনায়। ১৯৮২ সালে তিনি চট্টগ্রাম আগমন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত গ্যালারিতে তাঁর কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জিয়া হায়দার, অধ্যাপক রাজিব হুমায়ুন, অধ্যাপক নিলুফার সুলতানা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন আবৃত্তিকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় প্রদীপ ঘোষের কবিতা আবৃত্তি। আবৃত্তির শুরুতে আবৃত্তি শিল্পী প্রদীপ ঘোষ বাংলাদেশের প্রতি তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মস্থানের প্রতি তাঁর নাড়ির টান অনুভব করেন বলে তাঁর অনুভূতি জানালেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের স্মৃতি কাতরতার কথা উল্লেখ করলেন। প্রথমে তিনি পল্লী কবি জসীম উদ্‌দীনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদান শুরু করলেন জসীম উদ্‌দীনের সেই বিখ্যাত কবিতা-
“আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে খুঁজিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর”
এরপর তিনি একে একে সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফরসহ আরো অনেক কবির কবিতা আবৃত্তি করার পর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য কবিতা আবৃত্তি করলেন। শত শত ছাত্রছাত্রীদের হৈ চৈ কলকাকলি দু-ঘন্টারও বেশী সময়ে জন্য স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। পিনপতন নীরবতায় শিল্পী ৫০টির মতো কবিতা বিরামহীনভাবে আবৃত্তি করেছিলেন। লেখক তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষার্থী ছিলেন এবং অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বার্ষিক নাটক অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের মুসলিম হল মঞ্চে। অন্যান্য অনুষ্ঠানের পর নাটকের পূর্বে শুরু হয় কবি জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার ছায়ানাট্যে আবৃত্তি। আবৃত্তি করেছিলেন ঐ স্কুলের তরুণ ও প্রাণবন্ত শিক্ষক দীপক সেনগুপ্ত। এ-শিক্ষক যে একজন দক্ষ ও শক্তিমান আবৃত্তিকার সেদিন সবাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এ-শিক্ষক পরবর্তীতে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। লেখক তখন ঐ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন করতেন। ১৯৬৬ সালের দিকে একবার চট্টগ্রামে এসে নন্দনকাননের তুলসীধামে রাত্রিযাপন করেছিলেন। বোয়ালখালীর কবিয়াল রমেশ শীল খবর পান কবি জসীম উদ্দীন চট্টগ্রামে এসেছেন এবং তুলসীধামে অবস্থান করেছেন। কবি রমেশ শীল পরদিন ভোর হতেই নিজ বাড়ি হতে রওনা দিয়ে শহরে এসে কবির খোঁজ করলেন। জানতে পারেন কবি তুলসীধাম থেকে নিচে নেমে সেলুনে সেভ করতে গেছেন। রমেশ শীল তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে সেলুনে গিয়ে দেখলেন এক নাপিত কবিকে মাথায় হাতে ধরে সেভ করছেন। রমেশ শীল নাপিতের হাত থেকে কাঁচি ও খুর কেড়ে নিয়ে বললেন ‘কবি জসীম উদ্‌দীনের মাথায় আমি হাত দিতে পারবো। আর কেউ নয়।’
(রমেশ শীল সংক্রান্ত এ তথ্য লেখক সুচরিত চৌধুরীর একটি লেখা থেকে সংগৃহীত)।
কবি জসীম উদ্‌দীনের ‘আসমানী’ কবিতার আসমানী কবির জন্মভিটার পাশ্ববর্তী গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের বালিকা। কবি জসীম উদ্‌দীনের কবিতার কারণে মেয়েটি স্বদেশ ও বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। দর্শনার্থীরা কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি দর্শন করতে এলে তাদের কেউ কেউ আসমানীর সাথেও সাক্ষাত করতেন। ১৯৯৮ কি ১৯৯৯ সালের দিকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় আসমানী মারা গেলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় প্রশাসন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন করে।
১৯৬৬/৬৭ সালের দিকে কবি জসীম উদ্‌দীন কঙবাজার জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রামের মহকুমা শহর) অন্তর্গত কুতুবদিয়া উপজেলায় (তৎকালীন কুতুবদিয়া থানা) ভ্রমণ করেছিলেন। সমুদ্র পাড়ের বালুচর, বালুচরে কাঁকড়ার দল, অনতিদূরের গাছগাছালি দেখে এত অভিভূত হয়েছিলেন যে তিনি একটি কবিতা লিখলেন-‘ঝুর ঝুর ঝুর ফুল ঝরে হায় পাতা মর্মর করে/ দেইখ্যা আইলাম সোনার কন্যা কুতুব দিয়ার চরে’ কবি জসীম উদ্‌দীনের নামে সেখানে স্কুলের নামকরণ করা হয় কবি জসীম উদ্দীন হাইস্কুল। (এ-তথ্য কুতুবদিয়াবাসীদের থেকে প্রাপ্ত)
১৯৮২ সালের দিকে সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা মালেক বাংলাদেশ টেলিভিশন বিটিভিতে কবি জসীম উদ্‌দীনের নিমন্ত্রণ কবিতাটি গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আমি ও আমার কয়েকজন সঙ্গী নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে একটি নির্বাচনকেন্দ্র পরিদর্শন করতে গেলে শিম খেতের ভিতর দিয়ে আমাদের হাঁটতে হয়। সবাই তখন সমস্বরে আবৃত্তি করি ‘শিম আর শিম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবোল তাবোল এখনও প্রিয় বইগুলির একটি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাইভেটকারে বস্তাভর্তি গাঁজা, শেরশাহে যুবক আটক