এসডিজি অর্জনে অপুষ্টির হার কমানো কঠিন হবে

আমিষের উৎপাদন বাড়লেও কমেছে মাথাপিছু প্রাপ্তি

| শুক্রবার , ২ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

দেশে গত এক দশকে দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় এসব আমিষ পণ্যের জনপ্রতি ভোগ বাড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোগ কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হার কমে এলেও এখনো পুষ্টি সমস্যায় ভুগছে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ। করোনা পরিস্থিতিতে আমিষের প্রাপ্যতা আরো কমে গিয়ে পুষ্টি সংকট প্রকট হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থার উন্নতি না হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জন কঠিন হবে। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এখবর প্রকাশিত হয়। খবরে আরো বলা হয় যে, গত এক দশকে আমিষের উৎপাদন ২৫০ শতাংশ বাড়লেও কমেছে মাথাপিছু প্রাপ্তি।

গত দুই দশকে বাংলাদেশ দ্রুত উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে অনেক মানুষ চরম দরিদ্রতা থেকে বের হয়ে এসেছে। একই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে লক্ষণীয় সফলতা অর্জন করেছে। ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও এদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো উচ্চ মাত্রার অপুষ্টি ও খাদ্য ঝুঁকিতে আছে। একথা ঠিক যে গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিন্তু এর গতি অত্যন্ত ধীর। গত এক দশকে দুধের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আমিষের ভোগ কমেছে। মাংসের ভোগ বাড়লেও খুবই সামান্য। এটা উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া প্রাণিজ আমিষের দামও বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মানবদেহের শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে। এই আমিষের ২০ শতাংশ আসতে হবে প্রাণিজ আমিষ থেকে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এই আমিষের ৫০ শতাংশই আসে প্রাণিজ উৎস থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আমিষ পরিভোগের পরিমাণ ৮৩ গ্রাম, যার ৬৭ শতাংশ প্রাণিজ আমিষ। আমাদের দেশে প্রাণিজ উৎস থেকে ক্যালরিপ্রাপ্তির পরিমাণ শুধু বৈশ্বিক গড় নয়, প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়েও কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বাড়লেও পরিভোগ কম হওয়ার কারণ চিহ্নিত করা জরুরি। আমিষ জাতীয় বেশ কিছু পণ্যের উৎপাদনে বেশ সফলতা এলেও দাম না কমে বেড়েছে। ফলে তা সাধারণ ভোক্তাদের বড় একটি অংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এ কারণে কম আয়ের মানুষ প্রয়োজন মতো আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। আমিষ জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ততক্ষণ অর্থবহ হবে না, যতক্ষণ তা সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আসে। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেঁচে থাকা যথাযথ বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব ও কৈশোরের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি দক্ষতা বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে পরবর্তী সময়ে এরা মেধা, উৎপাদনশীলতা ও কর্মক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। পুষ্টিহীনতা দক্ষ মানব সম্পদ গড়ারও অন্তরায়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর অনেকটাই বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৬০এর দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অথবা আমদানির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ বা প্রাপ্যতার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ওয়ার্ল্ড ফুড সামিটে অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য সরবরাহ এবং তার মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার মধ্যে রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়।

প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই এর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে বা আয় বাড়াতে হবে। সন্দেহ নেই, দারিদ্র্য হ্রাস, সম্পদ বৃদ্ধি ও শিক্ষিত মাবাবার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ার ফলে গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে এর গতি অত্যন্ত শ্লথ তা ছাড়া অপুষ্টির কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে, যেগুলো দূর করতে হলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বন্টন ব্যবস্থার বৈষম্য কমাতে হবে। জনগোষ্ঠীর সব অংশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপুষ্টি সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব নয়। এটি স্বীকৃত এবং গবেষণায় প্রমাণিত যে, পুষ্টি একটি জাতীয় সমস্যা এবং উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। জাতীয় স্বাস্থ্য তথা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পুষ্টির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদি একটি উন্নত ও কর্মক্ষম জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হয় তবে পুষ্টিহীনতা দূর করা দরকার। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টিকর হার ২৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। পুষ্টি সেবার ব্যাপ্তি, মান ও পুষ্টি আচরণে উন্নতি আবশ্যক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে