এলো ঋতুরানী বর্ষা

আরিফ রায়হান | বুধবার , ১৫ জুন, ২০২২ at ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। প্রকৃতিতে এলো ঋতুরানী ‘বর্ষা’। বর্ষা মানেই আবেগ, অনুভূতি, বর্ষা মানেই মেঘ-বৃষ্টি। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির সুরে নেচে উঠে আমাদের মন। পুরোনো জঞ্জাল ধুয়ে মুছে স্নিগ্ধ সজীবতায় আমরা জেগে উঠি সবপ্রাণে। সব রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতি হয়ে উঠে নরম কোমল। নতুন প্রাণের আনন্দে জাগে গাছপালা, ফসলের মাঠ।
বর্ষা ঋতুকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অনেক গান, কবিতা, ছড়া ও গল্প। অন্য সব ঋতুর চেয়ে বর্ষা ঋতুর বন্দনা বেশি করেছেন কবি-সাহিত্যিকরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার প্রতিটি ঋতুর রূপের জয়গান গাইলেও ঋতুরানীকে উজার করে দিয়েছেন তাঁর যত ভালোবাসা, আবেগ ও অনুভূতি। এ ঋতু তাঁকে অনেক বেশি আন্দোলিত করেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে বর্ষাকে নিয়ে অনেক কালজয়ী গান কবিতা লিখেছেন তিনি। গেয়েছেন-
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না’।
অথবা
‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…’।
কিংবা লিখেছেন :
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়…”।
বর্ষা রবিঠাকুরের ঋতু, বর্ষা কবি নজরুলের ঋতু, বর্ষা শিল্পী-সাহিত্যিকের ঋতু, বাংলার কৃষকের ঋতু এবং এদেশের মানুষের ঋতু। এই ঋতুতে আছে রিনিঝিনি সুর-ছন্দ এবং বৈচিত্র্য। আমাদের বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য নিয়ে আসে বর্ষা। এটি ষড়ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। তবে এর ব্যাপ্তি থাকে প্রায় চার মাস। বর্ষায় অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে নদী-নালা, খাল-বিল জলে টইটম্বুর হয়ে যায়। বিলের জলে হাসে শাপলা। বর্ষায় বন-বনানী, নদ-নদীর রূপ আমাদের মুগ্ধ করে।
ঝমঝম বৃষ্টি, প্রকৃতিতে সবুজের সজীবতা এবং কদমফুলের সুভাষ নিয়ে আমাদের প্রকৃতিতে আসে বর্ষাকাল। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কিংবা নাম পাওয়া যাবে না। কেবল বাংলাদেশেই পাওয়া যায়। তাই এ ঋতু শুধু আমাদেরই ঋতু। বৃষ্টি এবং কদম ফুল তাদের বন্ধুত্ব চিরদিনের। বর্ষা কদম ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ আমাদের উপহার দেয়। এছাড়া বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনী, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুল সুবাস ছড়ায়।
বর্ষা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।’ কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষাকে প্রত্যক্ষ করেন খুব কাছ থেকে। তাই তারা খুব ভেতর থেকে বের করে আনেন বর্ষার রূপ, রস।
কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘গ্রীষ্ম চলিল, বর্ষা আসিল, আষাঢ়ে নামিল ঢল;/বুনো পাখি সব ডাকে অবিরল : ‘বাওয়া ক্ষেত কর তল।’/এই তো কখন নেমেছে বৃষ্টি, অবিরাম তবু ঝরছে;/না পেয়ে উপায় রাখালের দল ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছে।’
পল্লী কবি জসিমউদদ্‌ীন লিখেছেন :
‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ, মন যেন চায় কারে।’
কবি’ ফররুখ আহমদ বর্ষা নিয়ে লিখেছেন :
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
কবি শামসুর রাহমান অনাবৃষ্টি কবিতায় লিছেখেন :
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।’
সৈয়দ শামসুল হক প্রাণের স্বদেশকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছেন :
‘তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন;’।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন :
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।
বর্ষা সিক্ত করে এদেশের মাটি ও মানুষের মন। বর্ষার জল ধুয়ে দেয় জীবনের সব ক্লেদ। বৃষ্টির জলে আমরা সিক্ত হই, সতেজ হই, হই উজ্জ্বীবিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবার খুশি
পরবর্তী নিবন্ধজ্যৈষ্ঠ মাসের ফল