এভাবে কেউ মারা যাইতে পারে!

প্রশ্ন দুই ভাইয়ের নানির কীটনাশকের বিষ কতটা ভয়াবহ বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার টিটু রিমান্ডে

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ৭ জুন, ২০২৩ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ প্রয়োগের পর বিষক্রিয়ায় স্কুলপড়ুয়া দুই ভাই জাহিন ও জায়ানের মৃত্যুর মামলায় গ্রেপ্তার পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের কর্মী টিটু মোল্লাকে দুদিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। গতকাল ভাটারা থানাপুলিশ টিটু মোল্লাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। রিমান্ড আবেদন বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী রুনা লায়লা ও এমদাদুল হক। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের বিচারক টিটুকে দুদিনের রিমান্ডে পাঠান। টিটু মোল্লা ডিসিএস অরগানাইজেশন লিমিটেড নামের একটি বালাইনাশক (পেস্ট কন্ট্রোল) প্রতিষ্ঠানের কর্মী। সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রোববার মারা যায়। দুই সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় মোবারক সোমবার ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন।

ভাটারা থানার পুলিশ পরিদর্শক শরীফুল বলেন, বাসার পোকামাকড় তাড়ানোর জন্য বারিধারার ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড নামের পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিটিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মোবারক। ওই কোম্পানির কর্মীরা শনিবার বাসায় ওষুধ দিয়ে দুইতিন ঘণ্টা পরে ঘরে ঢুকতে বলেছিল। পরিবারটি নয় ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাদের সকলেরই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। রোববার ভোরে নয় বছরের ছোট ছেলেটি মারা যায়। ছোট ছেলেকে দাফন করে আসতে না আসতেই রোববার গভীর রাতে ১৫ বছর বয়সী বড় ছেলের মৃত্যু হয়। খবর বিডিনিউজ ও বিবিসি বাংলার।

ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই পরিবারটি এই হৃদয় বিদারক ঘটনার শিকার হয়েছে।

এভাবে কেউ মারা যাইতে পারে? : দুজনের মৃত্যুর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, মারা যাওয়া শিশু দুজনের বয়স ১৫ বছর এবং ৯ বছর।

মারা যাওয়া শিশুদের নানি শামসুন্নাহার বলেন, অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারটির সব ক’জন সদস্য বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাতেই এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই মারা যায় দুই ভাই।

প্রায় দুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর শিশুদের বাবা মোবারক হোসেন তুষার ও মা শারমিন জাহান লিমা তাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছেন। লিমার গ্রামের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায়।

এমন অকস্মাৎ এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে পরিবারটি শোক স্তব্ধ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, কী হলো, কেমন করে হলো এখনও মাথায় ঢোকে না। আমি কাল কথাই বলতে পারছিলাম না কারও সাথে। কী বলব আসলে? এভাবে কেউ মারা যাইতে পারে?

এদিকে ‘টঙিক কেমিক্যালের’ প্রভাবে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করলেও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে ময়নাতদন্তের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলছেন এভারকেয়ার হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহমুদ।

কীটনাশক সার্ভিস কোম্পানি যা বলছে : পরিবার জানিয়েছে, ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বাসায় তেলাপোকা মারার স্প্রে ছিটানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, আসলে আমরা বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো। আমরা অনেক জায়গায় সার্ভিস দিয়েছি, এমনটা এবারই হলো।

কীটনাশকের বিষ কতটা ভয়াবহ : ঢাকায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় জিগাতলার জাপানবাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে একজন মারা গিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের ধারণা কীটনাশকের বিষক্রিয়ার ফলেই এটা ঘটেছিল।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ডা. উজ্জ্বল কুমার মল্লিক বলেন, কীটনাশকের বিষ মানুষের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। কীটনাশক তো বিষ, এটি মানুষের শরীরে কোষে কোষে পৌঁছে যায়। এটা হচ্ছে মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর, কিডনি লিভার, ব্রেইনেও প্রভাব পড়ে। খিঁচুনি হয়। এরপর তারা মরে যান, সব বিষেই।

তিনি বলেন, এটা যখন বদ্ধ রুমের ভেতরে দেয়, তখন এটা পরিমাণের ওপর নির্ভর করে, সাধারণভাবে এটি ক্ষতিকর। ধানক্ষেতেও এমন হতে পারে, যেদিকে বাতাস প্রবাহিত হয়, সেদিকে যদি কোনো ব্যক্তি থাকে সেক্ষেত্রেও একই ক্ষতি হতে পারে। এই ধরনের ঘটনায় যদি বিষের প্রতিক্রিয়া এবং পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে ক্ষতি বা মৃত্যুর হার অনেক বেশি হতে পারে। প্যারাকুয়েড নামে আরও একটি বিষের কথা তিনি বলেন। এই বিষ বেশি পরিমাণে যদি শরীরে ঢোকে তাহলে মানুষের বেঁচে যাওয়ার হার একেবারেই কম।

পেস্টোকিল নামে একটি কীটনাশক সেবাদানকারী কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, কীট মানে পোকামাকড় মারতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নামের ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়, যা থেকে ফসফিন গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

তিনি কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন। দক্ষ লোক দিয়ে ঔষধ দেয়ানো, ঔষধের মাত্রা সম্পর্কে জানা, পরিবারের অন্তত একজন সচেতনভাবে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে জেনে সবাইকে অবগত করা জরুরি। যেহেতু এটা একটা ‘কিলিং এলিমেন্ট’, এটার ক্ষতিকর দিক থাকবেই। তাই কতটা কম ক্ষতি হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

কোন ঔষধ দেয়া হচ্ছে, কী পরিমাণে দেয়া হচ্ছে, প্রভাব কতক্ষণ থাকবে এবং এরপর কীভাবে বাড়ি পরিষ্কার করা হবে, এসব তথ্য নিশ্চিত হয়েই এই কীটনাশকের স্প্রে ছিটানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির সঙ্গে আলোচনার দ্বার খোলা : আমু
পরবর্তী নিবন্ধলোডশেডিং ও মূল্যস্ফীতির কষ্ট কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা