এখনো অরক্ষিত খাল-নালা

নগরে বেষ্টনী ছাড়া খালপাড় আছে ১৯ হাজার মিটার ।। ৫ হাজার ৫২৭ স্থানে উন্মুক্ত নালা ।। ২৫ দিনে চার দুর্ঘটনা ।। বর্ষা ঘনিয়ে আসায় বাড়ছে উদ্বেগ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

নগরের দেওয়ান বাজার সিঅ্যান্ডবি কলোনি ব্রিজ। চাক্তাই খালের ওপর ব্রিজটির অবস্থান। ব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণ পাশে খালপাড়ের রাস্তা ধরে সামান্য যেতেই দেখা যায়, সাত-আট বছরের কয়েকজন শিশু খেলা করছে। খেলতে একটু অন্যমনস্ক হলে বা অসাবধানতাবশত এসব শিশুর খালে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ খালপাড়ে কোনো বেষ্টনী নেই। মাঝেমধ্যে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে জানিয়ে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বর্ষায় যখন পানি উঠে তখন রাস্তা ও খাল মিশে একাকার হয়ে যায়। ওই সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

শুধু দেওয়ান বাজারের এ অংশ নয়, পুরো নগরের খালগুলোর বেশিরভাগ অংশে নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। অনেক নালার উপর নেই স্ল্যাব। গত এক সপ্তাহ ধরে সরেজমিনে শহরের অন্তত পাঁচটি খাল ও নালা রয়েছে এমন ১৫টি স্পট ঘুরে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও স্ল্যাব দেখা যায়নি। এ সময় স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় সময় এসব খাল-নালায় পথচারীরা পড়ে আহত হন। ঘটে প্রাণহানিও। বিশেষ করে বর্ষায় যখন পানিতে একাকার হয়ে যায় তখন প্রাণহানির ঘটনা বেশি হয়। এরপরও টনক নড়ে না সংশ্লিষ্টদের। বর্ষা ঘনিয়ে এলেও খাল-নালা অরক্ষিত থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী।

জানা গেছে, নগরের ঝুঁকিপূর্ণ নালা-নর্দমা ও খালের একটি তালিকা করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। নগরের ৪১ ওয়ার্ডে খাল-নালা রয়েছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে; যেগুলো মরণফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত। গত বছর অক্টোবরে এ তালিকা করলেও এখনো স্ল্যাব বা নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি চসিক। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় সিডিএ যেসব খালে কাজ করছে সেখানেও নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। অবশ্য যেসব খালে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ শেষ হয়েছে সেখানে রেলিং নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ এবং স্ল্যাব বসানোর কাজ চলমান। ইতোমধ্যে ২৫ হাজার স্কয়ার ফিট স্ল্যাব বসিয়েছি এবং ১৫ হাজার স্কয়ার ফিট বেষ্টনি বা রেলিং দিয়েছি। তিনি বলেন, প্রতিটি সংস্থা যদি সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলে নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়ানো যাবে।

মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী আজাদীকে বলেন, যেসব খালে রিটেইনিং ওয়াল হয়ে গেছে ওইসব খালে আমরা নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে দিচ্ছি। অনেক জায়গায় কাজ চলমান আছে। তিনি বলেন, চশমা খাল, মরিয়ম বিবি খাল, টেকপাড়া খালে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়েছি। রাজাখালী খাল-২, আজববাহার খাল ও গুপ্তাখালে চলমান আছে। আজববাহার খালে সপ্তাহখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

এদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনি না থাকায় ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২৫ দিনে অরক্ষিত খাল-নালায় শিশুসহ ৪ জন পড়ে গিয়ে আহত হন। এর মধ্যে ১৯ এপ্রিল রাতে খতিবের হাটের চান মিয়া সড়কের পাশে নয়া মির্জা খালে এক কিশোরী পড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন দ্রুত তাকে উদ্ধার করায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। এর আগে ১৫ এপ্রিল সকালে চান্দগাঁওয়ের বালুরটাল এলাকার একটি খালে এক নারী পড়ে যায়। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কালুরঘাট স্টেশনের কর্মীরা এসে তাকে জীবিত উদ্ধার করে।

এছাড়া ২৬ মার্চ নালায় বিকেলে পুরনো চান্দগাঁওয়ের পাঠানিয়া গোদা এলাকায় নালায় এক শিশু পড়ে যায়। স্ল্যাব না থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ২৭ মার্চ বহদ্দারহাটে নালায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক লোক পড়ে যান। ফায়ার সার্ভিস এসে তাকে উদ্ধার করে। অনেকে অবশ্য জানিয়েছেন, লোকটি ঝাঁপ দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকলে ঝাঁপ দেয়ার সুযোগ হতো না বলে মনে করেন তারা।

নিরাপত্তা বেষ্টনির অভাবে গত বছর সৃষ্ট দুর্ঘটনায় শিশু ও শিক্ষার্থীসহ মারা যান ৫ জন। বিভিন্ন সময়ে খাল-নালা অরক্ষিতের জন্য পরস্পরকে দায়ী করেছে চসিক ও সিডিএ। তবে গত বছরের নভেম্বর মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দুই সংস্থাকে দায়ী করা হয়েছিল। এছাড়া চসিক ও সিডিএর চরম অবহেলা দাবি করে সিডিএ চেয়ারম্যান ও চসিক প্রধান নির্বাহীসহ ১৩ জনকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছিল চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (সিসিবি)।

এদিকে গত ৬ এপ্রিল জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প নিয়ে চসিক-সিডিএ সমন্বয় সভা হয়েছিল। ওই সভায় দুর্ঘটনা রোধে খাল ও নালার পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণে জোর দেয় দুই সংস্থা। সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্ষা সমাগত। বর্ষার আগে মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়। বিগত সময়ে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। খাল ও নালায় পড়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে ফেন্সি (নিরাপত্তা বেষ্টনি) দেয়ার কাজ চলমান আছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অধীনেও কিছু কিছু জায়গায় করেছে। সেটাও চলমান আছে। উভয় সংস্থা যার যার অধীনে যেখানে কাজ চলছে সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বর্ষা মৌসুমের আগে ফেন্সি দিতে হবে। স্ল্যাব ভেঙে গেলে ঠিক করে দিতে হবে, যাতে অতীতের মতো দুর্ঘটনা না ঘটে।
ওই সভার পর দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ কাজে গতি না আসায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন সাধারণ লোকজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬