এক দশকে সামুদ্রিক কচ্ছপ কমেছে ৯০ ভাগ

কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন উপকূল

কক্সবাজার প্রতিনিধি | রবিবার , ১০ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত সী-টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ। এটি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিবেশে এই ধরনের প্রজাতির বেঁচে থাকার ওপর নির্ভর করে আরো বহু প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব। কিন্তু গত এক দশকে কক্সবাজার উপকূল থেকে হারিয়ে গেছে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি সামুদ্রিক কাছিম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এক দশক আগে সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলের অন্তত ৫৪টি পয়েন্টে শীত মৌসুমে ডিম পাড়তে আসত শত শত মা কচ্ছপ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্তত ১৩টি পয়েন্টে কচ্ছপের দেখা মিলছে না। বাকি পয়েন্টগুলোতেও ডিম পাড়ছে খুব কম।
বঙ্গোপসাগরে কচ্ছপের প্রাচূর্য বৃদ্ধির জন্য নেকম ও মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স নামের দুটি বেসরকারি পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা কঙবাজার উপকূল থেকে কচ্ছপের ডিমগুলো সংগ্রহ করে। এরপর হ্যাচারির মাধ্যমে বাচ্চা ফুটিয়ে সাগরে অবমুক্ত করে দেয়। এরপরও কঙবাজার উপকূলে ডিম ছাড়তে আসা কাছিমের সংখ্যা এক দশকে অন্তত ৯০ ভাগ কমেছে বলে মনে করেন নেকমের ব্যবস্থাপক জৈব সমুদ্র্রবিজ্ঞানী আবদুল কাইয়ূম।
তিনি বলেন, বিশ্বের বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির নানা পাখির আবাসের জন্য বিখ্যাত কঙবাজারের ‘ভার্জিন আইল্যান্ড’ সোনাদিয়া। দ্বীপটি সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্যও বিখ্যাত। এ দ্বীপের পূর্বপাড়া, পশ্চিম পাড়া, বদরখালীপাড়া, মগচর ও বেলেকের দিয়া-এই ৫টি পয়েন্টে ডিম পাড়ে কচ্ছপ। ছয়-সাত বছর আগেও এসব পয়েন্ট থেকে প্রতি বছর কাছিমের ডিম পাওয়া যেত ১০ থেকে ১২ হাজার। আর এ মৌসুমে পাওয়া গেছে মাত্র ৮শ ডিম।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দরিয়ানগর গ্রিনভয়েসের সভাপতি পারভেজ মোশাররফ জানান, কঙবাজার শহরের কলাতলী থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সৈকতে দুই বছর ধরে ডিম পাড়তে আসছে না কোনো কাছিম। অথচ একসময় কঙবাজার শহরের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে নিয়মিত ডিম পাড়তে আসত কয়েক প্রজাতির অসংখ্য কাছিম।
সারা বিশ্বে সাগরে প্রায় সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ আছে। তবে বঙ্গোপসাগরে জলপাই, সবুজ রঙা ও হঙবিল-এই তিন প্রজাতির কাছিম দেখা যায় বলে জানান নেকমের কাছিম সংরক্ষণ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শফিক। তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরের কঙবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে ৯৯ ভাগই অলিভ টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম। বাকি একভাগ গ্রিন টার্টল বা সবুজ রঙা কাছিম ও হঙবিল টার্টল।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের তালিকায় হঙবিল টার্টলের অবস্থান রেড লিস্টে। রঙিন খোলসের কারণে হঙবিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সামুদ্রিক কচ্ছপ হিসাবে বিবেচিত। এটি প্রবাল প্রাচীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা এবং এদের প্রধান খাদ্য স্পঞ্জ। প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে থাকা স্পঞ্জ খেয়ে এরা প্রবাল প্রাচীরগুলোকে বাড়তে সাহায্য করে। এরা দৈনিক প্রায় ৪৫ কেজি পর্যন্ত স্পঞ্জ খেয়ে থাকে। হঙবিল মাত্র কয়েক প্রজাতির স্পঞ্জ খেয়ে অন্য প্রজাতিগুলোকে বড় হতে সহায়তা করে, যাতে প্রবাল প্রাচীরে নানা প্রজাতির জীবন নিয়ে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠে। হঙবিল টার্টলের অভাবে সমুদ্রে ক্ষতিকর স্পঞ্জের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং ধীরে ধীরে প্রবালের শ্বাসরোধ করতে পারে। যার ফলে বর্ধনশীল প্রবাল প্রাচীরগুলো মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে। এছাড়া সবুজ কচ্ছপ সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো সবুজ ঘাসকে পুষ্টির যোগান দেয়। স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক ঘাসের ওপর নির্ভর করে আরো অনেক প্রজাতি।
বিজ্ঞানীরা জানান, হঙবিল প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরসহ সারা বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্রে পাওয়া যায়। তবে কিছু উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলেও বাস করে। হঙবিল ভূমধ্যসাগরে পাওয়া যায় না। এরা প্রবাল প্রাচীর, পাথুরে অঞ্চল, উপহ্রদ, ম্যানগ্রোভ, মহাসাগরীয় দ্বীপ ও অগভীর উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হঙবিলের ওজন ৪৫ থেকে ৯০ কেজি এবং উচ্চতায় ২-৩ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এই কচ্ছপগুলো ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত সৈকতে ও কম ঘনত্বে একাকী বাসা বাঁধে। এরা ২ সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ঋতুতে প্রায় ৪ বার বাসা বাঁধে এবং প্রতি বাসায় গড়ে ১৪০টি ডিম পাড়ে। তবে ২০০ টির বেশি ডিমও থাকতে পারে।
নেকম কর্মকর্তা ড. শফিক জানান, গ্রিন টার্টল ও হঙবিল সেন্টমার্টিনে বেশি দেখা যায়। সেন্টমার্টিনের ৫ পয়েন্টে কাছিম থাকে। তবে গ্রিন টার্টলকে মাঝেমধ্যে টেকনাফ ও হিমছড়ি সৈকতের কিছু পয়েন্টে দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আবদুর রউফ জানান, সামুদ্রিক কচ্ছপ পানির বাইরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা স্থলে ও সমুদ্রে একটি খাদ্যজালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে কাজ করে। এরা সৈকতের বালিয়াড়িতে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার মাধ্যমে সৈকতকেও পরিবেশগতভাবে সাহায্য করে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিমের খোসা মাটিতে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে, যা টিলা বা বালিয়াড়ির গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদকে পুষ্ট করে। আর এর মাধ্যমে বালিয়াড়িকে স্থিতিশীল করে এবং উপকূলীয় ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা করে।
কঙবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা জীবিত কাছিমের সংখ্যা এক দশকে নব্বই শতাংশের বেশি কমে গেলেও আগের তুলনায় মৃত কাছিম ভেসে আসার ঘটনা বেড়েছে। গত ৬ এপ্রিল টেকনাফ সৈকতের লম্বরী ঘাটে একটি মৃত কাছিম ভেসে আসে। এছাড়া গত মাসের শেষ দিকে হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসে ৫টি মরা কচ্ছপ। ২০২০ সালের জুলাইয়েও দুই দফায় প্লাস্টিক বর্জ্যের সাথে ভেসে আসে অন্তত ডজনখানেক মৃত ও কয়েক ডজন আহত কাছিম।
কী কারণে এমন ঘটনা ঘটছে? জানতে চাইলে কঙবাজার সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, জৈব সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, সাম্প্রতিককালে ছোট-বড় অসংখ্য ট্রলারের অবাধ বিচরণ ও প্লাস্টিক জালের কারণে কাছিমের স্বাভাবিক প্রজনন ও বিচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপকূলে ডিম পাড়ার উপযুক্ত পরিবেশ না পেলেও কাছিমের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে কী কারণে কঙবাজার উপকূলে কাছিমের বিচরণ কমেছে তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কারণ মানুষকেও সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে এই সামুদ্রিক প্রাণীটি পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপে
পরবর্তী নিবন্ধঅপরাধ করে জেলে, ফিরে এসে আরো বড় অপরাধ