এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়

ওমর কায়সার | শুক্রবার , ১ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

আশির দশকের কবিতার কোলাহলের ভেতর হঠাৎ যেন বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে অন্যরকম একটা সুর বেজে উঠল। আর আমরা তার বিমুগ্ধ শ্রোতা। প্রতিটি সুরের জন্মযন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি, শুনেছি তার প্রথম কান্না। হয়তো সারা রাত জেগে শাহিদ কবিতা লিখেছে তার ফিরিঙ্গি বাজারে কবিরাজ ভবনে। ভোরে উঠে মুখে একটু পানি দিয়ে চলে এসেছে আমার নন্দনকাননের বাসায় কবিতাটি শোনাবে বলে। রাতজাগা হাতের লেখাগুলো দেখলে মনে হয় যেন প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপি আমাকে উদ্ধার করতে দিয়েছে। হাতের লেখার জন্য তাকে কতবার বকা দিয়েছি। এমন হাতের লেখায় এই ছেলে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে সারা বোর্ডে প্রথম, এইচএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছে কেমন করে? এসব কথায় শাহিদ লজ্জায় লাল হয়ে যেত। বলত- কবিতা ঘোরের মধ্যে লিখি, পরীক্ষার খাতা লেখার সময় সচেতনভাবে লিখতাম, এত বিশ্রি হতো না। বলেই হো হো করে হাসত, আর আমার কাছ থেকে কাগজটি নিয়ে পড়তে শুরু করত কবিতা-

আমি বখে যাওয়া ছেলে, আমি ঢিল ছুঁড়ে মারি
মাছি ভন ভন এই রোঁয়া ওঠা জেনারেল যদি নাড়ে ল্যাজ
সেলিনা আখতার তুমি প্রস্তুত রেখো, দেখো ভুলো না আবার
প্রিয় নীল শাড়িটির নীল আঁচলের কাটা নীল কিছু ব্যাজে। (আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার )

শাহিদ স্বপ্ন দেখত একদিন এই পৃথিবীতে সাম্যবাদের বিপ্লব এসে পুঁজিবাদের সকল ষড়যন্ত্র, কৌশলকে নস্যাৎ করে দেবে। আমাদের সকল ব্যাকুলতা, আগ্রহ, অনীহা, কৌতুহল, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, জীবন-যাপন, সমাজ, রাজনীতি, কুটনীতি, মানুষের কপটতার কথা যার কবিতায় অভিনব ভাষায় উঠে আসত, সেই কবি কোথায় হারিয়ে গেল। বাংলার সমাজ আর কবিতার একসঙ্গে পালাবদল ঘটানোর এক অকল্পনীয় ভাবনা কাজ করত শাহিদের ভেতরে। সাম্যের একটা মনোবিশ্ব শাহিদ আনোয়ার নিজে নিজে তৈরি করে রেখেছিল তার মনের ভেতর। আর সেই বিশ্বের মানচিত্র আঁকার ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকত সে। একদিন বাস্তবের ভূমিতে সেই মানচিত্র ফুটে উঠবেই। এ-ছিল তার স্থির বিশ্বাস। আশির দশকে স্বৈরাচার আর ধর্মান্ধ রাজনীতি কবলিত এক ভূখন্ডের আর পেরেস্ত্রইকার পৃথিবীতে এক তরুণের এমন বিশ্বাস, স্বপ্ন বা ভাবনা খুব একটা বাস্তবসম্মত বা স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু শাহিদ আনোয়ারের মনোজগত সকল স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ৪৮ ঘণ্টার একটানা হরতালের পর পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবন অবস্থা। সেসময় সে ঘোষণা দিয়েছিল ‘আই হেইট দিস সো কলড স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।’
………
আই হেইট
এই রক্ত পুঁজময়, কালো ফোসকাবৃত
ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
রজঃস্রাবের মতো, থুতু ও কফের মতো
ব্যথাভারাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো
এই বাতিল জীবন
আমরা চাইনি ফেরৎ পেতে
চাইনা ফেরত পেতে।
(আটচল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন)

সমাজ, রাজনীতি, মানুষের অচল অবস্থা শাহিদকে বিচলিত করত, ব্যথিত করত, এসবের বিরুদ্ধে কথা বলত, কলম ধরত।
একটা পর্যায়ে এসে শাহিদ তার কবিতা আর জীবনকে সমার্থক করে ফেলেছে। ভাবনার প্রতিটি মুহূর্ত, জীবনের সব ঘটনা তার কবিতায় প্রতিফলিত হতো। শাহিদ থাকত ফিরিঙ্গিবাজারের কবিরাজ ভবনে। অধুনা বিলুপ্ত এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটির তখন শেষ অবস্থা। এর চুনচুরকি, পলেস্তারা খসে পড়ছিল। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের এই অনুপম নিদর্শনটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এর ধ্বংসস্তূপের ভেতর উঠে গেছে নতুন বাণিজ্যিক ভবন। কিন্তু ফিরিঙ্গিবাজারের কবিরাজ ভবন বাংলা কবিতার ঐতিহ্য হয়ে ফিরে এসেছে শাহিদ আনোয়ারের কলমে।
কবিতার পুরোটা জুড়ে জীর্ণ কবিরাজ ভবনের ছবি। চলচ্চিত্রের মতো এমন অনুপুঙ্খ বর্ণনা অনেক গদ্যের মধ্যেও সচরাচর দেখতে পাই না। নির্লিপ্ত নিরপেক্ষ বর্ণনা পড়তে-পড়তে পুরোনো ভবনটির জন্য আমাদের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। শুধু এই কবিরাজ ভবন নয়, এই ভবনের মানুষগুলোও কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে। যে কয়টি বাংলা কবিতা আমার খুব প্রিয় তার মধ্যে শাহিদের প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি কবিতাটি অন্যতম।
যখন বাসায় গেলাম
তুমি হাসপাতালে
যখন সমস্ত কেবিন খুঁজে কর্তব্যরত ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি
তুমি পরলোকে।
ফের বাসায় গেলাম
তুমি চিতায়
এবং যখন চিতায় গেলাম
তুমি পুড়তে পুড়তে অঙ্গার।
শুধু দুটি পোড়া পায়ের পাতা
দেখতে পেয়েছি
পরক্ষণে
তুমি পা গুটিয়ে নিয়েছ। (প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি)

শ্মশানের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন শাহিদের প্রতিবেশী আঁখি দাশগুপ্ত। কিন্তু তিনি বাংলা কবিতায় বেঁচে থাকলেন একজন প্রতিবেশী কবির কল্যাণে। আঁখির সঙ্গে শাহিদ আনোয়ারের কী সম্পর্ক ছিল? সেটার উত্তর আসলে সে নিজেও জানত না।
ভালোবাসা বলতে যা বোঝেন বিজ্ঞ লোকেরা
ওরকম কিছুই ছিলো না
তবে
কি যে ছিলো
দাঁড়াও আঁখি
আজকের মেঘলা রাতের সাথে
পরামর্শ করি!
(প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি)

দ্রোহ এবং প্রেম, বিপ্লব এবং ভালোবাসা এ-দুটো বিপরীতমুখী ্ল্ল্ল আশ্চর্য সহঅবস্থান আমরা লক্ষ করি শাহিদ আনোয়ারের কবিতায়।
একই সময়ে সে উচ্চারণ করছে-
আন্দোলনের ঐরাবতে কপালে লাল সিঁদুর পরাও, মাহুত হে
জমাট হাড়ের ওই পাহাড়ের মর্মমূলে হঠাৎ যাতে ধস নামে
নষ্ট ভিটির কষ্টখানি সারিয়ে তোলো নম্র হাতের ছাপ বিছায়ে মাহুত হে
আঁকতে হবে, টকটকে লাল সিঁদুর ফোঁটা, ইতিহাসের রাঙা মেঘের প্রস্তাবে।
(আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার )

যৌবনের আবেগ, প্রেমিকের কাতরতা, বিপ্লবীর সমাজ বদলের স্বপ্ন, দ্রোহীর ক্ষোভ, সুফির ধ্যান সবকিছু মিলিয়ে শাহিদ আনোয়ারের কবিতা। কিছু কিছু কবিতায় নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলেন শাহিদ।
বিপ্লবী শাহিদ আনোয়ার এবং কবি শাহিদ আনোয়ার দুজনের মধ্যে একটা বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। বিপ্লবের যে স্বপ্ন সে দেখত তার বাস্তবায়ন একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়, তার জন্য সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে এসে একটা মানুষকে কর্মী হয়ে কাজ করতে হয়। সেটা করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু তার জন্য জীবনের যে শৃঙ্খলা দরকার, দলের যে শৃঙ্খল গলায় পরতে হয়, তা সে পারেনি তার কবিসত্তার কারণে। আবার প্রথাগত সমাজের নিয়মকানুনের প্রতিও তার তেমন শ্রদ্ধা যৌবনকালে ছিল না। প্রচলিত ধ্যানধারণা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা থেকে শুরু করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবকিছুর প্রতি ক্রমশ সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। এ-কারণে পুরো শিক্ষাবোর্ডে মেধাতালিকায় শীর্ষে অবস্থান করেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগ দেয়নি।
ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ এম এ পাশ করেছে, সাংবাদিকতা করেছে শাহিদ। সাংবাদিকতা করেছে, অধ্যাপনা করেছে ঠিকই; কিন্তু শাহিদ আনোয়ার মনে করত নতুন শতাব্দীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় বিপ্লব হবে। সমাজতন্ত্র কায়েম হবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে। কিন্তু তার আগে ৮০ দশকের শেষের দিকে আমরা পেরেস্ত্রইকার কথা শুনতে শুরু করি। ৯০ দশকের শুরুর দিকে ১৯৯১ সালে গর্বাচেভ, ইয়েলসিনদের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। এই ভেঙে পড়াটা আমাদের অনেকের মনকে ভেঙে দিয়েছে। বেশি ভেঙে পড়েছিল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা কবি শাহিদ আনোয়ার।
বৈশ্বিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক হতাশাগুলো নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এরকম এক হতাশার সময়ে শাহিদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তার অসুস্থতা শরীরে নয়, মনের রোগেই তাকে বেশি কাবু করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম এই বন্ধুকে ফেরাতে হবে। যেভাবেই হোক তাকে একটা সুখবর দিতে হবে এই মুহূর্তে। আর জানি সামান্য পাওয়াতেই সে কত খুশি হয়ে যায়। তাকে বললাম, কীরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকলে হবে? তোর তো অনেক কাজ। তোর কবিতার বই বের করব আমি। কবিতার কাগজ মধ্যাহ্ন কবিতার বই বের করবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয়। পাণ্ডুলিপি তৈরি কর। দারুণ কাজ দিয়েছে আমার এই কথাগুলো। শাহিদ সত্যি সত্যিই হাসপাতাল থেকে ফিরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে। আমার সম্পাদিত কবিতার কাগজ মধ্যাহ্নর পক্ষ থেকে একটিই বই বের হয়, সেটি শাহিদ আনোয়ারের ‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’।
শাহিদের কবিতার বই চারটি। শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে, কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে, দাঁড়াও আমার ক্ষতি এবং বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে।
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে পড়ার পর মনে হয় স্বরবৃত্তে লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা শেষ করলাম। এখানে শিরোনামহীন প্রায় ৫০টি পদ্য আছে। প্রত্যেকটি পদ্যের শুরু ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ দিয়ে। স্বরবৃত্তে নৃত্যরত ছন্দের লাগাম ধরতে গভীর ভাববাহী ভারী শব্দের ব্যবহার কবিতাগুলোকে নিয়ে গেছে আমাদের এক অপার্থিব জগতে। সেখানে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা যুবকটি নেই। এ-যেন আরেক জন, শুঁড়িখানার নেশার ভেতর প্রেমমগ্ন এক মানুষ। একই ছন্দে, একই কথায় শুরু প্রতিটি পদ্যের শেষে দারুণ একটা ধাক্কা পাঠক অনুভব করেন এই কাব্যটিতে।
শাহিদ আনোয়ার পুরোপুরি পাল্টে গেল ‘দাঁড়াও আমার ক্ষতি’ তে এসে। তার চিন্তা, দর্শনগুলো কাব্যরূপ পেয়েছে। এই বইয়ে কখনো পার্থিব আবার কখনো অতিন্দ্রীয় চেতনায় আমাদের নিয়ে যায় অলৌকিক জগতে। বাস্তবতা আর অবাস্তবতার সীমারেখা মুছে দিয়ে অন্য এক মায়ার জগতে তার বিচরণ।
এই বইতে এসে দেখি কবি অনেক সংহত, দ্বিধাহীন, যে কোনো বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত স্থির এবং পরিণত। কবি আবেগহীন এবং দৃঢ় কণ্ঠে তার মতামতের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।

নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো কবি। এরকম বহু বিষয়ে তার বিবেকের, চিন্তার একটা অবস্থান কবি এখানে ঘোষণা করে। অবশ্যই সেটি কবিতার নান্দনিকতার সকল শর্তকে মেনেই। ছন্দের বন্ধনের ভেতর থেকে তার সীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দারুণ ক্ষমতা তার কবিত্বে। সবরকমের ছন্দের ছকে শব্দ নিয়ে খেলেছে তুখোড় শাহিদ আনোয়ার। আর পদে পদে অন্ত্যমিলের চমক সে সবসময় দিয়েছে। আবার গদ্যেও কবিতাকে নিয়ে গেছে সাবলীলভাবে। কখনো কখনো ছন্দকে ভাঙার সাহসও করেছে। তার ভাবনার সঙ্গে কেউ একমত হোক না হোক, কিন্তু কবিতা হিসেবে সেগুলো শৈল্পিক উৎকর্ষতার শীর্ষে উঠে পাঠক অন্যরকম এক অনুভূতির অভিজ্ঞতা পায়। ‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভের কবি এখানে অনেক শান্ত। ক্ষোভ নেই, দ্রোহ নেই, আছে যুক্তি আর দর্শন। আর জগতের অনেক বিষয় নিয়ে তার চিন্তার প্রতিফলন। ব্যক্তিগতভাবে শাহিদ তখন সংসারী। আরেক কবি সেলিনা শেলীর সঙ্গে তার ঘরকন্না শুরু হয়ে গেছে। শাহিদের বিয়ের অনুঘটক ছিলাম আমি। শাহিদ আর সেলিনা দুজনেই আমার বন্ধু। দুজনের পরিণয়ের ব্যাপারটি ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ঘটকের কাজ করতে হয়েছে।

শাহিদের কবিতা পাহাড়ের বুক চিরে অনায়াসে বেরিয়ে আসা স্বতঃস্ফূর্ত ঝরনার মতো। কারও আদেশে, পরামর্শে, অনুরোধে সে বানিয়ে কবিতা লেখেনি। অকৃত্রিমতা, মৌলিকত্ব তার কবিতার প্রধানতম গুণ। দাঁড়াও আমার ক্ষতি-তে আমরা দেখি ব্যক্তি শাহিদ আনোয়ার যে পিতা হয়ে উঠেছে তার অপূর্ব বর্ণনা।
স্যালাং ট্যানেলের নিকষ অন্ধকারে তাকিয়ে আছি
আমি ও আমার বউ
আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে
ট্যাংকে চড়ে আমাদের শিশু।
গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া আমার চারপাশে
উড়ে বেড়াচ্ছে একদল প্রজাপতি ও ঈশ্বরের দূত
তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের শিশু।
(আত্মজ)

শাহিদের সব কবিতার বইয়ের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে। এই বইয়ের কবিতাগুলোর বেশিরভাগ আশির দশকে লেখা। প্রায় সবকটি কবিতার পটভূমির সঙ্গে বন্ধুতার কারণে আমাদের মানসিক সংযোগ ছিল। এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাটির শিরোনাম ধাত্রী। শুধু এই বইয়ের নয়, আশির দশকে রচিত সেরা বাংলা কবিতাগুলোর একটি। এই কবিতায় জন্মের আকাঙ্ক্ষায় আকুল এক অজাত শিশুর প্রার্থনা শুনতে পাই, যে কিনা শুনেছিল সূর্য, রাত্রি, বিশ্ব দারুণ সুন্দর। সেই সুন্দর পৃথিবীর আলো সে দেখতে চায়, উৎস থেকে উঠে আসতে চায়, মিথ্যা থেকে উঠে আসতে চায়। মানুষের বেঁচে থাকার যে শাশ্বত আবেদন, মুক্তির যে অনাবিল আনন্দ তা এই কবিতা পড়ে অনুভব করি আমরা। মানুষের জীবন যে কত প্রেরণার, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই যে কত সুখের তা কবিতায় এক মানুষের জন্ম নেওয়ার কাতরতা থেকেই আমরা বুঝতে পারি। জীবনকে মাতৃগর্ভ থেকে প্রত্যক্ষ করার এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা শাহিদ আনোয়ার বাংলা কবিতার পাঠকদের দিয়েছে।
জীবনকে জন্ম নেওয়ার আগে থেকে দেখার এই অপূর্ব কৌশলের কারণে শাহিদ আনোয়ারের কবিতা হয়ে উঠেছে অনন্য। বিষয়ের অভিনবত্ব, ছন্দ, অন্ত্যমিল, শব্দের যথার্থ ও অবিকল্প উচ্চারণ এই কবিতা শাহিদ আনোয়ারকে সমসাময়িক অন্য কবিদের তুলনায় অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
শাহিদ আনোয়ার আর কবিতা লিখবে না, জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে সে চলে গেছে। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা আমরা মেনে নিতে পারছি না। এই স্বাভাবিকতার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- আমি ঘৃণা করি … করি… করি এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহিদ আনোয়ারের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধছনহরা কালী বাড়ি পরিচালনা পরিষদের বার্ষিক সাধারণ সভা