এক অনিকেত শিখা পালের কথা

অভীক ওসমান | শুক্রবার , ১৯ মে, ২০২৩ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

কলকাতায় এক দল পিশাচরূপী প্রেতাত্মারা আমাকে ঘিরে ধরে বলে তুমি রিফিউজি, তুমি রিফিউজি। আমি বলতে থাকি, না আমার ঠিকানা আছে, বাংলাদেশেনাকচিনি নদীপাড়েবাকখালী গ্রামে। নাকচিনি মায়াবতী জলে আমার শয়ন স্বপন।’ ১০ মে ২০২৩ তরুণ রাতে শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে এক অনিকেত শিখা পালের আর্তচিৎকার শুনেছিলাম। এটা নাট্যমঞ্চ রেপার্টরি প্রযোজিত সুমন টিংকু রচিত ও নির্দেশিত ‘ঠিকানার খোঁজে’ নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্রের কথা।

বয়সি ক্লান্তি ও প্রফেশনাল ব্যস্ততার কারণে আজকাল তেমন নাটক দেখা হয় না। জাহেদুল আলম আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। গত শতাব্দীর উইমেন চেম্বারের উদ্যোক্তা, ক্রিয়েটর নাসরিন সরওয়ার মেঘলাও অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মেঘলার পরিবারের অনেক গল্প আছেতার মাঝে একটি ‘হাইয়ান জাহাজটি যখন ফুটো হয়ে যায়, তা রেসকিউ করা চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তখন মেঘলার স্বামী ও দুই সন্তান এটি মেরামত করে সচল করে তুলে দেন।’ (সূত্র : জাফর আলম, সাবেক যুগ্মসচিব।)

অনিকেত হবার গল্প নতুন কিছু নয়। এটি সমগ্র বিশ্বের গল্প, নোবেল লরিয়েট ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। ভিক্টোরিয়ান এ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত ইরানের বেহরজ বুচানি এখন পাপুয়া নিউগিনির অস্ট্রেলিয়ার ডিসেবল সেন্টারে বসত স্থাপন করছেন। জার্মান সাহিত্যেও অনিকেতের কথা রয়েছে। সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দরের গল্প উপন্যাসে এটার বর্ণনা রয়েছে। হালের অরুন্ধতি রায়ের কথকতায়ও তা উঠে এসেছে। ১৯৪৭এর দেশভাগ হাসান আজিজুল হক সহ অনেকের কথায় উঠে এসেছে। ১৯৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, . শিরীণ আখতার রচনা করেছেন রোহিঙ্গা জীবনের গল্প।

এই নাটকের মূল গল্পটা ড. ইউসুফ ইকবাল দীপুর ভাষ্য থেকে জেনে নিই, “নাটকটি পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের কালো অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে রচিত এক হিন্দু রমণীর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে উৎখাত হওয়ার আবেগঘন করুণ আখ্যান। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরায় নেমে আসে আরেক অমানিশার কাল। ফলে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় শক্তির ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন, অবর্ণনীয় অপমান ও গ্লানিময় জীবন। তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিগ্রহনির্যাতনের পাশাপাশি যুদ্ধে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের ভূমি, ভিটেমাটি, সম্পত্তি দখলের মহোৎসবে মেতে ওঠে পরাজিত শক্তির দল।’

নাটকের শিখা পাল সেই দুঃখজনক মহোৎসবের অসহায় বলি। পিতৃপুরুষের ভূমি, ভিটেমাটি হারানোর মর্মন্তুদ বেদনার করুণ নাট্যভাষ্য প্রতিফলিত হয়েছে এনাটকের সংলাপে ও আখ্যানে।

একাত্তরের এক বিভীষিকাময় রাতে পাকসেনারা শিখাদের বাড়িতে আগুন দেয়। গুলি করে হত্যা করে তার বাবাকে। পরের রাতেই তারা প্রাণভয়ে পাড়ি জমায় কলকাতায়। তারপর শিখা স্থায়ী হয় সেখানে। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশেনাকচিনি নদীপাড়ে বাকখালি গ্রামে। নাকচিনির মায়াবতী জল তাকে শয়নে স্বপনে ডাকে। শৈশবের স্মৃতি আর বাপদাদার ভিটেমাটির টানে একদিন শিখা পাল ফিরে আসে স্বাধীন মাতৃভূমিতে। বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসে শিখা পাল লক্ষ্য করে তার বাড়ি দখলে নিয়েছে একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তরফদার। তার পূর্বপুরুষের স্মৃতিধন্য বাড়িতে লাগানো হয়েছে মাদ্রাসার সাইনবোর্ড। শিখার আগমনের সংবাদে বিচলিত হয় তরফদার। সরকারের উপরি মহলের শক্তিমান পাকপন্থী চক্রের সহযোগিতায় সে শিখা পালকে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচারকারী অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে। শিখা পালের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীনতাবিরোধী তরফদারের অনুগত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী প্রশাসনের তদন্ত এবং আদালতের পর্যবেক্ষণে স্পষ্টভাবে প্রমাণিতও হয়। রায়ে পাঁচবছরের কারাদণ্ড হয় তার।

শিখা পাল মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছে বাবাকে। স্বাধীন দেশে হারিয়েছে পিতৃপুরুষের বসতভিটা। ঠিকানার খোঁজে এসে হয়েছে দেশমাতৃকার শত্রু। কিন্তু, তার হৃদয়জুড়ে এখনো বাংলাদেশ। এখনো সে ভুলতে পারেনি শৈশবের স্মৃতিময় জন্মজনপদবাকখালি গ্রাম, নদী নাকচিনি, প্রতিবেশীরর মায়া আর বাদলের মত একান্ত স্বজন। যেভূমিতে সে আশ্রয় নিয়েছে সেটি তার নিজের নয়তার সত্তা ও অস্তিত্বজুড়ে যে ভূমি সেখানে সে ঠিকানাহারা। নিজস্ব ঠিকানায় এসে এই অন্তর্লীন বেদনা থেকে সে মুক্তি পেতে চেয়েছে। কিন্তু, জীবন থাকতে শিখা কখনো মুক্তি পায়নি। কারাগারে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে বেদনামুক্ত হয়। আমরা পাণ্ডুলিপিকার সুমন টিংকুর একটা ভাষ্য নিতে পারি, ‘নাটকের চরিত্রসমূহ এবং কাহিনী জীবিত বা মৃত কারো সাথে মিলে যাবে হয়তো।’ কিন্তু প্রসেনিয়ামের প্রথম দৃশ্যেই ‘আই শ্যালমেইক পলিটিক্স ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স।’ এই সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়েই জেনারেল জিয়া ক্যারেক্টারের অ্যাপেয়ারেন্স ঘটে। তবে “পাকিস্তান আমাদের ভাই। এই কথা আইজ যেমন সইত্য, আগামী একশ বছর পরেও সইত্য। কোন মুক্তিযুদ্ধই এই দেশের মানুষের বুক থিকা পাকিস্তানরে মুইছা দিতে পারব না”সামপ্রদায়িক আগ্রাসী এই মন্ত্রে উদ্দীপ্ত ‘পাকি’ আত্মারা আবারও বাংলায় ক্ষমতাবান হয়। ইতিহাস প্রত্যক্ষ করে “এই দেশ যতটা না সিরাজের, তার চেয়েও বেশি মীর জাফরের”। (বাদলের সংলাপ) ‘আর যখন মানুষ পরিস্থিতির শিকার হয়, যাকে বলতে পারিসিটিউশনাল কম্পালশন।’ (শাঁওলি মিত্র, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ) এই প্রেক্ষাপটে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বাদলের সংলাপে পজিটিভনেগেটিভ অনেক কথাই ওঠে আসে। বর্তমান কনটেন্টে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি বড়ই বেদনাদায়ক।

তবে পাণ্ডুলিপিকার ও নির্দেশক হিসেবে সুমন টিংকুর কিছু ভালো লাগার দিক পেশ করছি। সামপ্রতিককালে গরিষ্ঠ নাটক তৈরি হচ্ছে মিউজিক্যাল ও মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। টিংকু এখানে তা করেননি। তিনি কখনো কাব্য নাটকের ঢঙে কখনো সাদামাটা সংলাপে নাটকটি রচনা করেছেন। দর্শককে ভালোই কমিউনিকেট করতে সক্ষম হয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে শিখাপাল একাত্তরের শরণার্থী হয়ে চলে যান। পুলিশের জেরায় তিনি চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ঠিকানা বলেন। ভারতীয় পাসপোর্টধারী শিখা পাল বাংলাদেশী এক এনজিওর আমন্ত্রণে নিজ গ্রামে আসেন। একই সাথে তিনি তার ভিটেবাড়ি ফিরে পাবার চেষ্টা করেন। আরগুমেন্ট না করলে নাটকের এই জটিলতা সৃষ্টি পাণ্ডুলিপিকারের সবল দিক। চরিত্রসমূহের ইনডিটেইলস সংলাপ থেকে সংলাপ রচনার মধ্য দিয়ে কাহিনীকে বিলম্বিত করতে পেরেছেন। পাণ্ডুলিপিকার বার বার শত্রু সম্পত্তির আইনের কথা বলেছেন। মূলত ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রুলস অফ ডিফেন্স অনুযায়ী শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণয়ন করেন। একাত্তর পরবর্তী পর্যায়ে তা অর্পিতসম্পত্তি আইন নামে সংশোধিত হয়। পাঠক চাইলে এই তথ্যটি যাচাই করে নিতে পারেন।

সূচনায় বলা হয়েছে এই নাটকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রুপের শিল্পীরা একটা টিম করে অভিনয় করেছেন। এই সৌহার্দ্যকে একজন নাট্যকর্মী হয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছি। শিখা পাল চরিত্রের মেঘলা নিজে স্বীকার করেছেন তিনি নিজে এলিট ক্লাবের মঞ্চাভিনেত্রি। ‘ঠিকানার খোঁজে’ বাইরের মঞ্চে তার প্রথম নাটক। তার বয়স ও ফিগার শিখা পালের সাথে বেশ মানিয়ে গেছে। বসতবাটী ও নিজপ্রেম ফিরে পাবার বিভিন্ন আর্তিতে দর্শককে ইমোশনাল করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে পুকুড় পাড়ে বাদলের মায়ের সাথে নাড়ু খাওয়ার সময় বাঙালি নারীর একটি দুঃখময় দৃশ্য ধরা পড়ে। তবে মাঝে মাঝে সংলাপ প্রক্ষেপণে এমনকি নাটকটি যখন তাকে দিয়েই কনক্লুড করা হয়েছে তখন দু’একটা সূক্ষ্ম ত্রুটি ধরা পড়েছে। এই বহুমাত্রিক ক্রিয়েটিভ মেঘলাকে আগামীতেও মঞ্চ নাটকে অধিকতরভাবে দেখবো আশা করি।

তরফদারের স্ত্রী চরিত্রে সাবিরা সুলতানা বীণা ওযুর বদনা হাতে প্রথম এন্ট্রিতেই দক্ষ অভিনেত্রীর পরিচয় দিয়েছেন। অতীতে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মঞ্চে পেতেছি সংসার।’ তিনি যখন দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘হক কাজ করে না তার আবার নামাজ।’

তরফদার চরিত্রে আমাদের প্রবীন বন্ধু সুজিত দাশ বাপ্পী খুব দাপটের সাথে অভিনয় করেছেন। তার লাঠি যেমন শক্ত, তেমনি অভিনয় সক্ষমতা দীপ্ত। আমাদের সতীর্থ বিকিরণ বড়ুয়া কলোকুইকাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডিবি পুলিশ অফিসারের চরিত্রে কমেডি মিশিয়ে ভালো পারফরমেন্স করেছেন। বাদলের চরিত্রে শামসুল কবির লিটন একটু কমার্শিয়াল লুক মনে হয়েছে। বাদলের অনেকগুলো সংলাপে বেদনার্ত মুক্তিযোদ্ধার নিজের কাছেও মহান একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩এ এসে দাঁড়িয়ে এটি আমাদের কাছে মর্মান্তিক বলে মনে হচ্ছে। পুলিশ অফিসার সহ মো. সাইফুল ইসলাম, রেজাউল করিম আলমগীর, মাহমুদুল ইসলাম রনি, তাসনিমুল হাসান, জুহায়ের আলম রিহাম তাদের অভিনয়ও ভাল লেগেছে। নাটকের শেষে একটা আশাবাদী সংলাপ দেওয়া হয়েছে যে, ভিটেবাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে এবং সেখানে বাদল অলকানন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে। নাটকটি প্রয়াত শাহীনুর সারোয়ারকে উৎসর্গ করা হয়েছে। জয় হোক নাটকের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসা এক বিষণ্ন ইরেজার
পরবর্তী নিবন্ধ৬৫দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধে কুমিরায় জনসচেতনতা সভা