এক অদৃশ্য নষ্ট সুতায় বন্দী!

আলী আদনান | শনিবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি ক্রিকেটার তানজিম সাকিবের নারীবিদ্বেষী একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই মুহূর্তে এটা অন্যতম ভাইরাল ইস্যু। ক্রিকেটার হিসেবে তিনি যতোটা না আলোচনায় ছিলেন তার চেয়ে বেশী আলোচনা বা সমালোচনার স্থান দখল করেছেন এই একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। কুরুচিপূর্ণ এই স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হওয়ার পর তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকের কাছ থেকে বেশ সমর্থনও পাচ্ছেন। বিভিন্ন নিউজলিংকের কমেন্ট বক্স তার অন্যতম প্রমাণ।

স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হওয়ার পর যেটা প্রমাণ হয়েছে সেটা হলো তানজিম সাকিব যে চিন্তা লালন করেন, তার যে দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি, তিনি যে চোখ দিয়ে সমাজকে দেখেনসেই চিন্তা, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি এই প্রজন্মে শুধুমাত্র তার একার নয়। এমন অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ চিন্তাকে আগলে রেখে, নারী বিদ্বেষকে ধর্মের পোশাকে ঢেকে প্রজন্মের বড় একটা অংশই অন্ধকার গলিতে হোঁচট খেতে খেতে এগুচ্ছে। ঘুনপোকায় খাওয়া কাঠের আবরণটা ভেঙ্গে গেলে দগদগে ঘা বেরিয়ে আসে মাত্র!

তানজিম সাকিবের অসংখ্য অন্ধ সমর্থক যে বাক স্বাধীনতার দোহাই দিচ্ছেন, এমন স্ট্যাটাস কি বাক স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে? আপনার যে বক্তব্য বা যে লেখা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা তৈরির পাশাপাশি সমাজকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার উস্কানি দেয়, দীর্ঘদিন ধরে আলোর পথে সভ্যতার যে অবিরাম যাত্রা, সেটা ঠেকানোর অপচেষ্টা কি কোন ‘স্বাধীনতা’?

তানজিম সাকিব শুধুমাত্র নারী বিদ্বেষী স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাই নয়। তার বিভিন্ন স্ট্যাটাসে তিনি সগর্বে দাবি করেছেন, তিনি জাতীয় সংগীত বিশ্বাস করেন না। তিনি রাষ্ট্রীয় কোন দিবস মানেন না। তার ক্রিকেটার পরিচয়টি না হয় বাদই দিলাম। রাষ্ট্রের কোন নাগরিক কি এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে পারে? এমন মানুষ কি বিপথগামী বা বিপদগামী প্রজন্মের প্রতিনিধি নয়? তার এমন চিন্তার জন্য রাষ্ট্রের যে উপকরণগুলো দায়ী তা নির্র্মূলে রাষ্ট্র কি তার নির্লিপ্ততার দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে?

আজকের সময়টা কোথায়, পৃথিবী জ্ঞানবিজ্ঞানে কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে, সে অনুযায়ী আমরা কোথায় পড়ে আছি, ধীর পায়ে এগিয়ে যাওয়ার যে প্রচেষ্টাসেক্ষেত্রে এমন ধারণা পোষণ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কতোটা ক্ষতিকরতা নতুন প্রজন্মকে অবহিত করতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকা কী? ফুলে ফেঁপে দৃশ্যত ঢোল হয়ে গেলেও উন্নয়নের যাত্রায় ভেতরটা যে ফাঁপা, তাই কি মিথ্যে?

এটি এমন একটি স্ট্যাটাসযেখানে তিনি ধর্মীয় কোন রেফারেন্স দিতে পারেননি। কিন্তু তার অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী এটাকেই ‘ধর্ম’ ভেবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টা করছে। এই যে প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা, নানারকম পচা দুর্গন্ধযুক্ত চিন্তাকে ধর্মের মোড়কে বাজারজাত করার অপচেষ্টাএটা কতোটুকু সচেতন বা অসচেতনভাবে, তা নিয়ে তর্ক করার সময় এসেছে। তবে সচেতন বা অসচেতন যাই হয়ে থাকুক না কেন, এটাকে নিছক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেও আজকাল নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বেশ খোঁজ খবর নেওয়া হয়। ক্রিকেটাররা তার বাইরে হবেন কেন? বিশেষ করে যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে? যাদের অসংখ্য ফ্যান ফলোয়ার থাকে! যাদের লাইফ স্টাইল থেকে চিন্তা পর্যন্ত প্রভাবিত করে অসংখ্য তরুণকে। বিসিবি কি শুধুই একটা গৎবাঁধা প্রতিষ্ঠান? তাদের নীতি নির্ধারকদের আদর্শিক জায়গাটা কী? একটা ছেলে মাঠে ভালো পারফর্ম করতে পারে, এটাই কি একমাত্র যোগ্যতা? তাহলে কি কেউ একজন ভালো অস্ত্র চালাতে পারলেই সে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন বাহিনীতে চাকরি পেয়ে যাবে?

তানজিম সাকিবের দেওয়া স্ট্যাটাসটির পক্ষে লাখ লাখ সমর্থকের উপস্থিতি প্রমাণ করে এ প্রজন্ম ভালো নেই। তারা জানেই না, তারা কী চাচ্ছে, কেন চাচ্ছে, কীভাবে চাচ্ছে। কর্মজীবী নারীর প্রতি বা সফল নারীর প্রতি তাদের জিঘাংসু মনোভাব এটাই প্রমাণ করে, তারা নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাকে নানা যোগ বিয়োগ না মেলায় তার অবচেতন মন দায়ী করছে কর্মজীবী নারীকে এবং সেটার বৈধতার রূপ দিতে বা সমর্থক বাড়াতে নষ্ট রাজনীতির মতো এই ইস্যুতেও ব্যাকআপ রাখা হয় ধর্মকে। পার্থক্য হলো রাজনীতিবিদরা ধর্মকে অপব্যবহার করে সচেতনভাবে। আর প্রজন্ম একই কাজ করছে (হয়তো) অসচেতনভাবে। তবে দিনশেষে এই একটি স্ট্যাটাস প্রমাণ করে দিয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের সাংস্কৃতিক যাত্রা, আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতি, আমাদের গণমাধ্যম সবই কোন এক অদৃশ্য নষ্ট সূতায় বন্দী!

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখতে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে
পরবর্তী নিবন্ধআজ কনীনিকা শবনম আসগারীর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী