একালের গল্প সেকালের ঘটনা

মু. সিকান্দার খান | রবিবার , ১৪ মার্চ, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

পরিত্রাণ

স্কুলে পরীক্ষার সময় আসতে আসতে ছাত্রদের উপস্থিতি যেমন করে বেড়ে যায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের প্রতি ছাত্রদের মনোযোগও তেমনি বাড়তে থাকে। আমরা মনে করতাম সেসময়ে যেসব পাঠদান করা হতো সেগুলি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে অবশ্যই স্থান পাবে। তাছাড়া আগের শ্রেণীর পরীক্ষাগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে এক এক শিক্ষকের প্রশ্নপত্র তৈরি করার ব্যাপারে এক এক ধরনের ঝোঁক মোটামুটি আঁচ করা যেত। তখন পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যসূচি শ্রেণিকক্ষে পুনরধ্যয়ন করার রেওয়াজ চালু ছিল। শিক্ষক সারাবছর বইয়ের যতখানি পাঠদান করেছেন, তার মধ্যে কোথায় কোন অংশ খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা পুনর্বার ব্যাখ্যা করে বলতেন। তাঁদের এরকম বক্তব্য থেকে আমরা পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে আলোকপ্রাপ্ত হতাম। কোন কোন পরিচ্ছেদ এবং তারও কোন কোন অংশ প্রশ্নপত্রে অন্তর্ভুক্ত হবার কতখানি সম্ভাবনা তা যাচাই করতে পারতাম। এ কারণে সেসময়ের ক্লাসগুলো আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো।
সেবার ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষা সপ্তাহ দুয়েক পরেই শুরু হবে। এখনকার সবগুলো ক্লাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অন্তরঙ্গ বন্ধু ক’জন সবগুলো বিষয় ভাগ করে নিয়েছি, কে কোন বিষয়ের প্রয়োজনীয় অংশের সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো তালিকাভুক্ত করব। পরে একসঙ্গে বসে যাচাই করে নেব। একদিন দুপুর ছুটির সময় আমরা বসেছি। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে কখন যে বিরতির সময় পার হয়ে যাচ্ছে খেয়াল হয়নি। তখন স্কুলের দুপুরে ছুটিতে সবাইকে জোহরের নামাজের জন্য প্রার্থনা কক্ষে যেতে হতো। কোনো কোনো দিন রোল কল করে অনুপস্থিত ছাত্রদের পঞ্চম পিরিয়ডের ক্লাসে জবাবদিহি করতে হতো। মুসলিম হাই স্কুলের দুপুরের সংক্ষিপ্ত অবকাশে কমনরুমে নানা খেলারও আয়োজন ছিল। আমার টেবিল টেনিসের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। প্রত্যেক দিন দুপুরে ছুটির ঘন্টা পড়তে না পড়তে ছুটতাম কমন রুমে। কোন কোন দিন যাওয়া মাত্রই সুযোগ পেয়ে যেতাম। কোন কোন দিন আবার বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে হতো সুযোগ আসার জন্য। পরীক্ষার আগে আগে দুপুর ছুটিটা নামাজ, খেলা আর প্রশ্ন তৈরির মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হতো।
সেদিন ভাগ্য ভালো। খেলার সুযোগ পেয়ে গেলাম পৌঁছা মাত্রই। খেলাও ভালো হলো। দুজনের সঙ্গে জিতেছি। সেখান থেকে আমাদের গ্রুপের আলোচনা সভায় যোগদান করেছি। আমার আগে অনেকে পৌঁছেছে। তারা পরীক্ষার জন্য বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ আর কবিতার ব্যাখ্যা অংশগুলো চিহ্নিত করার কাজে ব্যস্ত। আমি হন্তদন্ত হয়ে যোগদান করেছি। সবাই কাজের মধ্যে ডুবে আছি। এমন সময় একজনের মনে পড়ে গেল আমাদের জোহরের নামাজ বাদ পড়ে যাচ্ছে। আরেকজন চাইল ব্যাখ্যার অংশগুলো শেষ করে উঠতে। আমরা প্রায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। যারা কাজ শেষ করে যেতে চায়, তাদের যুক্তি হলো ইংরেজি বাংলার কাজ আজ শেষ করতে না পারলে কাল-পরশু ইতিহাস ও ভূগোল ধরা যাবেনা। তার জন্য পরীক্ষার আগে সময় আর নাই।
নিজেদের এরকম দুপক্ষের বাকবিতণ্ডার মধ্যে আজকে এখানে অসমাপ্ত রেখে উঠে যাওয়ার পক্ষে একজন বলে উঠল- আজ আমাদের নামাজ প্রায় মিস হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসের শাস্তি পাওয়ার চেয়েও পরীক্ষা সামনে রেখে আল্লাহর কাজে হেলাফেলা করা ঠিক নয়। সে বলে ফেলল, এতে আমাদের এই কাজ আল্লাহ পণ্ডশ্রম করে দেবেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এগুলোর কোনটাই পাওয়া যাবে না। অন্য পক্ষের একজন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলে উঠলো, ‘আল্লাহর মন তোর মত ছোট নয়। তাহলে উনি আল্লাহই হতে পারতেন না’! তার এই বক্তব্যে আমাদের মধ্যে একরকম নীরবতা নেমে এলো। বই থেকে মুখ তুলে পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি শুরু হল। মনের মধ্যে বাজতে থাকল ‘আল্লাহর মন এত ছোট নয়’। আমাদের উভয়পক্ষের বাকবিতণ্ডা আর অগ্রসর হয়নি। মনে পড়ে বই গুছিয়ে নিয়ে সবাই প্রার্থনা কক্ষের দিকে ছুটলাম। দেরি হলেও যথারীতি প্রার্থনা শেষে পঞ্চম পিরিয়ডের ক্লাসও সময়মত করেছি।
পরের দিনগুলো একই রকম পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য প্রশ্ন বার করার কাজে বসেছি। প্রার্থনার সঙ্গে এ বৈঠকের সময়ের জন্য কোন বিপত্তি ঘটেনি। সচেতনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছি। প্রথম দিনের ঘটনাটা মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারিনি। এভাবে দিনগুলো পার হয়ে পরীক্ষায় বসার সময় এসে গেলো। পরীক্ষার জন্য বসেছি। ঘণ্টা বেজে উঠলে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রশ্নপত্র হাতে এলে যথারীতি কপালে ঠেকিয়ে দুরুদুরু বুকে তাতে চোখ বুলাই। যুগপৎ আশ্চর্যান্বিত ও আনন্দিত চিত্তে দেখলাম আমাদের বাছাইকৃত প্রশ্নগুলো প্রায় হুবহু তাতে আছে। এরপরের বিষয়েও অনেকটা একই রকম প্রশ্নপত্র পেয়েছি। পরে নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে গল্প আড্ডায়ও মেতেছি। আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছি আল্লাহভীতির চেয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা কম ফলশালী নয়।
জীবনযুদ্ধে প্রায় সকলক্ষেত্রে সাংসারিক কর্তব্য আর পারলৌকিক কর্তব্যের মধ্যে বহুসময় সংঘাত হয়েছে। শুধু সময় নয়, সাধ্যও অনেকসময় এরূপ উভয়সঙ্কটের জন্য দায়ী। সবসময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে কি পেরেছি? উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন মনে এসেছে, ‘কেউ কি পারে’?
সবার জন্য উত্তর খোঁজা আমার সাধ্যের আওতায় নেই। শুধু নিজের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি, এখনও আমার অষ্টম শ্রেণীর সরলমনা বন্ধুটির মতো, ‘আল্লাহর মন অত ছোটো নয়’ আপ্তবাক্যে পরিত্রাণ খুঁজি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ জেলা তাঁতী লীগের সভা