একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়

আহমাদ মোস্তফা কামাল | শুক্রবার , ২২ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তানের দেয়াল ঘেঁসে অতি সাধারণ একটা কবরে যখন আপনাকে শুইয়ে দেওয়া হলো, তখন আশেপাশে আপনার এককালীন সতীর্থদের প্রায় কাউকে দেখা না গেলেও, ভিড়ের কমতি ছিল না মোটেই, বরং জায়গাটা হয়েছিল লোকে-লোকারণ্য। তারও আগে যখন বাংলা একাডেমির চত্বরে এনে ঘণ্টাখানেকের জন্য আপনাকে রাখা হয়, তখনও মানুষের ভিড় সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এত লোক এলো কোত্থেকে? কারা এরা? চেহারাসুরত কাপড়চোপড় দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না যে, এই লোকগুলোর সঙ্গে আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে আপনার। আমি খুব নিরিখ করে চেনার চেষ্টা করি, কিন্তু কখনো-কখনো কাউকে-কাউকে একটু-আধটু চেনা মনে হলেও আগে কোথায় দেখেছি বা আদৌ দেখেছি কি না বুঝে উঠতে পারি না। প্রায় মেলা-ভাঙা ভিড়ের মতো এত এত মানুষের হদিস করার উপায় কী? উপায়ান্তর না দেখে আমি একবার গিয়ে আপনার মুখ দেখার কথা ভাবলেও, সাহস করে উঠতে পারি না। একজন প্রাণবন্ত মানুষের ওরকম নিশ্চুপ পড়ে থাকা সহ্য করা কঠিন। আপনি আর নেই, এ-কথা ভাবতেও পারছি না! এই শহর কি জানে, তাদের কত বড়ো একজন বান্ধব আজ চলে গেলেন? পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসে আপনি তো সারাটি জীবন এখানেই পার করে দিলেন! শেকড়চ্যুত মানুষ, উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছেন, আমৃত্যু একটা স্থায়ী ঠিকানাও জোটেনি কখনো; ভাড়া বাসা, এখানে দুদিন তো ওখানে দুদিন, কী যে মর্মান্তিক এই ভাসমান জীবন! তবু কী যে প্রেম নিয়ে এই শহরের খুঁটিনাটি বর্ণনা করতেন আপনি, কী গভীর মমতায় ধারণ করেছিলেন এই দেশকে! কোনোভাবে যদি আপনার হৃদয়টা দেখা যেত, হয়তো দেখতাম, সেখানে লেখা একটিই শব্দ- বাংলাদেশ। কিন্তু এই যে এত এত মানুষ, এরা কেউ তো এখানকার নয়!

এই শহরের মানুষ দেখলেই চেনা যায়, তাদের চোখভরা থাকে ক্রুরতা, ঠোঁটে হাসির বদলে বিদ্রুপ। তাহলে এরা কারা, কোত্থেকে এসেছে, আপনাকে এরা কীভাবে চিনতো? বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আমি এমন একজনকে খুঁজতে থাকি যে হয়তো এদেরকে চিনে উঠতে পারবে, বা সবাইকে না চিনলেও একটা সূত্র ধরিয়ে দিতে পারবে। ঠিক তখনই আহসান ভাই এলেন- তাঁকে চিনতাম না আমি, তিনিই খুঁজে নিলেন আমাকে, আর নিজেকে যখন পরিচয় দিলেন ইছাপুরা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে, তখন প্রায় চমকে উঠলাম। ইছাপুরা! আপনার কাছে কতবার শুনেছি ইছাপুরার গল্প! কালো বরফ, প্রতিদিন একটি রুমাল আর ইছাপুরা। ইছাপুরা কলেজ। সেখানে সবুজ চাকরি করে, অনিচ্ছুক চাকরি, শহরে ফিরে আসতে চায়, পারে না; কিংবা কালো বরফের আবদুল খালেক, দেশবিভাগের ফলে উদ্বাস্তু, নিজের শৈশবে ডুবে থাকা আবদুল খালেক। তার বউ রেখা। নরহরি ডাক্তার। পরাণ মাঝি। মা। মণি ভাইজান। গিরীবালা। রানুদি। মাধু। আমি যেন এবার সবাইকে চিনে উঠতে পারছি। ওই তো হৈরব মাটিতে পা বিছিয়ে কাঁদতে বসেছে- আর ওদিকে ভৈরব তার ভাঙা ঢোল নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুলুকে দেখা যাচ্ছে ওই দিকে, যুদ্ধের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তার জীবন, অথচ মুখে সেই অবিস্মরণীয় উক্তি- ‘মানুষ বড়ো ভালো… মানুষ বড়ো সুন্দর।’ মণি ভাইজানকে দেখি, কফিনের কাছে গিয়ে হম্বিতম্বি শুরু করেছেন- ‘এই বটু ওঠ, নিজের মৃত্যু বিবরণটা না লিখেই যে যাওয়ার আয়োজন করেছিস, ঘটনা কী! গাধা কাঁহিকা! এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? লিখতে জানিস, লিখে ফ্যাল।

আমি তো লিখতে জানলে কবরে যাওয়ার আগে নিজেরটা নিজেই লিখে যেতাম।’ মামাবাড়ির সেই আশ্চর্য শান্ত তিরতিরে পুকুরের গভীর গোপন তলদেশে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে থাকা অঞ্জু আর মঞ্জুও দেখি উঠে এসেছে তাদের কোমল-নিষ্পাপতা নিয়ে! বুড়ো ওবাদকে দেখি তিনটে শিশুর লাশ নিয়ে এসে কবর খোঁড়ার আয়োজন করছে! বাংলা একাডেমির ওই অভিজাত প্রাঙ্গণ ওই তিন নাম-না-জানা শিশুর লাশ গ্রহণ করবে কেন? কিন্তু বুড়ো ওবাদকে সেটা বোঝাবে কে, সে তার কাজ করেই যাচ্ছে, আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হৈরব, ভৈরব, দয়া, গণিমিয়া, আবুল হোসেন, এনামুল, জেবুন্নেসা, আনু, বুলু, বুড়ো ওবাদ, জামশেদ, হলধর নিকারী, সপুরা, পরাগল, নুনি, তপা, নজরুল, চৈতন্যদাস, ভগি, মিনুমামী, টুপু, সদুমামা, সবুজ, রেখা, আলতাফ, পোকা, মণিভাই, টিপুভাই, রানিবুবু, ঝুমি, পুঁটি, পানু, আবদুল খালেক, রেখা, টুকু, নরহরি ডাক্তার, কেনারাম কাকা, করুণা দিদিমণি, গিরিবালা, ফেদু ফকির, ছবিদি, নগেন স্যাকরা, মাধু, মরণমাঝি, খোকা, রঞ্জু, নীলাভাবি, মুরাদ, রাজীব ভাই, লুলু চৌধুরী, রহমান, আসাদ, মওলা, নুরুদ্দীন, রেহানা, ইয়াকুব, মুকুল, টুনু, হিরণ, ইদ্রিস কম্পোজিটর, ফাৎনা মিস্ত্রী, ফকিরচাঁদ সর্দার, জলিল বুকি, কেরামত আলী, কামরান রসুল, কোবাত আলী, আকদ্দস, কাঞ্চন, তৌহিদ মণ্ডল, অনু, লামা, ফকিরা, টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়চান, সরুদাসী, জয়নাল, মনোহর, আলমাছি বিবি, মনোয়ার, আম্বিয়া… আরো কত কত লোক। আপনার চরিত্ররা বইয়ের পাতা থেকে সব উঠে এলো নাকি আজকে? ওদিকে খোকা একা- এই ভরদুপুরে সে এমন এক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে যেন তার চোখে সন্ধ্যা নেমেছে। আর খোকাকে দেখতে দেখতে আমার কানে বাজে আপনার কণ্ঠ- ‘দেশভাগের সময় আমরা এখানে আসতে চাইনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতেও পারিনি। সামপ্রদায়িক ভেদবুদ্ধি একসময় এমন এক অবস্থায় পৌঁছালো যে চলে আসতে বাধ্য হলাম। এখন বলো, যে জন্মভূমি তার সন্তানদের দেশত্যাগে বাধ্য করে সেই জন্মভূমির প্রতি কোনো প্রেম থাকে?’ কত কত গল্প যে করতেন আপনি! দেশভাগ, দেশত্যাগ, নতুন দেশে বসতি স্থাপন, আর এসবকিছুর মধ্যে দেশত্যাগি মানুষগুলোর ভেতর থেকে ভেঙে পড়ার গল্প, কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারার গল্প, আজীবন এই দেশে বাস করেও পরবাসী হয়ে থাকার গল্প। আপনার কণ্ঠ থেকে তীব্র ক্ষোভ-বেদনা-অভিমান ও যন্ত্রণা ঝরে পড়তো। অবশ্য নিজেকে দ্রুতই সামলে নিয়ে শুরু করতেন নতুন গল্প।

অসামান্য এক কথনভঙ্গি ছিল আপনার। শুধু মুখের কথায় দৃশ্যমান করে তুলতেন পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের ঢাকার ছবি, সাহিত্যজগতের ছবি, ওপার বাংলার ছবি। আর এসব গল্পে বারবার ফিরে আসতো আপনার শিক্ষক শহীদ সাবের আর আপনার মায়ের গল্প। অসামান্য প্রতিভাবান শহীদ সাবের অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলেন আর হারিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্য জগৎ থেকে, শেষ পর্যন্ত শহীদ হলেন একাত্তরে- এসব গল্প আপনার কাছেই তো শুনেছি। বহুবার বলেছেন- ‘একাত্তরে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর, সম্ভবত ২৭ বা ২৮ মার্চ হবে, কারফিউ একটু শিথিল করেছে, আমি তোমার ভাবীকে বড়োভাইয়ের বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছি। যাওয়ার পথে সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁসে শহীদ সাবেরকে বসে থাকতে দেখলাম। প্রায় উলঙ্গ, চেহারা উদভ্রান্ত। আমার কেন যেন মনে হলো, তিনি আর বাঁচবেন না। সময়টাই তো অমন ছিল, বেঁচে থাকাই ছিল বিশেষ ঘটনা। পশুপাখির মতো মানুষ মারছে পাকিস্তানিরা। তোমার ভাবীকে বললাম, ‘স্যার মনে হয় আর বাঁচবেন না, উনাকে উদ্ধার করা দরকার। তোমাকে রেখে ফিরে যাওয়ার সময় স্যারকে নিয়ে যাবো।’ কিন্তু ফেরার পথে তাঁকে আর পাইনি। এর মাত্র দুদিন পর সংবাদ অফিস পাকিস্তানিরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। শহীদ সাবেরও পুড়ে মারা যান। জানো, আমার কেবলই মনে হয়, আমি যদি তাঁকে ওইদিন নিজের বাসায় নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে তিনি এভাবে মরতেন না। তাঁর মৃত্যুর জন্য আসলে আমিই দায়ী, বুঝেছ!’ ব্রেকডাউন অব কমিউনিকেশনের কথা বলেছিলেন একবার- ‘আমাদের প্রায় সবার জীবনে ঘটে, আমার জীবনেও ঘটেছে, বোধহয় শহীদ সাবেরের জীবনেও ঘটেছিল। নইলে এমন একজন মানুষ এভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাবেন কেন? ক্লান্ত তিনিও হয়েছিলেন, কিন্তু ক্লান্তিটা দূর করেছিলেন পাগল হয়ে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিল। খুব সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে এই পৃথিবীতে সুস্থ থাকা কঠিন। তাঁর সঙ্গে তো আমার দেখা হয়, এইসব কথা তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন।’ আপনার মুখে ‘তাঁর সঙ্গে তো আমার দেখা হয়’ শুনে আমি একটু চমকে উঠি।

কার সঙ্গে দেখা হয়? কার কথা বলছেন আপনি? জিজ্ঞেস করলে দ্বিধাহীনভাবে বললেন- ‘শহীদ সাবেরের সঙ্গে! উনি তো আসেন, প্রায় প্রতিদিনই আসেন। অবশ্য দিনে খুব একটা আসেন না, আসেন রাতে, কথাবার্তা বলে ওই সোফায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন! মনে হয় খানিকটা বিরক্ত। বিরক্ত অবশ্য হবারই কথা! বোঝো না, তাঁর হাত ধরে আমি লেখক হয়ে উঠেছি, অথচ, তিনি যখন অজানা কারণে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন তাঁর খোঁজও নিইনি। আর ওই দিন, মানে শেষ যেদিন তাঁকে দেখলাম, সেদিন তাঁকে যদি নিয়ে আসতাম…’- বলতে বলতে আবার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে আপনার। আর আমি অবাক হয়ে ভাবি, একজন মানুষ কতটা সংবেদনশীল হলে তিনি তাঁর শিক্ষকের মৃত্যুর দায় অকারণে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বয়ে বেড়াতে পারেন! শহীদ সাবেরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই নিজেকে দায়ী করতেন আপনি, অথচ এর জন্য আদৌ আপনার কোনো দায় ছিল না। মনে পড়ে আপনি বলেছিলেন- ‘যতদিন মা ছিলেন, এইসব নিয়ে মা-র সাথে কথা হতো। তিনি আমাকে বুঝতেন। মা চলে যাওয়ার পর আমার সব শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। আমি আর একটি অক্ষরও লিখতে পারিনি। মনে হয়েছে, মা যেন সঙ্গে করে আমার লেখাগুলো নিয়ে গেছেন।’ এই কথা শুনে আমি আপনার সংকটটা খানিক বুঝে উঠতে পেরেছিলাম বোধহয়। শহীদ সাবেরকে নিয়ে আপনার অবসেশনের বিষয়টি আপনি কারো সঙ্গেই শেয়ার করতে পারেননি কোনোদিন। মায়ের সঙ্গে করতেন, যখন তিনিও চলে গেলেন, তখন আপনি হয়ে পড়লেন নিরালম্ব, নিরাশ্রয়। কী অদ্ভুত একটা জীবন আপনি যাপন করে গেলেন বটুভাই! সত্যিই অবাক লাগে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তানের দেয়াল ঘেঁসে অতি সাধারণ কবরটিতে আপনাকে শুইয়ে দিলে নিজেকে একা, নিরালম্ব, আর নিরাশ্রয় মনে হতে থাকে। কত কথা যে বলার ছিল আপনাকে, হলো না, কিন্তু সবসময় মনে হতো, যে-কোনো সময় আপনার কাছে যাওয়া যাবে, গিয়ে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ধরে গল্প করা যাবে! কিন্তু নিজের কথা বলা তো দূরের কথা, শেষ কয়েক মাস আপনাকে দেখতে যাওয়াই হলো না। আমার মা-ও যে তখন শয্যাবন্দি, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দুলছেন, কী করে তাঁকে রেখে আড্ডায় যাই? তা-ছাড়া আপনি তো ততটা অসুস্থ ছিলেনও না, যে, আপনার প্রয়াণের কথা ভাববো! হা জীবন, হা ব্যস্ততা! আর দ্যাখো, এখন আমার কোনো ব্যস্ততা নেই। গোরস্তানের চারপাশটা ক্রমশ নিঝুম হয়ে আসছে। বিকেলের আলো পড়ে এসেছে, সন্ধ্যা নামার আয়োজন চলছে প্রকৃতি জুড়ে। বিষণ্ন হয়ে উঠেছে পৃথিবীর মুখ! আকাশটা পর্যন্ত কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। শূন্যতা ছাড়া কোথাও কিছু নেই, কোথাও কেউ নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের মুহূর্তগুলো
পরবর্তী নিবন্ধচিটাগাং সিনিয়রস’ ক্লাবের ঈদ পুনর্মিলনী উৎসব