একদিন, অন্যদিন

রিতু পারভী | শনিবার , ২২ জুলাই, ২০২৩ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

জীবনের ডানায় রংএর ছোপ পড়ে অতি সামান্য, যেখানে প্রকৃতিতে হাজারও রংএর মেলা। নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা জীবনকে কল্পনার ঢেউয়ে তুলে অজানায় ভাসানো যেমন সহজ আবার তেমনই কঠিন। এই চক্রে নারীদের ছকের সীমানাটা আরও বেশি ছোট। কর্মবন্টনে যেদিন থেকে নারীকে গৃহস্থালির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেদিন থেকেই নারী হারিয়ে ফেলেছে আলো বাতাসে বেড়ে উঠার স্বাধীনতা। যুগে যুগে তাতে যুক্ত হয়েছে বেড়ি শরীরমনমননে। চিন্তার আকাশ আর বিকশিত হতে পারেনি তেমন করে। তবুও সকল কিছু ছিন্ন করে নারী চেষ্টা করে যায় বেড়িয়ে পড়তে মুক্ত আলো, হাওয়ায়।

সকাল সাড়ে ছটা, ঝাউতলা রেলস্টেশন, চট্টগ্রাম। চল্লিশঊর্ধ্ব একজন নারী স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুদের অপেক্ষায়। তাঁরা বন্ধুরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলস্টেশনগুলোতে কিছু জরুরি গাছ লাগাবে। ঈদের ছুটি তারা এভাবেই উদযাপন করবে বলে ঠিক করেছে, একটু ব্যতিক্রমী আয়োজনে।

কোরবানি ঈদের এই সময়টাতে নারীদের গৃহকর্মে ব্যস্ততা থাকে। রসুইঘর আর খাবার টেবিল থেকে বেড়িয়ে গাছ লাগানোর মত কাজে নিজের আনন্দ খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে দারুণ এক ব্যাপার। গত রাতেও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো এই নারী অনেক রাত পর্যন্ত অতিথি আপ্যায়ন করেছেন, সংসার সামলেছেন। কিন্তু নিজের আনন্দের জন্য রাখা এই সময়টুকু তিনি কিছুতেই হারাতে চাননি। তাই এমন সকালে ভোরের প্রথম ট্রেনের এই আয়োজনে যুক্ত হতে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাদের রেলস্টেশনগুলোতে, রেললাইনের ধার ধরে এখনো অনেক জায়গা পাওয়া যায় যেখানে গাছ লাগানো যায় এবং এই গাছগুলো বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক। যে গাছগুলো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অথচ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সেই গাছগুলো এসব জায়গায় লাগানো যেতে পারে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ঈদের ছুটিতে একদল বন্ধু ট্রেনযোগে স্টেশন স্টেশনে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিটি স্টেশনে একটা করে বট, একটা করে হিজল, একটা করে পলাশ আর একটা করে ছাতিম গাছ লাগানোর চিন্তা করা হয়।

সেই নারী যিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্টেশনের প্লাটফর্মে, তিনি লীলা। লীলার বন্ধুরা যথাসময়ে স্টেশনে চলে এলো। ট্রেন আসতে এখনো খানিক দেরি আছে। কাছেই একটা চায়ের দোকানে গরম গরম লুচি আর তন্দুর রুটি বানাতে দেখে তারা সবাই সেখানে বসে গেলো। গরম চায়ের সাথে লুচি আর তন্দুর রুটি, সাথে নির্মল এক সকালে বন্ধুআড্ডা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের প্রথম শাটল ট্রেন স্টেশনে এসে থামলো। সবাই গাছ আর মাটি কাটার জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো। ট্রেনচালক অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সবাইকে স্বাগত জানালো। পরের স্টেশনে যুক্ত হলো আরও কিছু বন্ধু। লীলারা তাদের ব্যস্ত একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী সুন্দর একটা দিন শুরু করলো।

কিছুদূর গিয়েই প্রথমেই পড়লো ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন। ভীষণ সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এক স্টেশন। সকালে মিষ্টি আলোয়, সবুজে ছায়া স্টেশনটাকে একটা মায়াপুরী মনে হচ্ছিল লীলার। সময় কম। দ্রুত গাছ, যন্ত্রপাতি নিয়ে সবাই নেমে পড়ে স্টেশনে। ট্রেনচালক স্টেশনমাস্টারের সহায়তায় জায়গা ঠিক করে দেন। চলে দ্রুতই মাটিতে গর্ত করার কাজ, সাথে আরেকদল গাছ লাগাতে থাকে। বট, পলাশ, হিজল এবং ছাতিম। লীলা ভাবতে থাকে গাছগুলো বড় হয়েছে, স্টেশনে হিজল, পলাশ, ছাতিম ফুটেছে, বটগাছে আশ্রয় নিয়েছে হাজারো পাখি। আনন্দে ভরে উঠে লীলার মন। সবাই ঝটপট কাজ সেরে উঠে পড়ে ট্রেনে। ট্রেনে ছেড়ে দেয় পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কামরায় বসা সকল বন্ধুর চোখে মুখে তৃপ্তি। লীলা জানালায় চোখ রাখে, আনন্দিত মুখ তার।

পরের স্টেশন দ্রুতই চলে এলো। চৌধুরীহাট স্টেশন। এখানেও দ্রুততার সাথে গাছ লাগিয়ে সবাই ট্রেনে উঠে পড়ে। এভাবে একের পর এক স্টেশনে চলে গাছ লাগানোর আনন্দ। এতে যুক্ত হয় সকাল বেলায় স্টেশনে কোন কাজে আসা সাধারণ জনগণ। সবাই উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় কী হচ্ছে দেখার জন্য। অনেকে কাজে হাত লাগায়, সাহায্য করে। অন্যরকম এক সকাল। প্রথম ট্রেন হওয়ায় যাত্রী তুলনামূলক কম ছিল। স্টেশনে স্টেশনে বাড়তি কিছু সময় লাগছিল বলে কেউ বিরক্ত হয়নি। উল্টো সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছিল একদল মানুষ গাছ নিয়ে নামছে, দৌড়াদৌড়ি করে গাছ লাগাচ্ছে। লীলার ভীষণ ভালো লাগে ব্যাপারটা। কামরার ভেতরে বন্ধুরা গান করে পুরো ভ্রমণে ভিন্ন একমাত্রা যুক্ত করে। এই সুন্দর আয়োজন শেষ হয়, শেষের স্টেশন নাজিরহাট গিয়ে। গাছ লাগিয়ে সবাই খানিক চা পানের বিরতি নেয়। এতো তাড়াহুড়ো করেও দেরি করে ফেলে ট্রেন ছাড়ার। প্রতিটা কামরা ভর্তি মানুষ। সবাই খানিক বিরক্ত দেরির কারণে। কোন কামরাই নেই তিল পরিমাণ জায়গা। অগত্যা ট্রেন চালকের কামরায় হয় জায়গা। ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা লীলাদের। এডভেঞ্চার আর গাছ লাগানোর সফল এক আয়োজনের পরিতৃপ্তি।

শহরের মানুষ যখন কেবলই দিনের কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এরমধ্যেই লীলারা শহরে ফিরে আসে। আবারও ছকে বন্দী জীবনে ফিরছে তারা কিন্তু সমস্ত জুড়ে এক পরিতৃপ্তি। রুটিন কাজের সাথে দিনের বাকি সময়টুকু আজ অন্য ছন্দে বাজবে। মাঝে মাঝেই ভিন্ন ছন্দে আন্দোলিত হোক লীলাদের জীবন যাতে থাকবে জীবনকে ভালোবাসার গন্ধ, প্রাণপ্রকৃতিকে আগলে রাখার আনন্দ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধিকার
পরবর্তী নিবন্ধ১০ দফা দাবি আদায়ে অটোরিক্সা হালকা যান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের স্মারকলিপি