একজন ঋষিকেশ দাশের মৃত্যু

বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী | শুক্রবার , ১২ মার্চ, ২০২১ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

একবার ভাবে যে ‘গীত বিতান’টা মাথার কাছে রাখে। একবার ভাবে যে ‘কথামৃত’ রাখলে কেমন হয়? আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যার কোনো এক আলাপ-চারিতায় বলেছিলেন কেরানীগঞ্জের ভাষায় বাঙালিদের ঘরে ঘরে ‘কথামৃত’ পাঠ হতে পারে। আমি প্রমিত বাংলায় অনুবাদ করে লিখলাম বটে।

‘কথামৃতে’র কথাকার একজন সাধু। সাধারণ মানুষ, অসাধারণ বটে। আমিও ইদানীং প্রায় একা একা হেঁটে বেড়ানোর মুহূর্তে মনে মনে কথাকারের নাম জপ্‌্‌ করতে থাকি। মনে মনে বলি আমার ভেতর ‘বোধ’ জাগ্রত হোক।
সেই বোধ থেকেই লিখছি- আমাদের সকাল বেলার সাথী প্রিয় মানুষ, প্রিয় সুন্দর ঋষিকেশ দাশ। প্রতিদিন সকালে আমাদের মধ্যে সম্ভাষণ বিনিময় হতো। অন্তত হাত জোড় করে আমাদের মধ্যে প্রণাম বিনিময় হতো। আমি তাঁকে ভীষণ মান্য করতাম। তা ছিল অন্তর থেকে উৎসারিত । আমি কি বলতে পারি তিনি ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ!। কখনো শুনিনি কারো সমালোচনা করতে। কখনো শুনিটি কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কথা। কখনো শুনিনি কোনো মনস্তাপের কথা। অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতেন। মানুষকে মান্য করতেন। সুন্দর মনের মানুষ- এ কথা কি তাঁকে ঘিরে বলতে পারি? হ্যাঁ, তিনি একজন সরল প্রাণ নির্মোহ চেতনার সুন্দর মানুষ ছিলেন, আমাদের ঋষিদা (ঋষিকেশ দাশ)।
দেখা হলেই বলতাম-ঋষিদা কেমন আছেন ? উত্তরে বলতেন দাদা ভালো আছি। এই ভালো আছি বলতে পারার মধ্যে হয়তো এ রকম একটি চিন্তা নিহিত ছিল যে-তিনিও যেন ভালোর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। তাঁর বাসায় অনেকবার নিমন্ত্রণ খেয়েছি। তিনি ঠাকুর অনুকুলের ভক্ত শিষ্য ছিলেন। ঠাকুরের আবির্ভাব দিবসে তাঁর বাসায় আয়োজন হতো, আমি, আমরা নিমন্ত্রিত থাকতাম।
তাঁর ধলঘাটের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। মিশেছি তাঁর সঙ্গে আবেগ ভরা মন নিয়ে। আমার কাছে মনে হতো- তাঁর সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারবো। তাঁকে ভালোবাসতে পারি। তাঁকে ভালো মানুষই বলতে পারার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা কখনো মনে কাজ করেনি।
তাঁর স্ত্রী একজন দেশবরেণ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠান মালায় তাঁর গান শুনেছি। একজন উঁচু মানের দরদী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দাদার এই অর্ধাঙ্গীনি। আজ বউদির জন্য খুব মন খারাপ। দাদা আমাদের চোখের সামনেই হঠাৎ করে ‘নাই’ হয়ে গেলেন। পরম ধামে পৌঁছে গেলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সকালেও দাদাকে প্রণাম জানিয়েছিলাম। রাতে হঠাৎ মুঠোফোন বেজে উঠে-অপর প্রান্ত থেকে আমাদের সজল দা (সজল ভট্টাচার্য) জানালেন দাদা নেই। সন্ধ্যার দিকে ঋষিদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এটা হঠাৎ আকস্মিক মৃত্যু ! হায় ভগবান-এমন কেন হলো ?
তাঁর দু’সন্তান আছে জানি- তারা এখনও পড়ালেখায় রত। বউদি এবং সন্তান, আত্মীয় পরিজন এই হঠাৎ শোক কাটিয়ে উঠুন-ভগবান তুমি এই শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনের মনে শক্তি দাও, মনে শান্তি দাও। ভগবান তোমার চরণে প্রার্থনা-তুমি ঋষি বাবুকে আমাদের ঋষিদাকে স্বর্গবাসী করো।
তাঁর জীবনের যে পথ চলা-তাঁর জীবনাচারের যে ভাষা, যে রূপ গড়ে উঠেছে তা তো একজন মার্জিত রুচির স্নিগ্ধ মানুষের যা হয় তাইতো ছিলেন তিনি।
আমাদের সংসার যাত্রায় যে হাসি-আনন্দ, কান্না-অপমান-কষ্ট, বাঁচা-মরা, যুদ্ধ, শান্তি সবটার দোলাচলে তিনি স্থির চিত্রের একজন মহানুভব মানুষ। অবশ্যই তিনি একজন বড় মনের মানুষ ছিলেন। অন্তর্গতভাবে একজন সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন ঋষি দা। ঋষিদাকে ঘিরে আমার এই বোধ ক্রিয়াশীল আমার অন্তরে, অনুভবে, চিন্তায়।
কেউ কেউ আমাকে কবি অভিধা দিয়ে থাকে। আকি কী চরণ রচনা করবো দাদার জন্য!
ওই যে উদার আকাশ
তার কোন তারাটি আজ
দীপ্ত লীলে, আমাদের স্বর্গ কায়া!
‘ভুবন ভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ হৃদয় চেয়ে’।
তোমার আত্মাটি আজ আকাশ হতে
আলো হয়ে দিব্য পরশ নিয়ে মায়া ছড়িয়ে আছে…
এই মায়ার সংসারে আজ তুমি স্মৃতি হলে। তোমাকে ভালোবাসি, বড়ো বেশি ভালোবাসি। আমার বোধ বলে-তুমি নামে যেমন ঋষি, বোধেও তুমি ছিলে ঋষিসুলভ নৈর্ব্যক্তিকতায় জগৎসংসারে খুউব স্থির চিত্র একজন মানুষ! কী বলো ?
তোমার মুখটি বড়ো বেশি মনে পড়ছে, তোমার আত্মাটি যেন বলছে-দূরে চলে গেছি বলে আমাকে কি ভুলে যাবে? আমার সন্তানেরা কি বড়ো বেশি একা হয়ে গেল! তারা কি সংগ্রাম করে নিজেকে খুঁজে নিতে পারবে না? তাঁরা কি জীবনের যে মূলধারা তাতে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে না?
আমি ভাবি যে-সোনার আলোকের ধারা হয়ে উঠবে তারা। ভালো মানুষের সন্তান যে তারা। তবু তো ভাবতে হয়-পরিবারের কর্ণধার, মালি, কান্ডারি তো ছিলেন ঋষিদা, কারো কারো টুটুদা-তিনি আজ ‘নাই’ হয়ে গেলেন। হঠাৎ এভাবে চলে গেলেন।
সকালেও তো তাঁকে দেখেছি কোর্টহিল থেকে প্রাতঃভ্রমণ শেষে হাসি হাসি মুখ নিয়ে প্রতিদিনের সম্ভাষণ শেষ করে নেমে যাচ্ছেন তিনি। বাসায় পৌঁছে হয়তো একটু বিশ্রাম সেরেছেন, বউদির সঙ্গে দু’চার কথা বলেছেন। ছেলে-মেয়েদের খোঁজ নিয়েছেন-কর্তব্যে অবহেলা করার লোক তো তিনি কখনও হবেন না-এতো নিশ্চিত করে বলতে পারি।
দাদাটি চলে গেলেন এভাবে! এভাবেই চলে যেতে হয়! সকলেই কি এভাবেই চলে যাবো?
তারপরও জগৎ-সংসার চলতেই থাকবে। বউদিকে একাই সামলাতে হবে, সন্তানদের মানুষ করতে হবে, অন্তরের ভেতর তপস্যার ধারা বইবে, হয়তো বাড়ির বড়ো বউ, দায়িত্বও একটু বেশি।
এই গল্পের কথক কোতোয়ালির ভাড়া বাসার বাসিন্দা বিনয় বাবু তাঁর তিন তলার বাসায় একলা বসে বসে ভাবছেন। আর ঋষি বাবুর প্রয়াণের কথা অক্ষরে ধরে রাখতে চায়ছেন আর লেখার টেবিলে বসে লিখবার মুহূর্তে কোথাও যেন হাতুড়ি পেটার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। বুকের ভেতরও শব্দ তোলপাড় করছে- একদিন আমাদেরকে চলে যেতে হবে, দেয়ালের টিকটিকিটিও টিক্‌ টিক্‌ করে উঠেছে। চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে…।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামকে ব্যবসা বান্ধব করতে সমন্বিত উদ্যোগ চাই
পরবর্তী নিবন্ধপ্রণয় কান্তির অপ্রকাশিত কবিতা