এই শোক চিরদিনের

লিপি বড়ুয়া | বুধবার , ৩১ আগস্ট, ২০২২ at ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ইতিহাস এদিন থমকে দাঁড়ায়। নদী তার স্রোত হারায়। বনের পাখিরা নিস্তব্ধ হয়ে আরও নির্জনে চলে যায়। এদিন ভোরের সূর্য আরও রক্তিম হয়ে ওঠে। রাখালের বাঁশির সুরলহরি এদিন আরও করুণ হয়ে ওঠে।
নানা ঘটনাপ্রবাহ আর ব্যথাতুর স্মৃতিতে বাঙালি জীবনে আগস্টের গোটা মাস ভারি হলেও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বিশ্বমানবতাকে স্তম্ভিত করে দেয়। এদিন বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলাদেশের স্থপতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে হত্যা করেন।
মন খারাপের আগস্ট মাসে আমরা স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাকে বাংলাদেশের রূপকার বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বর্ণনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ও ভাবনা এই মহাদেশের শান্তি ও প্রগতির সঙ্গে এতটাই সম্পৃক্ত যে আজ বারে বারে তার চিন্তা ও দিকনির্দেশ মনের তন্ত্রীতে ঝংকার তুলছে।
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত নৃশংস ও উল্লেখযোগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা। এদিন বাঙালির প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহধর্মিণীসহ পরিবারের প্রায় সকলকেই ঘাতক চক্র নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। শিশু রাসেলকেও হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। কতখানি বর্বর ও নৃশংস হলে একটি শিশুও রক্ষা পায় না!
বাংলাদেশের আর এক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বহু জনপ্রিয় নেতার জন্ম হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেশ শীর্ষের দিকে রয়েছেন। একথা বলার পেছনের যুক্তিগুলো হচ্ছে সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ভোটার বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দিয়েছেন।
একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে এ দেশ পরিচালিত হয়েছে। অথচ দেশে তখন সামরিক সরকার ক্ষমতায় বহাল ছিল। ২/৪ জন ছাড়া এদেশের প্রায় সবাই মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। শত্রুর কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের ৯ মাসে তার নামেই স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং তার নামেই মুক্তিযোদ্ধারা হাসতে হাসতে জীবন দান করেছেন। বাঙালির স্বপ্ন পূরণে তিনি ছিলেন অকুতোভয় দুঃসাহসী সংগ্রামী নেতা। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আসলে মুক্ত বিহঙ্গের মত জীবন যাপনের স্বপ্ন বাঙালি জাতির মধ্যে অনেক আগে থেকেই সুপ্তভাবে বাস করতো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তা বেগ পায়। জীবন্ত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নিয়ে তার একান্ত স্বপ্নের কথা সাহসের সঙ্গে, আস্থার সঙ্গে, বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশের অভ্যুদয় লগ্নেরও বহু আগ থেকে। ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি বাংলাদেশকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন।
বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরপিচাশরূপী খুনিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি আইন জারি করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে এ বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন শেখ হাসিনা।
বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা ও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি তাঁর মহান আদর্শে বাঙালি জাতির জীবনে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। তাইতো বলা যায়, ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হলেও মুজিবাদর্শের মৃত্যু নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকুক এই প্রত্যাশা সকলের মাঝে। তার স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপায়ণের মাধ্যমেই তাঁর স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সকল সদস্যকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বাংলাভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই লিখেছেন-
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
লেখক : কবি, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ, সভ্য ও সংযত ছাত্র রাজনীতির চর্চা হোক
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে