উৎসব বাঙালিয়ানা ও আমরা

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১০ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ফেব্রুয়ারি, মার্চ জুড়ে বেজায় ব্যস্ততা গিয়েছে বাঙালির নাগরিক জীবনে। ভাষা দিবসের উদযাপন, সাজসজ্জার পাশাপাশি বাংলার জন্য হাহাকার- কোনকিছুর কমতি ছিল না। মার্চ এসে পড়ায় মুক্তি মেলে ভাষা’র ভাষণ হতে। কারণ উৎসবের শেষ নেই পুরো মার্চে। সাতই মার্চের পরদিনই নারীদিবস। এরপর মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। উৎসবে আয়োজনে মাস কাবার। যা একটা ঝক্কি গেল আমাদের মেয়েদের! অনেককে একদিনেই কয়েকবার সাজ পাল্টাতে হয়েছে। একই দিনে কয়েকটা অনুষ্ঠান পড়ে গেল, কি আর করা! এক পোশাকে দুই উৎসবেতো সামিল হওয়া যায় না। ছেলেদের সাজপোশাক নিয়ে অতশত না ভাবলেও চলে। সৌন্দর্যবৃদ্ধি, নিজেকে দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপন করা নিয়েও তেমন ভাবনাচিন্তা করতে হয়না ওদের। বড়ই হাস্যকর আমাদের নারীমুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন আর সমানাধিকারের সংগ্রাম! পুরুষের সমান অধিকারও চাইব, আবার নিজেকে রমণীয় মোহনীয় করে সভাসমিতির সৌন্দর্যও বর্ধন করে চলব।
ফিরে যাই উৎসবের কথায়। অবশেষে বর্ষপঞ্জি এপ্রিলে পা রাখল। স্বাধীনতার আলাপ তবে আর নয়, এবছরের জন্য। বর্ষবরণ করতে হবে না! বৈশাখের প্রস্তুতি নিতে হবে আজ থেকেই। বাঙালিয়ানার দৌড়ে পিছিয়ে পড়া চলবে না। নতুন উদ্যম নিয়ে কোভিড ছুটে চলেছে, মৃতের সংখ্যা নয় অংক ছুঁতে চলেছে- সেসব নিয়ে আমাদের তাই না ভাবলেও চলে।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে বৈশাখী সাজ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন। বাঙালি সাজের যে নমুনা দেখা গেল, তাতে বিস্মিত হবারও জো নেই। না, বৈশাখের ট্রেডমার্ক লাল সাদার কমতি নেই পোশাকে। কিন্তু চুলও যখন রঙিন হয় তখন কি আর বাঙালিয়ানা বাঁচে? বৈশাখ বরণের আদবকেতা প্রশিক্ষণের সূত্রে খবরের কাগজে একদিকে বলা হচ্ছে করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা, অন্যদিকে দিনের বেড়ানো আর রাতের দাওয়াতের সাজপোশাকের পাঠ। রাতে চাইলে আপনি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকও বেছে নিতে পারেন। দিনে বাঙালিয়ানা করুন যত খুশি। রাতের আউটলুকটা একটু বিদেশি ঢঙে হলে দারুণ একটা আভিজাত্য ফুটে ওঠে। কিন্তু পাশ্চাত্যে যে এখন নগ্নতা সেকেলে হতে চলেছে, সেখবর আজও জানা হয়নি আমাদের। রূপোলি পর্দার অপ্সরীদের কথা নয়, সাধারণ পশ্চিমা মেয়েরা হাটেমাঠেঘাটে অতি সাধারণ পোশাকে যেভাবে চলাফেরা করে তা দেখলে আমাদের মেয়েরা মুখ লুকিয়ে কুল পাবে না।
আমাদের খবরের কাগজ আর টেলিভিশন দেখে কার কি মনে হয় জানিনা। আমার কেবলই রক্তক্ষরণ হয় বুকের ভেতর। ‘তু লালপাহাড়ের দেশে যা, রাঙা মাটির দেশে যা, হেতাক তুকে মানাইছেনা রে, ইক্কেবারে মানাইছেনা রে’- গানটা বোধ করি আমার মতো যারা তাদের নিয়েই লেখা হয়েছিল। কাগজ আর টেলিভিশন দেখে ভাবি– এই কি আমার বাংলাদেশের গণমাধ্যম! ওরা কি আমার বাংলাদেশের মেয়ে! মুখ দিয়ে কথা সরে না, শুদ্ধ উচ্চারণে দুটো বাংলা বাক্য ভাল করে বলতে পারে না, অথচ সাজপোশাকের কি বলিহারি! চুলের কাট ও রঙ দেখে দ্রুত বোতাম টিপে অন্য কোথাও গিয়েও স্বস্তি মেলে না। পাল্লা দিয়ে কিম্ভুত সাজছে মেয়েরা। আমাদের ছোটবেলায় খবর পাঠকদের দেখে অনেক কিছু শেখার ছিল; উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, আর সাজসজ্জাও। রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট ছিল তাঁদের অবয়ব ও উপস্থাপনায়। এখন খবরের মেয়েদের অনেককে দেখে মনে হয় যেন বিয়ে বাড়িতে এসেছে।
উৎসবের কথা দিয়েই শেষ করা যাক। গেল বছর করোনা’র কারণে ভেস্তে গিয়েছিল বর্ষবরণের যাবতীয় আয়োজন। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাতম চলেছে দিনের পর দিন। একদিনের বাঙালি সাজার এই সার্বজনীন মহোৎসবে বাগড়া দিয়েছে কোভিড-১৯। বাঙালির আনন্দ মাটি করে দেয়ার জন্য এ-নিশ্চয় দেশীবিদেশী ষড়যন্ত্র! অনেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন নিজের কাছে, আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই বলে- আসছে বছর দ্বিগুণ মজা করে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন। অনেক প্রতীক্ষার ‘আসছে বছর’ দোরগোড়ায়। করোনা বোধ হয় হাসছে মিটিমিটি।
বর্যপঞ্জিতো আর বৈশ্বিক দুঃসময় বোঝে না। প্রকৃতিও সংকটের ধার ধারে না; ফুল ফুটিয়ে যায়, ফল ফলিয়ে যায়। যে-যার দিনপঞ্জি মতো কাজ করে যায়। আমরা সংস্কৃতিবান বাঙালিরাও বাঁচি কী মরি, উৎসব আয়োজনে কাটছাঁট করিনা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে উৎসব ভেস্তে গেল বলে হাহাকার। অথচ পয়লা বৈশাখের দিনেই সরকারি হিসেবমতো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। তাতে কী! সেদিনের জন্য অন্তত সব দুর্ভাবনা তুলে রাখি।
মহামারী এসেছে বলে জীবন থেমে যাবেনা, সত্যি। উৎসব আনন্দবিহীন জীবন অর্থহীন, তা-ও সত্যি। তাই বলে উৎসবের নামে উন্মাদনা, অপচয়ের মচ্ছব, আর অমানবিক আচরণের মহড়া বন্ধ হওয়া বড় প্রয়োজন। এবারের উৎসব জমেনি বলে পরের বছর আরও বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব আয়োজনের শপথ যারা নিয়েছেন তাঁদেরকে একটু সংযত হওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা কতদিন আমাদেরকে আটকে রাখবে তা বিশ্বের নামজাদা বিজ্ঞানীগণ আজও জানেন না। তাছাড়া করোনা পরবর্তী পৃথিবীও আর আগের মতো থাকবে না।
আমাদের প্রার্থনা কেবল সর্বশক্তিমানের কাছে। কারণ তিনিই আমাদের সহায়, তিনিই শেষ আশ্রয়। আর নিজেদের সতর্কতা। নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষগুলো দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পাক। অসুস্থ মানুষগুলো উপযুক্ত চিকিৎসা পাক, সেবা পাক, আমাদের ছেলেমেয়েরা আগের মতো করে স্কুলে যেতে শুরু করুক, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা পরিবারের মানুষগুলো পুনর্মিলিত হোক।

কবিগুরুর মতো করে আমরাও কামনা করি-

বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রচলিত পেশায় পেশাদারী নারী
পরবর্তী নিবন্ধহালদা পাড়ে মাটি চাপায় যুবকের মৃত্যু