বাংলার সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান ভৌগলিক সীমারেখা নিয়ে বাংলাদেশ নামক এই অঞ্চলের মানব–গোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, চিন্তা–চেতনা ইত্যাদি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে সংমিশ্রন–সংযোজন–পরিবর্তন–পরিবর্ধন এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বস্তুত গাঙ্গীয় এ ব–দ্বীপ এলাকায় বাঙালিরা বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় পনর’শ বছর আগে। দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উৎসে ছিল কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতি। আর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি–ভাষা–সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায় “বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহন শুরু করে”। অধ্যাপক আলী নেওয়াজের মতে “তথাকথিত সভ্য আর্যরা এদেশে এসে অনার্যদের সংস্কৃতির বারো আনাই মেনে নিয়েছিলো, নবান্ন উৎসবটিও তারা বাদ দেয়নি, যার রেওয়াজ আজও বাংলাদেশে চলছে”। স্মরণাতীত কাল থেকে ধন–ধান্যে ভরা অগ্রহায়ণ মাসের নবান্ন উৎসবকে উপলক্ষ করে বাঙালির বছর গণনা পরবর্তীতে মুসলিম আমলেও যে প্রচলিত ছিল; বহু সূত্র থেকে তার সত্যতা সমর্থনপুষ্ট। প্রায় পাঁচ’শ বছর পূর্বে কবি মুকুন্দরাম তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে “ধন্য অগ্রহায়ণ মাস – ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, বিফল জনম তার নাহি যার চাষ” পংক্তির মাধ্যমে সে যুগের কৃষিজীবী বাঙালির সন গণনার যথার্থ বর্ণনা দিয়েছেন। প্রখ্যাত মনীষী আবুল ফজল আইন–ই–আকবরীতে উল্লেখ করেন যে, সম্রাট আকবরের আমলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে বাংলা বছরের গণনা শুরু এবং এ জন্যই বাংলা সালকে “ফসলী সাল” বলা হতো।
মোহাম্মদ আবদুল হাই সঙ্কলিত ও সম্পাদনায় ’বাঙালির ধর্মচিন্তা’ গ্রন্থের ভূমিকায় চমৎকারভাবে উল্লেখিত বিষয়ের অবতারনায় উল্লেখ করেছেন যে, মোগল আমলের বাংলা সমাজ প্রধানত হিন্দু, মুসলমান–এদুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অবস্থান তখন প্রায় অবলুপ্তির পথে ছিল। বাঙালি সমাজের এদুটি সম্প্রদায়ের পরস্পর বিরোধী মৌলিক আদর্শগত বিভাজনটি বিকশিত হয়েছিল ধর্ম, দর্শন, আচার–আচারণ, নিরাকার–আকার, একেশ্বর ও বহুত্ববাদকে কেন্দ্র করে। এই বিভাজনই প্রকৃতপক্ষে বিরোধ, বিদ্ধেষ, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির যাঁতাকলে এদুই সম্প্রদায়কে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। এ উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল গোষ্ঠী কেন জানি মনন–চিন্তনের বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে স্ব স্ব ধর্ম ও সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সচেষ্ট ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে ভীষণ ধরণের ব্যবধান সৃষ্টি হলেও প্রাত্যহিক সমাজ জীবনের সহাবস্থান, শ্রেণি চরিত্র, পারষ্পরিক লেন–দেন, আদান–প্রদান ইত্যাদি এদুই সম্প্রদায়কে আবার প্রেম–প্রীতি, সৌহার্দ–সম্প্রীতির অপরূপ মেলবন্ধনও তৈরি করেছিল। এখানেই এদুই সম্প্রদায়ের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য ভিন্নমাত্রায় প্রবাহিত ছিল।
খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর মতে আসমুদ্রহিমাচল আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাংলা দেশ। আবুল ফজলের ’আইন–ই–আকবরি’ গ্রন্থে তার ব্যাখ্যা আছে। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল্ যুক্ত হয়ে দেশের নাম বাঙ্গাল বা বাঙ্গালা হয়েছে। আল্ বলতে শুধু খেতের আল নয়, ছোটোবড়ো বাঁধও বোঝায়। বাংলা দেশ জলবৃষ্টির দেশ; ছোটোবড়ো বাঁধ না দিলে বৃষ্টি, বন্যা আর জোয়ারের হাত থেকে ভিটে–মাটি–খেত–খামার রক্ষা করা যায় না। যে অঞ্চলে জল কম হয় সে অঞ্চলেও বর্ষার জল ধরবার জন্যে বাঁধের দরকার। তাই আল বেশি বলেই এদেশের নাম হয়েছে বাঙ্গালা বা বাংলা দেশ। বস্তুতপক্ষে ১২০৪ সালের আগে অঞ্চল, ভাষা বা সংস্কৃতির বিচারে জাতি হিসেবে বাঙালির কোনও আলাদা পরিচয় গড়ে ওঠেনি। সে সময় বেঙ্গল বা বাংলা বলে কোন অঞ্চল ছিল না। পরবর্তীকালেও বাংলা বলতে যে অঞ্চল বোঝাত তা বহু রাজত্বে বিভক্ত ছিল। পাল রাজত্বের দীর্ঘস্থায়িত্বেও তা বজায় ছিল। কিন্তু বাংলা বলতে যে অঞ্চলকে আমরা বুঝি তা রূপ পেয়েছিল ১২০৪ সালের পর। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের কয়েক যুগ পর অঞ্চল হিসেবে বাংলা এক কেন্দ্রীয় শাসনাধীন হয়। যদিও একটা সময় সোনারগাঁও গোটা দেশের থেকে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে ছিল, চট্টগ্রাম বা ত্রিপুরাকে দীর্ঘকাল বাংলার অংশ বলে ধরা হত না, কিন্তু এই ভূভাগের অধিকাংশ অঞ্চল একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঐতিহাসিক বহু তথ্য থেকে এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশে আর্য হিন্দুদের শত বিরেধিতা সত্ত্বেও প্রচলিত অনার্যদের প্রচীন আমলের কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতি – বধূ বরণ, অন্ন প্রাশন, সংক্রান্তি, গৃহ প্রবেশ, জমি কর্ষণ, ফসল তোলা, আচার–অনুষ্ঠান, ব্রত ও প্রথার বিলুপ্তি ঘটেনি বরং বৌদ্ধ, হিন্দু এবং সূফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরও এ ধরণের কৃষি ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো বাঙালির সংস্কৃতির প্রধান আচার–অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অস্তিত্বকে সূদৃঢ় করে। অতএব এ সব আচার–অনুষ্ঠানকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে আখ্যায়িত করার অব্যাহত প্রচেষ্টা যে এ দেশের কিছু সংখ্যক অশিক্ষিত ধর্ম–ব্যবসায়ী ও কুশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নববর্ষের বাংলা সনের ‘সন’ শব্দটি আরবী, পহেলা বৈশাখের ‘পহেলা’ শব্দটি ফরাসী এবং বছরের প্রারম্ভে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রচলিত ‘হালখাতা’ শব্দটি ইসলামী। মুঘল সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরী (চান্দ্র বর্ষ) ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজী ১৪ই এপ্রিল ১৫৫৬ সাল থেকে ১লা বৈশাখ পালনের রেওয়াজ শুরু করেন। সৌর বৎসর (বঙ্গাব্দ) ও চান্দ্রবর্ষ (হিজরী) উভয়ের অপূর্ব সন্ধিক্ষণে রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষ্ন হিসাব–নিকাশের মাধ্যমে শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে ১লা বৈশাখকে নববর্ষ উদযাপনের দিন হিসেবে ধার্য্য করা হয়।
এই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল হিজরী সনকে উপেক্ষা করে নয় বরং হিজরী ৯৬৩ সালকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শুধুমাত্র ফসল তোলার সময়কে সৌর বর্ষের সাথে সামঞ্জস্য করার লক্ষ্যে সূর্যকে মানদন্ড ধরে সৌরবর্ষ অথবা ফসলি বর্ষ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই সৌরবর্ষ ও চান্দ্র বৎসরের ব্যবধানকে যথাযথভাবে সংযোজিত করে নতুন বঙ্গাব্দের পরিচয় বহনে এই দিনের প্রারম্ভ। আসলে এটি চান্দ্র ও সৌর বৎসরের নবতর সম্মিলন। নক্ষত্র মন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারাসমূহের অবস্থানের উপর ভিত্তি করেই বঙ্গাব্দের বার মাসের নামকরণ করা হয়েছে। সূর্যসিদ্ধান্ত নামে জ্যোতীর্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ থেকে নেয়া নক্ষত্র তথা বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, মৃগশিরা, পুষ্যা, মঘা, উত্তরফাল্গুনী, চিত্রা ইত্যাদির নামানুসারে বাংলা মাসের নাম যথাক্রমে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ন (মাঘশীর্ষ), পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্রের নামকরণ হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, বর্ষ গণনায় সে সময় প্রতিটি মাসের ৩০ বা ৩১ প্রতিটি দিনের নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহানই বিভিন্ন গ্রহ–নক্ষত্রের নামানুসারে পুরো মাসকে সপ্তাহে বিভক্ত করে দিনগুলোর নামকরণ করেছিলেন এবং পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রবিবারকে সপ্তাহের ১ম দিন হিসেবে ধার্য্য করেছিলেন। সূর্য দেবতার নামানুসারে রবিবার, শিব দেবতার নামানুসারে সোমবার, মঙ্গল গ্রহের নামানুসারে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহের নামানুসারে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহের নামানুসারে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহের নামানুসারে শুক্রবার এবং শনি গ্রহের নামানুসারে শনিবার রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
অতএব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, এই বঙ্গাব্দের প্রচলন এবং এই নববর্ষকে বরণ করার যে প্রক্রিয়া বা অনুষ্ঠান তা সকল কিছুই মুসলমান শাসকদেরই সৃষ্ট এবং চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতিরই পরিবর্তিত বাহন। এটি শুধু বাঙালি জাতীয় কৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে না, বাঙালি সমাজের কৃষি ও অন্যান্য আর্থ–সামাজিক প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নতুন অলংকারে ভূষিত। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে সাবলীল আবর্তনে পরিপুষ্ট ঐতিহ্য ও কৃষ্টি চর্চায় বিকৃত মানসিকতার সন্নিবেশ ঘটানোর লক্ষ্যে এই অপ–প্রচারণা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই নববর্ষ প্রচলন ও উদযাপনে হিন্দুয়ানি বা হিন্দু সংস্কৃতির যে লেশমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই, এটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। জাতীয় কবি নজরুলের ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কা–পুরুষ লড়ে যায় বীর’ উচ্চারণে নির্দ্বিধায় বলা যায়; রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লালসবুজ পতাকার স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পুরো জাতি সমুদয় বীরের অভিধায় অভিসিক্ত। অন্ধকারের অপশক্তির বিরূপ প্রচারণা–কূপমন্ডুকতা–সাম্প্রদায়িকতা–অমানবিকতা–সহিংসতা–নৃশংসতা সংহার করে মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা বৈশাখী উৎসবকে উন্নয়ন জয়গানে নন্দিত করবেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল বাংলার নববর্ষকে ঘিরে কোন ধরনের সংঘাত, সংশয় বা কোন সম্প্রদায়ের বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে না দেখে সর্বজনীন বাঙালির উৎসব হিসেবে মানবতাবোধে দিক্ষিত হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই নববর্ষের চেতনা আরো সমৃদ্ধ–বিস্তৃত ও বিকশিত হোক এটিই সকল বাঙালির প্রত্যাশা। মহান স্রষ্টার কাছে জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে অধিকতর সুসজ্জিত করার প্রার্থনায় সকল বাঙালি ও বিশ্ববাসীকে জানাই বাংলা নববর্ষের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।