উত্তাল চুয়েট, সড়ক অবরোধ

দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ।। ৯ দাবি, ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন, ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম বাসটির ফিটনেস ছিল না, বললেন বিআরটিএর পরিচালক

রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান প্রতিনিধি | বুধবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ার সেলিমা কাদের কলেজ গেট এলাকায় বাসের ধাক্কায় চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধ করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে চুয়েট ক্যাম্পাসের প্রধান গেটের সামনে সড়কে অবস্থান নেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা কাপ্তাই সড়কে গাছ ফেলে, টায়ারে আগুন দিয়ে অবরোধ করেন। এদিন ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ৯ দফা দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন তারা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক এদিন দুপুরের পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সকল পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু বৈঠকের পরও সড়কে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ হয়নি। এমনকি সন্ধ্যার পরও সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা।

রাত ১০টার দিকে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চুয়েট পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে থাকা এসআই মোহাম্মদ জাবেদ। আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে আবার অবরোধ চলবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এদিকে চুয়েক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের সব দাবি ধীরে ধীরে পূরণ করবে।

চুয়েট শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিকের মৃত্যুর ঘটনায় চলমান আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি ঘোষণা করেছেন। দাবিগুলো হলো : পলাতক ড্রাইভার এবং তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তার, শাহ আমানত বাস কর্তৃপক্ষোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ভুক্তভোগীদের পরিবারকে যথার্থ ক্ষতিপূরণ দেওয়া। আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার এবং দাবি মেনে নিতে শাহ আমানত বাস কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা। চুয়েট কর্তৃপক্ষকে বাদী হয়ে মামলা করা। চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কের প্রশস্তকরণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু এবং এই রুটে দূরপাল্লার বাস ব্যতীত সকল লোকাল বাস (এবি ট্রাভেলস, শাহ আমানত ও অন্যান্য) চলাচল নিষিদ্ধ করা। চুয়েট মেডিকেল সেন্টারে সকল প্রকার প্যাথলজিকাল পরীক্ষা, এঙরে, ইসিজি ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্রপাতি নিশ্চিতকরণ এবং এই মুহূর্ত থেকে সকল অ্যাম্বুলেন্সে অঙিজেনপূর্ণ সিলিন্ডার, শ্বাস প্রদান যন্ত্রের ব্যবস্থাসহ সকল প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মেডিকেল সেন্টারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ পর্যায়ের চিকিৎসসেবা নিশ্চিত করা। অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে অপ্রতুল হওয়ায় অতি দ্রুত শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪টি অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চিত করা। চুয়েটের বাস সংখ্যা বৃদ্ধি, বিআরটিসি কর্তৃক শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, বাসের শিডিউল পুনঃনির্ধারণ। প্রতিটি পয়েন্টে ট্রাফিক বঙ ও সড়ক পুলিশের অবস্থান নিশ্চিতকরণ এবং সংখ্যা বৃদ্ধি। লাইসেন্স চেকসহ মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরো সড়ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এছাড়া রোড ডিভাইডার, স্পিড ব্রেকার, সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে গাড়ির স্পিডলক ও স্পিড মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আন্দোলনকালীন শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক সকল কার্যক্রম রিসিডিউল করা। এখন থেকে সকল শিক্ষার্থীর যেকোনো প্রয়োজনে ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং এই ব্যাপারে ছাত্রকল্যাণ পরিষদের প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এসব দাবি লিখিতভাবে না মানার অঙ্গীকারের আগ পর্যন্ত চুয়েটের সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে বলে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন।

গত সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ার সেলিমা কাদের কলেজ গেট এলাকায় মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন চুয়েটের তিন শিক্ষার্থী। দ্রুত গতির শাহ আমানত পরিবহনের একটি বাস শিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে মারা যান চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিক হোসাইন। এ ঘটনায় আহত হন জাকারিয়া হিমু। তিনি চুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এদিন সন্ধ্যায় দুই সহপাঠীর মৃত্যুর খবর ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছালে শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসের সামনে চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তিনটি বাস ভাঙচুর ও একটি বাসে আগুন দেন। ক্ষতিগ্রস্ত চারটি বাসই শাহ আমানত পরিবহনের।

গতকাল বেলা ১২টার দিকে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেলা ৩টায় শোকসভা ও দোয়া মাহফিলে অংশ নিয়েছেন চুয়েট ভিসি অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম, রেজিস্ট্রার ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরসহ অনুষদসমূহের ডিন, বিভাগীয় প্রধানগণ এবং চুয়েটের শিক্ষক, কর্মকর্তাগণ।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চুয়েট কর্তৃপক্ষ, চুয়েটের ছাত্র প্রতিনিধিবৃন্দ, বাস মালিক সমিতি, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে জেলা প্রশাসক গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বৈঠক করেন।

বৈঠকের বিষয়ে বাস মালিক সমিতির নেতা রাসেল চৌধুরী বলেন, দুপুর ২টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির মধ্যে ৬টি দাবি চুয়েটকেন্দ্রিক এবং বাকি দাবিগুলো দ্রুততার সাথে পূরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়া নিহত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আহত শিক্ষার্থীদের সরকারের পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা এবং বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আগামী এক মাস ধরে মোবাইল কোর্ট চালানো এবং এক মাসের মধ্যে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ শুরু করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

বৈঠকে চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া শাহ আমানত বাসের ফিটনেস ছিল না বলে জানান চট্টগ্রাম বিআরটিএর সহকারী পরিচালক রায়হানা আক্তার উর্থি। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে এই বাসের ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুই সহপাঠীর মৃত্যুর প্রতিবাদে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে তীব্র রোদ উপেক্ষা করে সড়কে অবস্থান নেন চুয়েটের শিক্ষার্থীরা। সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ব্যানারফেস্টুন হাতে নানা দাবি তুলে ধরেন তারা। চট্টগ্রামকাপ্তাই ব্যস্ততম সড়ক। আন্দোলনের কারণে এই স্থানে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে সড়কে চলাচলরত সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বেতাগীসহ আশেপাশের সড়ক ঘুরে যানবাহনগুলো চলতে দেখা গেছে।

রহিম উদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বাস চালককে এখনো আটক করতে পারেনি পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এভাবে আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবন অকালে ঝরে না যায়, সেভাবে সড়ক নিরাপদ করতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান তিনি।

অন্য একজন শিক্ষার্থী বলেন, লাইসেন্সবিহীন যানবাহন এবং বেপরোয়া বাস যেন সড়কে চলতে না পারে। গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার মধ্যে যেন আনা হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সড়কে প্রচুর সিএনজি টেঙি চলাচল করে। সেগুলো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে চলে। সেগুলোকেও যেন নিয়মনীতির মধ্যে আনা হয়, সেই দাবি তুলে ধরেন তিনি।

মো. রায়হান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, কাপ্তাই সড়কে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটে চললেও প্রশাসনের টনক নড়ে না। এবার যেন আর এমনটি করা না হয় সেই দাবি জানান তিনি।

পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলা হচ্ছে বলে জানান রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে সড়ক নিরাপদ করতে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি দুর্ঘটনায় জড়িত চালককে আটকে চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

চুয়েটের উপপরিচালক (জনসংযোগ) ফজলুর রহমান জানান, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে নিহত দুই শিক্ষার্থীর মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত
পরবর্তী নিবন্ধনিচের ১৫ কিলোমিটার সড়ক চসিকের নিকট হস্তান্তর