বলা যায় এখন চলছে ই- সময়। ‘ই’ বলতে বিশ্ব যখন সত্যিকারের ‘ই’ -এর ব্যবহারে করে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; সেখানে বাংলাদেশে চলছে ‘ই’ -এর অপব্যবহার। বাংলাদেশে আসা ‘ই’ টা আসলে পুরোনো শব্দগুলোর আগে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে মাত্র। বাকি সব আগের সেই পুরোনোতেই চলছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ‘ই’ ঠিকই ‘ই’ -এর আদলেই চলছে। সম্প্রতি আলোচনায় আসা ‘ই ভ্যালি’ ও ‘ই অরেঞ্জ’ নিয়ে মানুষের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা থেকে এই লেখার প্রয়াস।
মূলত বহুস্তর বিশিষ্ট বিপণন ব্যবস্থা, যা ইংরেজি ভাষায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) হিসাবে পরিচিত। এটি আবার পিরামিড সেলিং, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, এবং রেফারাল মার্কেটিং নামেও পরিচিত। পিরামিড সেলিং কৌশলে তাত্ত্বিকভাবে লাভ আসে দুই দিক থেকে -১. ক্রেতার কাছে সরাসরি বিক্রয় এবং বিক্রয় দলের সদস্য, ডাউন লাইন নামে খ্যাত, তাদের বিক্রয়ের উপর কমিশন থেকে। সাধারণত এমএলএম বিক্রয়কর্মীরা ভোক্তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক ও ওয়ার্ড অফ মাউথ বিপণনের ভিত্তিতে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিয়ে থাকে।
যতটুকু জানা যায়, প্রডাকশনে থাকা বড় ধরনের কোম্পানিগুলো যদি চায় যে তাদের পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেবে সেখানে মধ্যস্থতাকারী ডিলার বা এজেন্ট বা সর্বশেষ পাইকারি বা খুচরা বিক্রেতার যে কমিশন থাকে সেটি বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে ভাগ করে শুধুমাত্র বিক্রয়কর্মী ও ক্রেতার মধ্যে বণ্টন করবে- এটিই মূলত এমএলএম পদ্ধতির মূল ধারণা হওয়ার কথা। এতে ভোক্তা সাধারণ অতি কম মূল্যে পণ্যটি পেতে পারে। যা কোম্পানির প্রতি ভোক্তার আস্থারও সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রেই কেবল এমএলএম কোম্পানির সফলতা দেখা যাবে। কিন্তু পিরামিড পদ্ধতির সিস্টেমেই যত বিপত্তি। সেখানে নিম্ন থেকে উপরে ওঠা বিক্রয়কর্মী ধারাবাহিক ভাবে যে কমিশনের ভাগ পেয়ে থাকে সেখানে দেখা যায় পণ্যের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে ঠিক মধ্যস্থায় থাকা ডিলার বা এজেন্ট বা খুচরা বিক্রেতাদের কমিশনের চেয়েও বেশি হয়ে যায়। এতে ভোক্তার কোনো লাভ হয় না। তাই বলা হচ্ছে পিরামিড আকৃতির এমএলএম ব্যবসা অতি ঝুঁকিরও। অন্যদিকে এমএলএম ব্যবসা শুধুমাত্র প্রডাকশনে থাকা কোম্পানিরই আয়ত্ত্বাধীন হওয়া সমীচীন। কিন্তু দেখা যায়, কোন প্রডাক্টই নেই এমন এমএলএম হাউজ গড়ে উঠেছে। আবার সেখানে পণ্যের বালাই নেই আছে শুধু কমিশন।
১৯৯৬ সালে ‘যুবক’ নামে এমএলএম কোম্পানি বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ও সাধারণ ভোক্তাদের কোটিপতি হওয়ার পথ দেখায়। কমিশনের নামে মূলধন হিসেবে উল্টো টাকা নিয়ে দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষের টাকা আত্মসাত করে পথে বসিয়ে দিয়েছে অনেককে। এরপর ২০০২ সালে একই পন্থায় আসে ডেসটিনি-২০০০ নামক এমএলএম আরেক কোম্পানি। তারাও দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। পরে সেটি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ততক্ষণে ফতুর হয়েছে লাখ লাখ পরিবার।
এর পরও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন কৌশলে অসংখ্য এমএলএম কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবে আমাদের দেশে কোম্পানিগুলো ব্যবসার ধরন ‘এমএলএম’ না বলে ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং’ হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
যদিও ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী সব ধরনের এমএলএম বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরপরও বিভিন্নসময়ে ইউনিপে টু, তিয়ানশি, সেফ প্রাইভেট লিমিটেড, সামি, রিচ নামে বাংলাদেশে এমএলএম কোম্পানি পরিচালনা করে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কয়েকদিন গ্রাহকদের হা হুতাশ শেষে দেখা যায় আবারো ভিন্ন কোনো কৌশলে কেউ অফিস খুলেছে। এমনি করে ঠিকই আবার ফেঁসে যায় পুরোনো কারো সাথে নতুন কেউ কেউ। জমে উঠে ব্যবসা। রাতারাতি লাভের আশায় ছুটে সবাই পেছনে। আসল না নকল দেখে না। কিন্তু একসময় কপাট বন্ধ হলে আবার কান্না। লাভের সময় কেউ কিন্তু প্রশাসনকে জানায় না। খবর দেয় না। ভাবে আগে নিজে কিছু কামিয়ে নি। এভাবে সময় নষ্ট করে পরে জানে প্রশাসন। অথবা আগে জানলেও তারাও হয়তো লাভের লোভে গা দেয় না। ফলে যা হবার তা-ই ঘটে।
মোদ্দা কথা হল- লাভের লোভে সবাই প্রথমে ছুটে গিয়ে ব্যবসায় শামিল হয়ে পড়ে। পরে যখন বিপদ দেখে তখন করার থাকে না কিছু। আর এখানেই ঘটে বিপত্তি।
সম্প্রতি ‘ই’ দিয়ে শুরু হওয়া ‘ই-ভ্যালি’ অনেক নাম কামালো। সবাই ব্যবসা করে যাচ্ছেন তাদের সাথে। সেই একই অবস্থা তাদের নিজস্ব কোনো প্রডাক্টই নেই, পরের প্রডাক্টে পোদ্দারি করেন। দ্বিগুণ আর তিনগুণ লাভের আশায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কেউ কিন্তু ভাবেননি এই প্রতিষ্ঠান এত কম দামে কি করে পণ্য দিচ্ছে। এতে তো পেছনের সারির লোকেরা ধরা পড়বে নিশ্চিত! তো সবাই ওই যে লাভের লোভে গা ভাসালেন। এখন যা হবার তা-ই হচ্ছে। জানা গেছে, অনেকে তো বাড়তি লাভের আশায় ব্যবসাও শুরু করেছেন। ঋণও নিয়ে টাকা ঢুকিয়েছেন ই-ভ্যালিতে। একে তো কম দামে পণ্য পাবেন। এনে সেটা বিক্রি করবেন বেশি দামে। আর না পেলে দ্বিগুণ বা তিনগুণ লাভ। খারাপ তো নয় ব্যবসা। ব্যস; এখন কাঁদো। এবার সরকারের দোষ! দেশে কি কোনো সরকার নেই! আরে ভাই আপনিই তো সরকারকে খবর দেন নি! লাভের জন্য! তবে কেউ যে জানে না তা তো নয়। যারা জানলেন তারা ওতো আসলে লাভের লোভে চুপ ছিলেন! বলবেন কি ভাই। দেখতে না দেখতে এসে গেল ‘ই-অরেঞ্জ’র খবর। একই পদ্ধতি। পুরোনো এমএলএম ব্যবসার আদলে লাভের উপর লাভের হাতছানি। আর লোভী মানুষের ছুটোছুটি। এখন যা ঘটার তা-ই ঘটছে।
বলবেন, সরকার কি দেখে না এসব ? তবে শুনুন সরকারের কথা।
২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এ আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় একই বছরের ২২ জুলাই। আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এ্যান্ড ফার্মস (রেজসকো) কে লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
আইনে বলা রয়েছে, পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্য সহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খবরে প্রকাশ -২০১৪ সালের ৫ মার্চ ১ বছরের জন্য ৪ কোম্পানিকে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেয় রেজসকো। কোম্পানিগুলো হচ্ছে এমএঙএন মডার্ন হারবাল ওয়ার্ল্ডভিশন ২১, স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড ও রিচ বিজনেস সিস্টেম। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠলে কোম্পানিগুলো লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করলেও রেজসকো নবায়ন করেনি।
পরে ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এমএলএম কোম্পানি প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এমএলএম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। এরা নানাভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করে। এজন্য এখন এগুলো বন্ধ আছে, কাউকে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না।’
এত কিছুর পরও যখন পুরনোরা নতুন করে প্রলোভন দেখিয়ে মার্কেটে আসে তখন সবাই কিন্তু বিষয়টা বুঝতে পারে। কিন্তু আগে নিজে লাভ নিয়ে সরে পড়ার চিন্তা থেকেই কিন্তু ঘটছে যত বিপত্তি। তাই তো বলি ভাই কাঁদেন কেন? অপেক্ষা করেন আরেকটা কোম্পানি তো কয়েকদিন পর আসবে তখন না হয় আপনি প্রথমে ঢুকে পড়বেন। দেখবেন লাভ নিয়ে ফিরেছেন। আর শেষে যারা ঢুকবেন তারা এখন যেমন আপনি মাঠে হা হুতাশ করছেন তখন তারা হা হুতাশ করবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।