ইতিহাসের মহাকাল থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্সপাখি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

সবুজ মণ্ডল | বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসের পবিত্র অনুভূতির নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রেরণার একমাত্র উচ্ছ্বাস ও উদ্যমের আঁতুড়ঘর জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-কূপমুণ্ডকতার ধ্বংসস্তূপের বিপরীতে শাণিত মেধা মননের অপূর্ব মিশেলে জেগে উঠা গ্রীক পুরাণের সেই ফিনিঙ পাখির সমার্থক শব্দ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কবি সুকান্তের সেই দুর্দান্ত-দুর্বিনীত আঠারো বছর বয়স, যে সংগঠনের আলোকপথের যাত্রীরা সংকটে-সংগ্রামে চরম দুঃসাহস নিয়ে বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো ছুটে চলে।

বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। তিনি ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পর বাঙালিরা নতুন ভাবে শোষণের যাঁতাকলে পড়ে। যাকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘এক শকুনির হাত থেকে অন্য শকুনির হাত বদল মাত্র।’

তাই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সরকার প্রথমে আঘাত হানে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার উপর। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান জাতির পিতা জানতেন, অক্ষয় মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজই পারে শোষণের কালো দাঁত ভেঙে দিয়ে মেধা-মনন-মানবীয়তার মিশেলে অক্ষয় অমরাবতী রচনা করতে।

আর এজন্যই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘শিক্ষা শান্তি প্রগতি’ মানবীয় মূলমন্ত্রে ছাত্রসমাজকে দীক্ষিত করে বাংলা, বাঙালি, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে নাঈমুদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার সময় এ সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পরিবর্তে ছাত্রসংগঠনটির নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

তরুণ মুজিবের কাঁচা বয়েসের নেতৃত্বের নান্দনিকতা, ক্ষুদিরামের প্রত্যয়, নজরুলের বিদ্রোহী মনোভাব, সুকান্তের অবিচল চেতনার মঙ্গলপ্রদীপ চিরজাগ্রত ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর অন্তরাত্মায়। কৈশোরের দুরন্তপণা, তারুণ্যের উচ্ছ্বল প্রাণ বন্যায় ভরপুর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দেশের ইতিহাসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, লড়াই করেছেন প্রতিটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।

ঠিক এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস।’ ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে যে কোনো পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। তেইশ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তে গঙ্গা বহাইয়া দেব। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার বীর শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।’

বঙ্গবন্ধুর কথাতেই তার একান্ত অনুগত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সতেরো হাজার নেতা-কর্মীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের বুকের তাজা রক্তে এঁকেছেন লাল-সবুজের পতাকা, এঁকেছেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক সার্বভৌম বাংলাদেশের মানচিত্র।

সময়ের বেড়াজালে দীর্ঘ কোমল-কুসুম-কণ্টকাতীর্ণ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সংগঠন হিসেবে একটি দুর্জয়ী কাফেলায় পরিণত হয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে হারানোর পর প্রথমে খুনি মোশতাক সরকার এবং পরে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জেল-জুলুম-হুলিয়ার শিকার হয়ে পিতাহারা অগুণিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে কারাবরণ, দেশত্যাগ, অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে যে কালো মেঘ গ্রাস করেছিল, সেই মেঘ সরাতে প্রত্যাশার সূর্য হাতে ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন বাংলার ‘জোয়ান অফ আর্ক’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। মায়ের মমতা আর বোনের ভালোবাসায় ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করেন, দিয়েছেন আরো গতিশীলতা, করেছেন শক্তিশালী।

সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্যের ১০দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্র সমাজের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয় তারা। ১৯৮৮ সালে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনটি। ১৯৯৮ সালের বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একই কার্যক্রম নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।

১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন, ২০০২ সালে শামসুন্নাহার হলে ঢুকে ছাত্রীদের শারীরিকভাবে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে দোষীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন, ২০০৭ সালে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আটক শেখ হাসিনাকে মুক্তির আন্দোলনসহ সব রকম দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সব সময়ই ছিল সামনের কাতারে।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী উদ্ধৃত করা আছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একমাত্র অভিভাবক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন- ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবন-এই হোক তোমাদের জীবনাদর্শ।’

যদি কোন রাজনীতিক এ মর্মবাণীকে মার্গ হিসেবে মেনে পথ চলতে পারে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে তার পদধূলি অবশ্যাম্ভাবী।

পলাশ শিমুলের রক্তে আঁকা রাজপথে ছাত্রলীগের প্রতিটা নেতাকর্মী যেভাবে স্লোগানে-সংগ্রামে একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আরেক হাতে বিদ্রোহী রণতূর্য নিয়ে সরব ছিল, ঠিক তেমনি ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে। ছাত্রলীগ জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। করোনা ভাইরাস মহামারিকালেও সাধারণ মানুষের পাশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়েছেন, মৃতদেহ সৎকার করেছেন। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণসহ করোনাকালে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজ করেছে ছাত্রলীগ। করোনাকালে কোথাও অঙিজেন সিলিণ্ডারের অভাব দেখা দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিনামূল্যে সেটি সরবরাহ করেছেন। বোরো মৌসুমে হাওড়াঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিকের অভাব দেখা দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধান কেটে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।

বাংলার প্রতিটি ছাত্রলীগ কর্মীই যেন-বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলে।
‘দিন বদলের বইছে হাওয়া
বই খাতা কলম মোদের প্রথম চাওয়া।’

ছাত্রলীগের অগুণতি নেতাকর্মীদের এহেন চাওয়া শুধু স্লোগানের ফুলঝুরিতে নয়, স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জাতীয় শিশুদিবস, শেখ রাসেল দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, পথশিশুদের জন্য ভ্রাম্যমান পাঠদান কর্মসূচি, মুজিব কর্ণার ও পাঠাগার গঠনসহ বিভিন্ন শিক্ষাবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচীর উদ্যোগ গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের চর্চা।

ছাত্রলীগ বৃহৎ একটি ছাত্রসংগঠন, নিবেদিত অগুণতি নেতা-কর্মী-সমর্থকের শ্রমে ঘামে উচ্চশির ধ্বজাবাহী এ ছাত্রসংগঠনের ঐতিহ্য-ইতিহাস কখনোই গুটিকয়েক অনাকাঙ্খিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শের মাপকাঠিতে নির্ণিত হতে পারে না। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে এজন্যই ছাত্রলীগকে সমালোচিত হতে হয়, কিন্তু তারপরেও ছাত্রলীগকে দমে যায় না। দমানো যাবে না। কারণ প্রতিটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর কানে বাজতে থাকে তাদের একমাত্র অভিভাবক, শত হতাশার মাঝে আশার বাতিঘর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাংগঠনিক বাণী-

‘যদি আলোচিত হতে চাও, সমালোচনাকে ভয় করো না। মনে রেখো সমালোচনাও এক প্রকার আলোচনা।’ অতঃপর হাঁটিহাঁটি পা পা করে জাতির জনকের মস্তিষ্কপ্রসূত যে সংগঠন ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে জন্ম নিয়েছিল সেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ৭৪টি বছর পেরিয়ে ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে। যে সকল নেতাকর্মীর শ্রমে ঘামে, মধ্যগগনে ঘর্মাক্ত রাজপথে স্লোগানে সংগ্রামে ভীত শক্ত করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে চির উন্নত মম শির হয়ে, সে-ই সকল কর্মীসমর্থকদের অক্লান্ত শ্রম-ঘাম ও ত্যাগের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।

লেখক: সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করে বনায়ন
পরবর্তী নিবন্ধসমাজসেবায় সম্মাননা পেল মমতা