আয়শা খানম ও তাঁর লেখা একটি অনন্য গ্রন্থ

হান্নানা বেগম | শুক্রবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সময়ে ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, জনতার বিজয় আমাদের মধ্যে একধরনের আত্মপ্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছিল। দেশ, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা এনে দিয়েছিল। আর দেশকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার স্বপ্ন এনে দিয়েছিল। বিষয়টা এমন হয়েছিল, নিজের কাজ আর দেশের কাজ একাকার হয়ে উঠেছিল। সংগঠনের কাজ আর ব্যক্তিগত কাজ কখনও ফারাক মনে হতো না। দেশ হয়ে উঠেছিল আমাদের বিশাল একটি সংসার। বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। গোঁড়ার কথা, সবাইকে রাজনীতি বুঝতে হবে। তার আগে গড়ে তুলতে হবে একটি মজবুত নারী সংগঠন। দেশের অর্ধেক মানুষকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। বীরকন্যা প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, কল্পনা যোশী অনেক দিয়েছেন দেশকে। তাঁদের প্রতিটি আন্দোলন আপন মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছে। কিন্তু পলি জমেনি, সংগঠনের ধারাবাহিকতায় এসব ধরে রাখা যায়নি।
ঊনসত্তরে বিভিন্ন স্তরের জনতার দাবি অনুযায়ী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। নারী সমাজ গড়ে তুলল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। এ সংগ্রাম পরিষদের নেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। আহ্বায়িকা মালেকা বেগম। মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল প্রধান। যাদের এখনও নারী আন্দোলনের পুরোভাগে পাওয়া যায় তাঁরা হলেন-ঢাকায় আয়েশা খানম, ফওজিয়া মোসলেম, মাখদুমা নার্গিস, কাজী মমতা হেনা। চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজল, বেগম মুশতারী শফি, হান্নানা বেগম, নূরজাহান খান, সীমা চক্রবর্তী, দিল আফরোজ, নাজমে আরা, চিত্রা বিশ্বাস, ননীবালা বড়ুয়া, জাহেদা মনসুরা, রমা দত্ত, খুরশীদা আজিম, গুলশান আরা বেগম, মিসেস মন্ডল প্রমুখ।
আয়শা খানমের অবদান একদিকে সংগঠন গড়ে তোলা অন্যদিকে বিশ্ব অবয়বে নারীর অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধকতা ও লেখনীর মাধ্যমে তাত্ত্বিক চিন্তা ধারা উপস্থাপন করা। তাঁরই একটি প্রকাশিত গ্রন্থ “নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে”। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। প্রকাশক ওসমান গনি আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
গ্রন্থে আলোচিত বিষয়সমূহ হলো- “মানবাধিকার ধারণা: ক্রমবিকাশ”। “একুশ শতক: নারী-পুরুষ সমতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, শান্তির আন্দোলন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ”। “বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি”। “স্বপ্নদ্রষ্টা রোকেয়া সাখায়াৎ হোসেন একুশ শতক ও বাংলাদেশের নারী”। “সুফিয়া কামাল ও বাংলাদেশের নারী আন্দোলন”। “জাতিসংঘ সিডও সনদ এবং নারীর ক্ষমতায়ন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত”। “বেটি ফ্রেইডেনের দ্য ফেমিনিন মিস্টিকের পঞ্চাশ বছর ও আমেরিকার নারীজাগরণ”। “চিরকালের চিরঞ্জীব হেনা দাস”। “কৃষক নারী: সভ্যতার পিলসুজ”। “ছাত্রী-তরুণী-কিশোরীদের প্রতি নিষ্ঠুর সহিংস নির্যাতনমূলক আচরণ ও বাংলাদেশে নারীর মানবাধিকার”। “জাতিসংঘ নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিশনের ৫৬তম অধিবেশন: কতক অভিজ্ঞতা”। “জীবনে দায়বদ্ধ এক মানুষ বেবী মওদুদ”। “গণমাধ্যম ও নারীর মানবাধিকার আন্দোলন”। “অর্জন অনেক-করণীয় আরও কঠিন জটিল ও গভীর”। “নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রম ও নারী পুলিশের ভূমিকা”। “নারীর প্রগতিই রাষ্ট্রের প্রগতি”।
গ্রন্থের প্রথমে তাত্ত্বিক আলোচনার পর লেখক আয়শা খানম ‘একুশ শতক: নারী-পুরুষ সমতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, শান্তির আন্দোলন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ এসব বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন।
এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে মানুষ জন্মসূত্রে স্বাধীন, কিন্তু প্রতিক্ষেত্রে প্রতি পদেই তাকে পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে অগ্রসর হতে হয়। নারীও জন্মসূত্রে পূর্ণ মানব সন্তান, কিন্তু মানুষের সমাজেরই তৈরি প্রথা, নিয়ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আইন, ধর্ম ইত্যাদির নামে তাকে মানব অর্ধমানব বা মেয়ে মানুষ বানিয়ে ফেলা হয়। তখন নারীকে নারীর সমর্থনকারী সমাজ চিন্তক ও গোষ্ঠীকে সেই প্রথা, নিয়ম, ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এর নাম হয় নারীমুক্তি আন্দোলন বা নারীর পূর্ণমানব হয়ে ওঠার আন্দোলন। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ও রক্ষার আন্দোলনের এই প্রচেষ্টা শুরু হয় বিশ্ব মানব মুক্তি আন্দোলনের সাথে সাথে। গ্রন্থে তিনি আরও যে মত প্রকাশ করেছেন তাহলো প্রগতি আর আন্দোলনের ধারা কখনও কোন একরৈখিক সমান্তরাল রেখা ধরে এগোয় না, নানা চড়াই উৎরাই এর ভেতর দিয়ে এই ধারার আন্দোলনকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হয়। এটিই ঐতিহাসিক বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা।
একুশ শতক বিশ্বজীননভাবে ও এশিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি, প্রগতির ধারা অগ্রসর করার জন্য কি কি নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি করছে, যা নারী পুরুষের সমতার আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তা নিয়ে পর্যালোচনা, মূল্যায়ন, শিক্ষা গ্রহণ এবং সে আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি।
জাতিসংঘ কর্তৃক কিছুটা মূল্যায়ণমূলক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩ (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে) বর্ণিত হয়েছে, বহুভাবে ভিন্নমুখী আজকের বিশ্বে দক্ষিণের এক উত্থান ঘটেছে। একটি ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর্থিক ক্ষেত্রে তো বটেই কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষেত্রেও এই অগ্রসরমানতার ধারা বিদ্যমান। এই ধারা যথাযথ অনুধাবন বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের আজকের অন্যতম জরুরি কাজ।
নারী আন্দোলন হলো চলমান ঐতিহাসিক একটি ধারা যা কখনো নমনীয়, কখনো কখনো সংস্কারমূলক, কখনো বিপ্লবাত্মক ভঙ্গিতে কাজ করে, এগিয়ে চলে। সামাজিক বিকাশের মতই এই ধারা। নারী আন্দোলন একটি দেশ ও সমাজের ধারাবাহিক বিকাশের মত এগিয়ে চলে।
একক মহিলা পরিষদের বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা ও আন্দোলন, মানবাধিকার উন্নয়ন সংগঠন, সরকার, সকলের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পিতৃতান্ত্রিকতার কারণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো প্রতীকি প্রক্রিয়ায় আছে। নারী কৃষক তার ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ থেকে বহুক্ষেত্রেই এখনো বঞ্চিত-রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারকে আরও মানবিক সংস্কৃতির নীতি গ্রহণের অনুসারী করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচি, শিক্ষা নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি নারী আন্দোলনে দৃষ্টি দিতে হবে জোরালোভাবে সক্রিয়ভাবে।
২০১৪-২০২৪/২৫ অন্তত আগামী এই দুই দশকের কর্মসূচি প্রণয়নে মহিলা পরিষদকে গত দুই দশকের গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন- ফলাফল, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা গভীর বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এ কাজে কমিশন ইস্যুভিত্তিক আলোচনা একটি বাস্তব কার্যকর পদ্ধতি।
নতুন শতাব্দী নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী কী নতুন সুযোগ ও নবতর সম্ভাবনার কী দ্বার খুলেছে তা বিশদভাবে দেখা দরকার। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কী কী ভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন সংকট নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, কোন ধরনের ঝুঁকি সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে, আর তা মোকাবিলায় কী কী সাংগঠনিক, আন্দোলনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সুদূরপ্রসারী ফল বহনকারী সহায়ক শক্তির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা দরকার, নতুন পরিস্থিতি, দক্ষতা, যোগ্যতা দায়বদ্ধতার সাথে মোকাবিলা করা যায় তার জন্য কী ধরনের পাঠ্যসূচিভিত্তিক প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার সে বিষয়ে সারা দেশের সর্বাধিক সংখ্যক কর্মী সংগঠকদের মতামত অভিজ্ঞতা জানা দরকার। যাতে সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি অধিকতর বাস্তব অধিকতর জীবনঘনিষ্ঠ হতে পারে। এমনিভাবে গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বনারী ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্মেলনগুলোতেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। মহিলা পরিষদ দেড় দশক ধরে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে।
আশা করা যায়, গত কয়েকটি সম্মেলনে গৃহীত বিষয়ভিত্তিক কমিশন আলোচনায় প্রাপ্ত সুপারিশ ও বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক আলোচনার আলোকে মহিলা পরিষদ ভবিষ্যত কর্মসূচি সুদূরপ্রসারী দূরগামী দৃষ্টিভঙ্গিকে নারীর অধিকার তথা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও মানবতার সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো প্রসারিত করবে। বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নিধারণ করে সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সময়ের সৃষ্ট সুযোগ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে এই সময়ের বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতাকে বিশদভাবে জানতে হবে।
লেখক আয়শা খানম তার গ্রন্থে নারীর ক্ষমতায়ন ও পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি শিরোনামে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন আজকের বাংলাদেশের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় একদিকে বিশাল আলো সূর্যের মত জ্বলজ্বল করছে কোটি কোটি নারী সাহসী, সংগ্রামী, প্রত্যয়ী এবং তারা নির্ভীক চিত্তে বাংলাদেশকে অগ্রসর করে নিয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশের অন্যদিকে আমরা দেখছি যে এই নারীরই একটি বিশাল অংশ প্রতি মুহূর্তে নানামুখী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
লেখক আয়শা খানম বলেছেন, আজকের বাংলাদেশের নারী হিমালয়ের চূড়ায় উঠা থেকে শুরু করে চাতালের কাজ, সেনাবাহিনী থেকে চা বাগানের দুটি পাতা একটি কুড়ি সংগ্রহ, প্যারাস্যুট জাম্পিং থেকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে (চবধপব কববঢ়রহম) কাজ করছে। সামরিক বাহিনীতে, সাংবাদিকতায়, গণমাধ্যমকর্মীর ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে, সিডর-আইলাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায়, পোশাক-শিল্পে, কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, ব্যাংকে, প্রশাসনে, অফিস-আদালতে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে- সর্বত্র নারী অংশগ্রহণ করছে, কার্যকর ভূমিকা রাখছে। জাতীয় সংসদে, তৃণমূলে, ইউনিয়ন পরিষদে, মন্ত্রিসভায় তথা রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বত্র সাধারণ গণনারী, গণপেশাজীবী নারী দায়বদ্ধতা দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর হওয়া ও সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পূর্বের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রমশ সামনে অগ্রসর হচ্ছে এবং তা বৈশ্বিকভাবে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে বিদ্যমান আছে অনেক পরস্পরবিরোধী দৃশ্য।
লেখক কৃষক নারী সম্পর্কে বলেছেন, সমাজ সভ্যতার আদি ইতিহাসের সমাজতাত্ত্বিক (ঝড়পরড়ষড়মরপধষ) বয়ানে জানা যায় কৃষি নারীর আবিষ্কার (অমৎরপঁষঃঁৎব রং ধ ভবসধষব ফরংপড়াবৎু)। মানব সমাজের সেই আদি ইতিহাসের ধারা, সহস্র বছরের বিকাশের ধারা আজও পর্যন্ত বহমান। তবে পূর্ব ও পশ্চিমের কৃষিকাজের ধারা পরিবর্তন হয়েছে। রূপান্তর ঘটেছে কৃষিকাজের পদ্ধতিতে, কৃষকের আর্থ-সামাজিক জীবনে। তাদের মতই মানবগোষ্ঠীর আরেকটি গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে শিল্পের বিকাশে। তাদের মাধ্যমেও সভ্যতার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রাম থেকে উঠে এসে শহরের কারখানায় কাজ করে তারা, তাদের নাম শ্রমিক।

নারীর সমঅধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল বা কর্মসূচি তথা চুক্তি জাতিসংঘ সিডও সনদের ধারা-১৪ গ্রামীণ নারী- এই ধারায় ২নং উপ-ধারায় রয়েছে (নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ধারা-১৪: গ্রামীণ নারী, উপ-ধারা-২): (ঙ) কর্মসংস্থান অথবা স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধাদি লাভের সমান সুযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে স্ব-সাহায্য গ্রুপ ও সমবায় সংগঠিত করা; (ছ) কৃষি ঋণ ও অন্যান্য ঋণ, বাজারজাতকরণ সুবিধা ও উপযুক্ত প্রযুক্তি লাভের সুযোগ পাওয়া এবং ভূমি ও কৃষি সংস্কার ও সেই সাথে ভূমি পুনর্বন্টন স্কীমের ক্ষেত্রে সমান অধিকার লাভ করা;
মোটা দাগে সিডও’র ১৪নং ধারা মূল কর্মসূচি ও মর্মবাণীর আলোকে বাংলাদেশের কৃষক নারীর জন্য যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ অধিকার ও সুযোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র, সরকার এবং নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ও উন্নয়ন সংগঠনসমূহকে আরো সচেতন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
জাতিসংঘ সিডও সনদের ক্ষেত্রেও এই প্রকার রাষ্ট্রের দায়বদ্ধ আচরণ ও ভূমিকা পালনের পদ্ধতি আছে। যখন এমন অগ্রসর পদ্ধতিতে সরকার ও নাগরিকসমাজ কাজ করছে তখন পাশাপাশি একই সময়ে বাংলাদেশের কিশোরী-তরুণী-ছাত্রী তথা নারী নির্যাতন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সামগ্রিক চিত্রটা একটু পরিবীক্ষণ করা হলে দেখা যাবে ব্যক্তি ও সমাজ কর্তৃক পরিবারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাস্তাঘাটে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র কীভাবে নিষ্ঠুর, সহিংস আচরণ করছে যা চরমতর মানবাধিকার লংঘন। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক অনুষ্ঠিত ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে যে ভিয়েনা ঘোষণা ও কর্ম-পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে সেই সম্মেলনে বিশ্ব মানবাধিকার ও বিশ্ব নারী আন্দোলন ঐতিহাসিক দুটি শ্লোগান পেয়েছে, তা হলো- নারী নির্যাতন মানবাধিকার লংঘন, নারীর অধিকার মানবাধিকার। বাংলাদেশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই নারীর, তরুণীর, কিশোরীর এই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তব অর্জিত ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে এক আবেগ ও বলিষ্ঠতামিশ্রিত যুক্তিশীল আওয়াজ উঠলো ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে। এই শ্লোগানে কেবল নারী ও মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংস্কৃতির আন্দোলনের কেবলমাত্র ভবিষ্যত দিক-নির্দেশনাই দিল না এতে ধ্বনিত হয়ে উঠলো কয়েক শতাব্দীর নারীর বঞ্চনা, অবহেলা আর পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র কর্তৃক নারীর প্রতি উদাসীন থাকার ও নারীর বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনার বিরুদ্ধে এক সতর্ক উচ্চারণ।
’৭১-এর পর থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত মোটাদাগে নারীর অর্জন ও সাফল্যের খতিয়ান করলে কয়েকটি চিত্র আমাদের সামনে দৃশ্যমান- বাংলাদেশের লাল সুবজ পতাকা হাতে নারী ক্রিকেট দল। ওয়ান ডে ক্রিকেট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি তাদের দ্রুত ধাবমান পায়ের বলিষ্ঠ পেশীতে চার দশকের অগ্রগতির অগ্রমুখী ধারা ও সমাজ বিকাশের ধারার বলিষ্ঠতার ছাপ দৃশ্যমান। সে দৃশ্য ইতিবাচক অর্থে অগ্রসরমান।
অথচ আশির দশকেও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তৎকালীন শাসকশ্রেণী কর্তৃক নারীদের উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলায় অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সরকারি রাজনৈতিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, সামাজিক পরিবেশ, রীতিনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি, প্রথা নারী করে তোলে। এই ইতিহাস বোঝার জন্য, জানার জন্য প্রয়োজন তত্ত্বগত জ্ঞান, প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, দর্শন- পর্যালোচনা, যেতে হয় ইতিহাস বিচারে। পরিবর্তনের বাহক নারী। এই পরিবর্তন কোন ধারায়, কীভাবে আনবে, তার প্রভাব পড়বে সমাজ রাষ্ট্রের জীবনে, তার জন্য তৈরি করতে হয় বাস্তব কাজের ধারা পদ্ধতির বয়ান।
বাংলাদেশের নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আমাদের একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে। আজ বাংলাদেশের বহুবিধ সংগ্রাম ও পথ চলার মধ্য দিয়ে চলছে। জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কাঠামোকে শক্তিশালী ও সুগভীর করে তোলা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরো অধিকতর প্রান্তিক জনমুখী করে তোলা পাশাপাশি পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন তথা নারী-পুরুষের সমঅধিকারকে (জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি) বাস্তবে কার্যকর করে তোলার বহুমাত্রিক সংগ্রামের ধারা অব্যাহত আছে। পরিশেষে প্রয়াত লেখক সংগঠক নারী নেত্রী আয়শা আপার উদ্দেশ্যে বলতে চাই। আপনি চলে গেলেন, আমরা জেগে আছি, জেগে আছে আমাদের এ মানবপ্রেম, দেশপ্রেম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাত্রা
পরবর্তী নিবন্ধসিজিএস স্কুলের কম্পিউটার চুরি, সিকিউরিটি অফিসারসহ গ্রেপ্তার ২