যাত্রা

সত্যব্রত বড়ুয়া | শুক্রবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ

ছেলেবেলায় আমি যাত্রাগান দেখতে খুব ভালোবাসতাম। এখনো বাসি। যাত্রায় অমলেন্দু বিশ্বাসের অভিনয় দেখে আমি এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, একদিন যাত্রা শেষে তাঁকে গিয়ে বললাম আমি যাত্রার দলে ঢুকতে চাই। তিনি বললেন আমাদের জীবন বড় কষ্টের। আমি বললাম এটা মোটেই কষ্টের নয়। আপনারা গ্রামে গ্রামে ঘুরেন। সারা রাত যাত্রা করে সারা দিন ঘুমোন। এটা আমার কাছে আনন্দের জীবন। অমলেন্দু বিশ্বাস বললেন, তোমার বাবা তোমাকে অনুমতি দেবেন না। আমি বললাম ঘর থেকে আমি পালিয়ে আসবো। আমি নাছোর বান্দা। অবশেষে তিনি রাজি হলেন। আনন্দে তাঁর পায়ের ধুলো নিলাম। আমি তাঁকে বললাম, আপনারা তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করতে জানেন না। আমি তাঁকে দুটো তরবারি আনতে বললাম। একটি তাঁর হাতে দিলাম। অন্যটি নিলাম আমি। বললাম যুদ্ধ শুরু করুন। এ যুদ্ধটা আমি করবো বোম্বে (মুম্বাই) ফ্লিমের হিরোদের মতো। অমলেন্দু বিশ্বাস কিছু বুঝবার আগেই আমি বোম্বাই স্টাইলে তাঁকে আঘাত করলাম। তিনি উঃ করে বসে পড়লেন। দেখলাম আমার ভোঁতা খেলনার তরবারির আঘাতে তাঁর বুড়ো আঙ্গুল কেটে রক্ত ঝরছে। তিনি যাত্রার ঢং এ হুংকার ছেড়ে বললেন, আমি থানায় যাচ্ছি। ওসিকে গিয়ে বলবো তুমি আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছ। বুঝবে মজা। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালাম। তিনি হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে বললেন, যাক্‌্‌ বাঁচা গেলো। আপদ বিদেয় হয়েছে। কিন্তু যাত্রা আমার পিছু ছাড়লোনা। আমার সব সময় মনে হতো আমি যাত্রার মানুষ। আমি আমার মা’র কাছে যাত্রার সুরে টেনে টেনে বলতাম, মা জননী আমি ক্ষুধার্ত, আমায় তুমি অন্ন দাও। তিনি রাগ করে বলতেন, দূর হ আমার সামনে থেকে। আমি যাত্রা দলের ‘বিবেক’ এর মতো গান গাইতে গাইতে চলে যেতাম। একবার আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রা পালা ‘চাষার ছেলে’র কিছু সংলাপ প্র্যাকটিস করছিলাম। বাবা কখন যে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা আমি টের পাইনি। তিনি এসে আমার কান ধরে টানতে টানতে উঠোনে এনে বললেন এক’শ বার উঠ বস কর। দেখলাম বাবা চিৎকার করে মাকে বলছেন, তুমি লাই দিয়ে দিয়ে ছেলেকে নষ্ট করে দিলে। যাত্রার ডাকাত সর্দারের বিকট শব্দের অট্টহাসি আমি রপ্ত করেছিলাম। এটা কাজ দিয়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়।
এ সময় রাজাকাররা গ্রামে লুটপাট করতো। একদিন আমাদের বাড়িতে হামলা চালালো। আমি ঘরেই ছিলাম। তারা দরজা খুলতে বললো। আমি ভেতর থেকে হঠাৎ উচ্চ কণ্ঠে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলাম। রাজাকাররা এ ধরনের অদ্ভুত হাসি কখনো শুনেনি। ওরা ভয় পেয়ে চলে গেলো। ভাগ্যিস যাত্রালি হাসি হাসতে শিখেছিলাম। আফসোস যাত্রা অভিনেতা হতে পারলাম না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকষ্টরাঙা আঙুলে
পরবর্তী নিবন্ধআয়শা খানম ও তাঁর লেখা একটি অনন্য গ্রন্থ