আয়না

জুয়েল আশরাফ | শুক্রবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বাঁশের বেড়ার ফাঁকে ভাঙা আয়নাটা গুজে থাকে রোজ। সঙ্গে থাকে মহিষের হাঁড় দিয়ে তৈরি উঁচু দাঁতওয়ালা চিরুনি। ভাঙা আয়নাটা সোবেদ উদ্দিনের ‘কাঁচ ঘর’ দোকান থেকে এনেছিল ইলিয়াস। এক টুকরো আয়না, দাম নেবে না জেনেও ভদ্রতার খাতিরে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট এগিয়ে ধরল। তাতেই সোবেদ উদ্দিন মহা ক্ষেপে গিয়েছিল। ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘অত বড়লোকি দেখাবি না। দরকার হয়েছে যখন বাড়ি নিয়ে যা। ভালো করে আয়নায় মুখ দেখে ভালো একটা কাজকামের ব্যবস্থা কর।’ মালিক মাত্রই কর্মচারির উপর চড়াও থাকে। সোবেদ উদ্দিন সেই দলের মালিক না। অতি উদার মানুষ সোবেদ ভাই।
ফ্রি আয়না ইলিয়াস বাড়ি বয়ে এনেছে। এরপর রোজ আয়নার দিকে তাকায়। কারণে-অকারণে তাকায়। আজ একটু পর পরই আয়না দেখছে। গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে আয়নার দিকে তাকায় ইলিয়াস। চটপট হাত চালায়। পোশাক এমন হতে হবে যাতে সেজেছে বলে মনে হবে না আবার পরিপাটিও থাকে। যুবক ইলিয়াসকে সুদর্শন না দেখালেও তার আকর্ষণীয় চেহারাটা অভাব অনটনের আড়ালে থেকে গেছে। আজ বিশেষ একটা দিন। তাই নিজেকে একটু সাজিয়ে নিচ্ছে। এসএসসি পাশ করার বেশ কয়েকবছর পর ঠিকঠাক কাজ পেয়েছে। এটা ইলিয়াসের বিশ্বাস। এর আগে কাজ করত একটা পাইকারী কাপড়ের দোকানে। গোডাউন থেকে মাল আনা-নেওয়ার কাজ। বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। মিনিট পঁচিশ লগাত। সকাল যাও, বিকাল বেলায় এসো। আবার সন্ধ্যাবেলা যাও, রাতে এসো। এমন অসময়ের কাজে একেবারেই খুশি ছিল না ইলিয়াস। কিন্তু উপায় নেই। বাধ্য কাজ করতে। বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ার পরে সংসারের দায়িত্ব তার ওপর। সংসার বলতে সে আর মা। বাবা অন্যের দোকানে চাকরি করে দুই কামরার টিন-বাঁশের বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারেননি। জমানো টাকা পয়সাও বিশেষ নেই। গোটা তিনেক ফিক্সড ডিপোজিট সম্বল। তাই চাইলেও কাজের বাছবিচার করা ইলিয়াসের সাজে না।
তবে ইলিয়াসের আক্ষেপ আছে। এই কাজের সময়ের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-গল্প ঠিক মত হয়ে ওঠে না। যদিও তার বন্ধু-বান্ধব খুবই কম। তাও যে কজন আছে তাদের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ বিদঘুটে সময়ের চাকরির কারণে বন্ধ। তার মতো দুপুরে কারো আড্ডা দেওয়ার সময় নেই। অথচ তার দুপুর ছাড়া সময় কোথায়? পারিবারিক অনুষ্ঠান, বন্ধুদের পার্টি কিছুতেই প্রায় সে যেতে পারে না। অন্য কাজের চেষ্টা অনেকদিন ধরে করে যাচ্ছিল।
এই কাজ পছন্দ না হওয়ার আরও কারণ আছে। টেনশন হয়। এই তো দুই মাস আগে কোথাও কিছু আভাসমাত্র নেই, হারুনের কাজ চলে গেল। একসঙ্গে কাজ করত। পরে কানাঘুষায় শুনল হারুন নাকি কী সব হিসাবে গন্ডগোল করেছিল। এতদিন সবাই হারুনকে একজন সৎ কর্মচারী বলে জানত। তার অসাধুতার কথা জানতে পেরে ইলিয়াছের মত বাকিরাও অবাক হয়েছিল।
হারুন সপ্তাহখানেক পরে তাকে ফোনে বলেছিল, জানিস তো হিসাবে কোনো গন্ডগোল হয়নি। মালিকের এক আত্মীয় এসেছিল দোকানে কাজের জন্য। আমার জায়গায় আত্মীয়কে নেওয়ার জন্য মালিক আমার ওপর হিসাবের গড়মিলের দোষ চাপিয়ে আমাকে ছাটাই করে দেন।
হারুনের কথা মিলে গেল। এই ঘটনার দিন তেইশের পরে একজন কাজে যোগ দিল। সেদিন থেকে ইলিয়াসের টেনশনের পারদ আরো বেড়ে গেল। কাজ না হলে তার চলবে না। অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য তার কাঁধে। শুধুমাত্র এস এস সি পাশ ডিগ্রী নিয়ে এই বাজারে চাকরি পাওয়া যায় না। কোনো দোকানের কর্মচারি হয়ে কাজ করতে হয়। একটা সেন্টারে ভর্তি হয়ে কম্পিউটারের প্রাথমিক শিখেছিল। সেইটুকুর ভরসা নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠল অন্য কাজ খুঁজতে।
অবশেষে সফল হল সে। একটা নামিদামি শপিংমলে পোশাকের দোকানে চাকরি পেল। বেতনও অনেক। কাজ পাওয়ার খবরে আশেপাশের লোকজনের উৎসাহ বেড়ে গেল কীভাবে সে চাকরিটা পেয়েছে? কাকে ধরাকরা করে হলো? নানাজনের নানা কথা। ইলিয়াস গায়ে মাখেনি সেসব। উড়ো কথারা যেমন উড়ে এসেছিল, ঠিক তেমনভাবেই মিলিয়ে গেল।
নতুন কাজে যোগ দেওয়ার উত্তেজনায় প্রথম দিন সময়ের কিছুটা আগেই পৌঁছে গেল কর্মস্থলে। প্রথম দিন কাজ করার থেকে কাজ বুঝে নেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দোকানের সিনিয়র কর্মচারি পাপ্পু ভাই, ধৈর্য ধরে ইলিয়াসকে বেশ কিছু কাজ বুঝিয়ে দিলেন। তার সঙ্গে এটাও বললেন, অসুবিধা হলে সোজা আমার কাছে চলে এসো। কাস্টমারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে কাজ করতে পারবে না। কথাটা মনে রেখো।
প্রথমদিন ইলিয়াস এতটা সাহায্য পাবে বলে আশা করেনি। রতন বলেছিল, এসব দেকানে কম্পিটিশন চলে। যেই কর্মচারি মালিককে বিক্রি বেশি দেখাতে পারবে তার বেতন বোনাস সবচেয়ে বেশি। কেউ কাউকে সাহায্য তো দূর পাত্তাও দেয় না। প্রথমদিকে আমি যা প্রবলেমে পড়েছিলাম সে আমিই জানি। খুব সাবধানে কাস্টমারদের হ্যান্ডেল করবি।
ছোটবেলার বন্ধু রতন। ছোট থেকে ইলিয়াসের বিস্তর ভরসা রতনের ওপর। এই প্রথমবার মনে হল রতন একেবারেই ঠিক কথা বলেনি।
প্রায় মাস পাঁচেক পর ইলিয়াসকে একদিন ক্যাশ কাউন্টারের দায়িত্ব নিতে হলো ক্যাশিয়ারের অনুপস্থিতির কারণে। সে ভয়ে ভয়ে কাজ সামলে ছিল। সেদিনও পাপ্পু ভাই সহায় হয়েছিলেন ইলিয়াসের। এরপর মাঝেমধ্যেই ইলিয়াসকে ক্যাশের কাজ সামলাতে হতো। একদিন গন্ডগোল হলো। সময়ের শেষে ক্যাশ মেলাবার সময়ে কিছুতেই একশ টাকার হিসাব ইলিয়াস মিলাতে পারল না। অনেক চেষ্টা করল। কিছুতেই মিলল না। নিজের টাকা দিয়ে হিসাব ঠিক করতে হলো। মেজাজ বিগড়ে গেল। সেদিন আবারও মনে হলো টেনশন তার পিছু ছাড়বে না।
তবে শুধুই টেনশন নয়, কাজ করতে এসে পাপ্পু ভাই ছাড়াও আরও দুই-একজন ভালো কর্মচারিকে পেয়েছে। তাছাড়া কতরকম মানুষজনকে দেখছে। কাজের মধ্যেও সেসব লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করে ইলিয়াস। গত ছয় মাস ধরে দেখে বুঝেছে কারা নিয়মিত দোকানের কাস্টমার। কারোর সঙ্গে ইলিয়াস ব্যক্তিগত আলাপে যায় না। যতটুকু বিক্রি ঠিক ততটুকুই কথা।
সেদিনও ইলিয়াস ক্যাশে বসেছে। খুব ভিড় না থাকলেও একেবারে ফাঁকা নয়। হঠাৎ ‘কী হলো কী হলো’ শব্দে চোখটা কাস্টমারের ওপরে চলে যায় ইলিয়াসের। দেখে ম্যানেজার আর পাপ্পু ভাই নিজ জায়গা থেকে জলদি বেরিয়ে কাস্টমারকে মেঝে থেকে উঠাচ্ছে।
বাকি কাস্টমারদের উদ্দেশ্যে পাপ্পু ভাই বলল, প্লিজ আপনারা ভিড় করবেন না। আমরা দেখছি তাকে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কথা ভেসে এলো, আপনারা দেখে কী করবেন? ডাক্তার ডাকুন। বয়স্ক মানুষ। কিছু হয়ে গেলে আপনারাই অসুবিধায় পড়বেন।
পাপ্পু ভাই বেশ কড়া গলায় বলে উঠল, সেসব নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামাতে হবে না। ভিড়টা হালকা করুন। তারপর আমরা দেখছি।
পাপ্পু ভাইয়ের কথায় কাজ হয়। ভিড় সরে যায়। ইলিয়াস এবার দেখতে পায়। দোকানের একজন বয়স্ক কাস্টমার অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
ডাক্তার ডাকতে হয় না। চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে দিতে জ্ঞান ফিরে আসে তার। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন লোকটি। তারপর দোকানের কর্মচারী শিবলু তাকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে আসে। ফিরে এসে শিবলু বলল, বেশ চিন্তা হচ্ছে লোকটির জন্য।
ইলিয়াস হেসে বলল, বাব্বাহ্‌! অচেনা কাস্টমারের জন্য এতো ভাবনা তোর? তোর দেখছি দরদীপ্রাণ।
শিবলু বলল, বয়স্ক মানুষ। একা থাকেন। একটা ছেলে। বাইরে কোথায় কাজ করে। ছোটখাটো কাজ। তার মধ্যেই যতটা পারে বাবাকে পাঠায়। একদিন এই লোকটিই কথার ছলে বলেছিল।
সেদিন ইলিয়াস আবারও গোলমালের সম্মুখীন হয়। ক্যাশ মেলেনি। এবারে টাকার অংক বেশি। এক হাজার। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। আবার হিসাব মেলাবার চেষ্টা করে। মেলে না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়াতে শুরু করে। বোতল খুলে গলায় পানি ঢালে। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে। নাহ্‌, সেখানেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এবার খুব রাগ হয় ইলিয়াসের। এ কেমন সব লোকজন? টাকা বেশি পেল বলেই নিয়ে চলে গেল! একবারও ভাবে না এই বেশি টাকার জন্য অন্য একজন কতটা সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আবার মনে হয় দুপুরে একজন কাস্টমার অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সময় সে একটু হলেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তখনই কোনো গণ্ডগোল সে নিজেই করে ফেলেনি তো? রাগে গজগজ করতে করতে টাকাটা ক্যাশে দিয়ে হিসাব মিলিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
এর আট দিন পরে সেই বয়স্ক কাস্টমার দোকানে আসেন। দোকানে অন্য কর্মচারি ছিল না। তার কাছে কম মূল্যে কাপড় বিক্রির জন্য আজ ইলিয়াস এগিয়ে এলো।
কী লাগবে চাচা?
লোকটি বলল, একটা কথা বলার ছিল। দোকানের মালিকের কাছে নিয়ে চলুন।
ইলিয়াস নিয়ে যায়। লোকটি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা মালিকের টেবিলে রাখলেন। বললেন, কিছুদিন আগে কাপড় কিনতে আমি এই দোকানে আসি। সেদিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম এখানে। আপনার মনে আছে কিনা জানি না। সেদিন ভুল করে টাকা বেশি চলে এসেছিল আমার কাছে। বাড়ি যাওয়ার পর থেকে আমি আরও অসুস্থ বোধ করি। হাই প্রেশারের রুগি। এই কয়টা দিন বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। আজ একটু ভালো বোধ হতে টাকাটা ফেরত দিতে এলাম। দেরী হওয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।

পোশাক এমন হতে হবে যাতে সেজেছে বলে মনে হবে না আবার পরিপাটিও থাকে। যুবক ইলিয়াসকে সুদর্শন না দেখালেও তার আকর্ষণীয় চেহারাটা অভাব অনটনের আড়ালে থেকে গেছে। আজ বিশেষ একটা দিন। তাই নিজেকে একটু সাজিয়ে নিচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছুঁড়ে যাবো শব্দব্রহ্ম
পরবর্তী নিবন্ধলিটল এঞ্জেলস গ্রামার স্কুলে বই বিতরণ