আয়ত্তে এলো ‘টেকনিক’

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

‘টেকনিক’ আয়ত্তে আসায় কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প প্রত্যাশার চেয়ে বেশি গতি পেয়েছে। নির্ধারিত সময়ের অন্তত তিনমাস আগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশের গড়ে উঠা পলিথিন পাহাড় সরাতে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা হিমশিম খেলেও ‘টেকনিক’ আয়ত্তে আসার পর কাজ সহজ হয়ে গেছে। অপরদিকে সদরঘাটে লাইটারেজ জেটি চালুর কারণে নদী ভরাটের প্রবণতা বাড়ার একটি আশংকা করা হলেও তা না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ বেশ স্বস্তিতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, জোয়ার ভাটার কর্ণফুলী নদীর যেই চরিত্র তাতে প্রতি দশ বছর পর এখানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প পরিচালনার পরামর্শ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। কর্ণফুলী নদী ভরাট হওয়ার প্রবণতা বেশি। খুবই অল্প সময়ে নদীতে চর জেগে উঠে। একটি খুঁটি পুঁতে রাখলেও তা ঘিরে তৈরি হতে থাকে বালুচর। কিন্তু নানা ধরনের জটিলতায় কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল না বহুদিন ধরে।
নানা প্রক্রিয়া শেষ মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানিকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ দেয়া হলেও তারা নিজেরা কাজ না করে সাব কন্ট্রাক্ট দেয় স্থানীয় প্যাসিফিক মেরিন নামের অপর একটি কোম্পানিকে। কিন্তু দেশি-বিদেশি দুই কোম্পানি নানাভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এতে করে শিকেয় উঠে পুরো প্রকল্প। এক পর্যায়ে প্রকল্প ফেলে গা ঢাকা দেয় স্থানীয় কোম্পানির কর্মকর্তারা। মালয়েশিয়ান কোম্পানিও চলে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়া এবং ড্রেজিং এর নামে নদীর বিভিন্ন অংশ ভরাট এবং বালি বিক্রি করার কারণে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ে কর্ণফুলী। কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ সব আয়োজনই মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীতে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামে নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার বালি ও মাটি উত্তোলনে পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহিত প্রকল্পটির আওতায় ‘সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর’ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়। ডিপিএম পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনা কোম্পানি ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
নয়া নামে নয়া প্রকল্প নিয়ে বেশ উৎসাহের সাথে কাজ শুরু করা হলেও নদীর তলদেশের পলিথিন জঞ্জালে সব আয়োজন ভুণ্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। নদীর তলদেশে বিশ ফুট পুরু পলিথিন আস্তর চীনা প্রকৌশলীদের সব বুদ্ধি ফেল করে দেয়। নদীর তলদেশে ড্রেজার দিয়ে কাজই করা সম্ভব হতো না। এক বছরেরও বেশি সময়েও মাত্র ত্রিশ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছিল ই ইঞ্জিনিয়ারিং নামের চীনা কোম্পানি। এরমধ্যে তারা চীন থেকে বিশাল আকৃতির কাটারও এনেছিল।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে যখন চীনা কোম্পানি দিশেহারা তখন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম প্রকল্পটির ব্যাপারে নতুন একটি পরামর্শ দেয়। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয় যে, নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করতে হবে। এতে প্রকল্প ব্যয় ৬৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাবে। এই বৃদ্ধি অনুমোদন করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩২১ কোটি টাকা।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই পরামর্শটি এই প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বুয়েটের বিটিআরসি দিয়েছে তা হচ্ছে ‘টেকনিক’। প্রকল্পটির কাজ নিয়ে দিশেহারা চীনা প্রকৌশলীদের এই টেকনিক শিখিয়ে দেয় বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন যে, নদীর তলদেশের প্রথম স্তরের আড়াই তিনফুট পলিথিন ও মাটি যদি গ্রেভ দিয়ে তুলে আনা হয় পরের স্তরের মাটি ও বালি কাটার দিয়ে কেটে তোলা যাবে। বিশেষজ্ঞদের এই পরামর্শ মেনে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা প্রথমে ড্রেজিং এরিয়া থেকে গ্রেভ দিয়ে একটি স্তর তুলে নেন। এই স্তর তোলার পরই ওই এলাকায় কাটার দিয়ে ড্রেজিং করা হয়। এতে করে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর কাজে ব্যাপক গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির কাজ ৫৭ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। টেকনিক শিখে যাওয়ায় প্রকল্পটির কাজে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি গতিশীলতা তৈরি হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।
অপরদিকে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট এলাকায় চারটি লাইটারেজ জেটি চালু হওয়ার পর ওই এলাকাটিতে নদী ভরাটের প্রবণতা বাড়ার একটি আশংকা করা হয়েছিল। এজন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের সাথে জড়িতদের সতর্কও করা হয়েছিল। জেটি ব্যবহারকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বলে দেয়া হয়েছিল যে কোন ধরনের ভরাট প্রবণতা কিংবা জাহাজের তলা আটকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে তা যেন সাথে সাথে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প পরিচালককে জানানো হয়। কিন্তু গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সদরঘাটে লাইটারেজ জেটিগুলো ব্যবহৃত হলেও এই ধরনের কোন সংকট তৈরি হয়নি।
এটি একটি ভালো দিক বলেও প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ মন্তব্য করেন। গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমরা খুবই সংকটে ছিলাম। বহু কষ্ট করতে হয়েছে। পলিথিন নিয়ে আমাদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না। কিন্তু টেকনিক শিখে যাওয়ার পর আমাদের কাজ অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু আমরা মার্চের মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর কাজ শেষ করতে পারবো। কাজে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি গতি এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচন কমিশন গঠিত হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে
পরবর্তী নিবন্ধটাকা পাচার : এসপিসি ওয়ার্ল্ডের এমডি সস্ত্রীক কারাগারে