আশালতা

নজরুলের উত্থান পতনময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম

ডেইজী মউদুদ | শুক্রবার , ২৪ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ওসমান আয়েষাকে বলেছিল ‘আমি আশালতা ধরিয়া আছি. আর কতোকাল ইহার তলে জলসিঞ্চন করিব? ” আজ কবি ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসের নামকরণ দেখে চমকে উঠি। নজরুলের আশালতাতে বঙ্কিমের আশালতার অদৃশ্য যোগসূত্র যেন খুঁজে পেলাম ।

 

বাঙলা উপন্যাসে প্রেম, প্রণয় এবং রোমান্টিকতার সার্থক রূপায়নে বঙ্কিমচন্দ্র কথাসাহিত্যে শীর্ষস্থানে আসীন। বিষয়বস্তু নির্ধারণ, দেশকাল ও সমাজের সমকালীন প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরতে গিয়ে ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজনীতির সাথে বাস্তব ঘটনাকে এক সুতোয় গেঁথে কাহিনীতে রোমান্টিসিজমের অসাধারণ

প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি । কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীও তাঁর ‘আশালতা’ উপন্যাসে আশালতার যাপিত জীবনের প্রতিবিম্ব আঁকতে গিয়ে সমকালীন রাজনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং কবির জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যিকারের কাহিনিগুলোকে কল্পনার রসে অনেক বেশি সঞ্জীবিত করেছেন। ফলে আশালতা এই

উপন্যাসে অন্যরকম এক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। লেখকের সংবেদনশীলতায় এউপন্যাসে কবি নজরুলকে ছাপিয়ে আশালতা হয়ে ওঠেন পাঠকের মূল আকর্ষণ। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘একদিকে পুরা দেশ কাঁপিয়ে তুলেছেন বিদ্রোহী কবি, অন্যদিকে প্রেমিক কবির সাথে বিভিন্ন নারীর নানা মাত্রার সম্পর্ক তার

স্ত্রীর জীবনকে করে তুলেছে যেন অপার সমুদ্রে এক দিশাহীন জলযান। কবির উত্থান পতনময় জীবনের চির অবিচ্ছেদ্য নাম আশালতা। আসলেই তাই। কবির জীবনের এই অবিচ্ছেদ্য নামই আশালতা।

আশালতা সেনগুপ্তা কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রীর আসল নাম। ডাক নাম দোলন, আরো সংক্ষেপে দুলি। আর কবি তার নাম রাখলেন প্রমীলা। এই প্রমীলাই কবিকে ভালোবেসেছিলেন আমৃত্যু। ভালোবাসার টানে জাত কূল ছেড়ে প্রমীলা বিদ্রোহী কবির সাথেই গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। বিদ্রাহী কবি হিসাবে

জগৎজোড়া খ্যাতি পেলেও কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন আজীবন প্রেমিক ও রোমান্টিক কবি। প্রেম তার কাছে এসেছে বারে বারে নানা অনুষঙ্গে, বিস্ময় আর বৈচিত্র্যে। তিনি বহু নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁরাও এই খ্যাতিমান ও প্রবল জনপ্রিয় কবির প্রতি দুর্বল হয়েছিলেন সঙ্গত কারণেই। কিন্তু চিরপ্রেমিক এই

মানুষটির কাছে প্রেম যেন এক অধরা মাধুরী। নানা ঘটনার কারণে তাঁর কোনো প্রেমই মিলনের পূর্ণতা পায়নি।। তাঁর জীবনে একমাত্র নারী আশালতা ওরফে দোলন, আর কবি প্রদত্ত নাম প্রমীলাই ছিলেন একমাত্র জীবনসঙ্গিনী, যিনি শত কষ্ট আর বঞ্চনার মাঝেও কবিকে ছেড়ে যান নি। সেই আশালতার

দাম্পত্যজীবনের যাবতীয় সুখদুঃখ, ভালোবাসা প্রেম বিরহ মিলন এবং সাংসারিক জীবনের চরম দারিদ্র্য, বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রাম এর ধারাবাহিক চিত্রের অনবদ্য এক সাহিত্যিক মূল্যায়নের নাম ‘ আশালতা’ । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে আশালতার চরিত্র কোনভাবেই উদ্ভাসিত ছিল না. যদিও

কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় জুড়েই ছিল আশালতা নামের এ্‌ই সাধারণ নারীটি। কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী তাঁর মেধা, শ্রম আর গভীর পর্যবেক্ষণ আর কল্পনাশক্তির মধ্য দিয়ে সরস ও পুঙ্খানুপুঙ্খ এক গবেষণার নিগড়ে বেঁধেছেন আশালতাকে। সাহিত্যিক চেতনার সাথে কল্পনা আর বাস্তবের সমীকরণে এই উপন্যাসে আশালতা অনন্য হয়ে ওঠে।

উপন্যাসে আশালতাই প্রধান চরিত্র। কবির জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তিনি নজরুলের জীবন জুড়েই রিাজমান। অতিমাত্রায় চঞ্চল নজরুলের বাঁধনহারা স্বভাবের কারণে নজরুলের অর্থনেতিক জীবন ছিল অস্থিতিশীল। গ্রামোফোন কোম্পানির উচ্চ মাইনের চাকরি আর চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার সূত্রে টাকাপয়সা পেয়ে

ক্রাইসলার গাড়ি কিনতে ও বাড়িতে নেপালি দারোয়ান রাখতে যেমন দ্বিধা করেননি, তেমনি সামান্য টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে দিতেও দুবার চিন্তা করেননি। প্রচুর অভাবের সময়ে বন্ধুরা অনেকেই ছেড়ে গেছেন তাঁকে, কিন্তু একমাত্র আশালতাই আমৃত্যু ছিলেন স্বামীর পাশে। এমনকি নিজের শারিরীক

পঙ্গুত্ব সত্ত্বেও মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামীকে সেবা করে গেছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। লেখক আশালতার এই অবস্থানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে হৃদয়বত্তার পরিচয় দিয়েছন। তাঁর সুখদুঃখ, প্রেম ভালোবাসা, আশাহতাশা আর মিলন বিরহকে পাঠকের কাছে অত্যন্ত সরস ও শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করেছেন।

কবির সাথে নার্গিসের বিয়ে এবং নার্গিসকে ফেলে কবির দৌলতপুর ত্যাগ, প্রমীলার পরিবারে কবির অবস্থান, কবির সাথে প্রমীলার পরিচয়, ক্রমে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি, পরিশেষে বিয়ে সব ঘটনার বর্ণনায় লেখক সাবলীল। ঘটনার মালা সাজাতে তিনি কখনোই আবেগের অতি প্রকাশ ঘটাননি, বরং নিপুণ শিল্পীর

মতো তিনি একটি ধারাবাহিক বিবরণ এনে পাঠকের সামনে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। বহু বিচিত্র ঘটনা ও চরিত্রের সমাগম ঘটেছে একটি একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার সাহিত্যিক রূপ দিতে গিয়ে। কিন্তু কোথাও খাপছাড়া বা একঘেয়ে লাগেনি। পুরো উপন্যাস জুড়েই যেন তিনি কবির প্রতি আশালতার যে গভীর

প্রেমবোধ ও প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল তাই সাহিত্যরসঘন মন্ডিত করেছেন। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে চিরদুঃখিনী আশালতার দুঃখ ও বেদনায় পাঠক মনও হুহু করে উঠে। কাহিনির শুরুতে যে প্রশ্ন করেছিল কবি, কি পাপ করেছিলাম মাসীমা? সেই প্রশ্নের উত্তর পুরো উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠকও যে খুঁজতে থাকে!

আগেই বলেছি, আশালতার কাহিনি একটি সত্যিকার এবং বাস্তব ঘটনা থেকে উৎসারিত। সত্যিকারের ঘটনা পাঠক সমক্ষে উপন্যাসে রূপায়িত করা অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। লেখক এই কাজটি সার্থকতার সাথে করেছেন। কাহিনী বিন্যাস, শব্দচয়ন, ছোটছোট বাক্য নির্মাণ ছাড়াও সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল উপন্যাসের

প্রাণ। গান আর কবিতাগুলোকে তিনি কাহিনীর সাথে নান্দনিকভাবেই চিত্রিত করেন। প্রতিটি সংলাপ যেন চরিত্রের বৈশিষ্টকে তুলে ধরে। লেখার ভঙ্গিতে এমন কিছু আছে, পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, লেখক যেন নিজের মুখেই আমাকে আশালতার কািহনি পাঠ করে শোনাচ্ছেন। আর ঘটনা বর্ণনায় প্রকৃতি আর প্রেমকে

অসাধারণ চিত্রপটে এঁকেছেন, একজন নিপুণ শিল্পীর মতো প্রতিটি ছত্রই যেন চিত্রপটে আঁকা ছবির মতোই স্পষ্ট। একজন সফল লেখকের কাছ থেকে এটিই তো পাঠকের প্রত্যাশা। সর্বমোট ১৭৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি ছেপেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাসুক হেলাল। এটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪২৫ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশামসুল আরেফীনের ‘চট্টগ্রাম জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি’
পরবর্তী নিবন্ধঅভিভাবকদের জন্য নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনে কর্মশালা