আল্লামা শাহ্‌ সফিরুর রহমান হাশেমী (র)

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ | মঙ্গলবার , ২২ মার্চ, ২০২২ at ৮:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার প্রচার ও প্রসারে যে সমস্ত সূফী সাধক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদীস, আল্লামা শাহ্‌ সফিরুর রহমান হাশেমী (র) এর নাম বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
তিনি মাতার দিক দিয়ে আমিরুল মুমিনিন হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) এবং পিতার দিক দিয়ে হজরত গাউছ সাক্‌লাইন মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র)এর সুযোগ্য বংশধর ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটস্থ ছলিমপুর গ্রামে হজরত মাওলানা ওবাইদ উল্লাহ হাশেমী (র) এর ঔরসে ১৮৮৭ সনে জন্মলাভ করেন। তদীয় পূর্ব পুরুষ মুহাম্মদ ছলিম কাজীর নামানুসারে ছলিমপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে।
মাত্র সাত বৎসর বয়সে মাতৃহারা হলে পিতার তত্ত্বাবধানে তিনি পবিত্র কুরআন শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় মাদ্রাসায় আরবী, উর্দু, ফার্সীতে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় কিতাব অধ্যয়ন করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে তিনি অনেকটা মুষঢ়ে পড়েছিলেন। বার্মা প্রবাসী তদীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাওলানা খায়রুল বশরের অনুপস্থিতিতে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত পারিবারিক কাজকর্ম এমনকী খেত-খামারের কাজও তিনি নিজ হাতেই সমাধা করতেন। তথাপি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রতি তাঁর অদম্য স্পৃহা এবং তদানিন্তন স্বনামধন্য আলেমদের মত পাণ্ডিত্য অর্জনের মনোবাসনা তাঁকে ভারত গমনের জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে। ইত্যোবসরে তিনি নিজ মহল্লার ছোট্ট বাচ্চাদের লেখাপড়ার ভার গ্রহণ করেন। তথাকার জনৈক ভদ্র মহিলার বদান্যতার কারণেই বিদেশ গমনের প্রাথমিক খরচাদি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।
তথাকার মহল্লার মসজিদের ইমাম ছিলেন ভারতের জৌনপুর নিবাসী একজন হাফেজ। ভারতে গিয়ে লেখাপড়ার জন্যে তিনিই সর্বপ্রথম হজরতকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। হজরতের বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে তাঁর বড় মামা মাওলানা এরশাদউল্লাহ এবং মেঝ খালার অনুপ্রেরণা উল্লেখযোগ্য। একদিন হজরত, জৌনপুরের বর্ণিত হাফেজ সাহেবের সাথে ভারত গমনের উদ্দেশ্যে ভাটিয়ারি স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদপুর ও গোয়ালন্দ হয়ে কোলকাতা পৌঁছলেন। এখানে এসে শুনলেন তালতলায় তাঁর পূর্ব পুরুষ হাসান শরীফ ফৌজদার এর যে সমস্ত জমি-জিরাত ছিল তা ইতোমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। হজরত সেখান থেকে জৌনপুরে এসে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা হেদায়েত উল্লাখ খান এর কাছে আরবী ব্যাকরণের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। অত:পর মাওলানা সাহেবের নির্দেশে হজরত বেনারস চলে আসেন। বেনারসের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল আলীর সান্নিধ্যে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।
বেনারস অবস্থানকালে হজরত খন্ডকালীন দুঃখ দুর্দশায় কালাতিপাত করেছেন। এমনকি দীর্ঘ তিন বছর বালিশ ছাড়া রাত যাপন, মাত্র দেড়খানা রুটির সাথে এক চামচ ডাল দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছেন। কয়েক বছর যাবত হজরত মাত্র একটি লুঙ্গিতেই দিন কাটিয়েছেন। বিদেশ বিভূঁইয়ে এভাবে অর্ধহারে-অনাহারে থেকে হজরত আল্লাহপাকের মর্জির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। ছাত্র জীবনের দিনগুলোতে দিন দিন পুষ্টিহীনতায় ভুগে তাঁর শারীরিক ক্ষমতা লোপ পেতে থাকলে তিনি ভেষজ গাছের পাতা চিবিয়ে তার রস পান করতেন। এত কষ্টের মধ্যেও তিনি জ্ঞান সাধনার এ মহান পরীক্ষায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি।
মাওলানা আব্দুল আলী সাহেবের সান্নিধ্যে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে তাঁরই উৎসাহে হজরত উত্তর প্রদেশের রামপুর এসে মাওলানা ফজলে হক রামপুরীর তত্ত্বাবধানে মাদ্রাসা আলীয়াতে ভর্তি হন। এখানে লেখাপড়ায় সফলতা প্রদর্শনের ফল স্বরূপ কর্তৃপক্ষ হজরতের জন্যে ১৫টাকা মাসোহারা নির্ধারণ করেন। ইসলামী জ্ঞানে হজরতের বিশাল পাণ্ডিত্য দেখে হায়দারাবাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর জন্যে আরো পাঁচ টাকা মাসোহারা নির্ধারিত হয়। ভোগ বিলাস ও আনন্দ বিমুখতা তাঁর সঙ্গী ছিলো। আরাম, আয়েশ, খাওয়া দাওয়ার প্রতি অনীহা তাঁকে মাহাত্ম্য দান করেছে। আলীয়া মদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি মাওলানা মুফ্‌তি এবং মোহাদ্দেস উপাধিতে ভূষিত হন। এরপরও তিনি হাদীস শাস্ত্রের উপর দীর্ঘ চার বৎসর গবেষণা করেন। হাদীসের হাফেজ ছিলেন বিধায় প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার ছহিহ্‌ হাদীস কণ্ঠস্থ করে তিনি শায়খুল হাদীস রূপে বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। পরিশেষে তিনি হেকিম শাস্ত্রেও বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। মাদ্রাসা আলীয়াতে হজরতের ব্যক্তিগত পরিচিতির সীমা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে একদিন তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসা পরিদর্শনে যান। সেখানকার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি হজরতকে স্বাগত জানান। মাওলানার সাথে ফাতেহা শরীফ, সানি জামাত ইত্যাদি বিষয়ে হজরতের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। এতে তিনি হজরতের কাছে উপরোক্ত বিষয়গুলো জায়েজের ব্যাপারে নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। এমনকি তিনি যে নিজ বাড়িতে বুজর্গদের ফাতেহা শরীফের অনুষ্ঠান করেন তাও অকপটে হজরতের কাছে স্বীকার করেন।
রামপুরের কাজী সাহেব ইসলামী আইন শাস্ত্রের জটিল ব্যাখ্যাগুলো হজরতের কাছ থেকে জেনে নিতেন। তাই তিনি মুফতি হিসেবেও রামপুরে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মহল্লা ‘জিনা এনায়েত খান’ এ তাঁর স্বহস্তে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা আজিজিয়া এখনও বিদ্যমান।
রামপুরের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা মিয়া মোহাম্মদ শাহ নকভী রামপুরী (র.) এর খেদমতে, মাদ্রাসা আলীয়ার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা মুনাওয়ার আলী শাহ্‌ সাহেব সমভিব্যহারে তশরীফ নিয়ে গেলে রামপুরী সাহেব হজরতকে দেখে অত্যন্ত প্রীত হন এবং হাদিস শাস্ত্রের জটিল ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে হজরতের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতেন।
কিন্তু এত কিছুতেও তাঁর মনের তৃষ্ণা মিটলোনা। জাহেরী জ্ঞানের আধার এ মহান সাধক সৃষ্টিকর্তার বাতেনী পরিচয় লাভের তীব্র বাসনায় দগ্ধিত চিত্তে ছট্‌ ফট্‌ করে ফিরছিলেন। রামপুরের খানকাহ এনায়েতীয়াতে তখন সমাসীন জামানার কুতুব তরীকতের কান্ডারী হযরত শাহ হাফেজ এনায়েত উল্লাহ খান রামপুরী (র)। অতপর একদিন জ্ঞান লাভের আগ্রহ নিয়ে খানকাহ্‌ শরীফে প্রবেশ করলেন। শায়খের ইংগীতে তিনি মাগরিব এর নামাজান্তে হাল্‌কাতে বসে পড়লেন। পীর ছাহেব এহেন জজ্‌বা সম্পন্ন গুণী শিষ্যের কাইফিয়ৎ দৃষ্টে অত্যন্ত আপ্লুত হয়ে হজরতকে মুহূর্ত মধ্যে নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার ফয়েজ ও বারাকাতে মালামাল করে দিলে তিনি নিজ পরিচয় পর্যন্ত বিস্মৃত হয়েছিলেন। খানকাহ্‌ শরীফে দীর্ঘদিন পীর ছাহেবের খেদমতে নিয়োজিত থেকে তাঁরই নির্দেশে হজরত মাতৃভূমি চট্টগ্রামের পথে রওয়ানা হলেন। দীর্ঘ দিনের প্রবাস জীবন তাঁকে দিয়েছে জাহেরী জ্ঞানের অফুরন্ত নেয়ামত এবং বাতেনী জ্ঞানের অভূতপূর্ব মহিমা।

পথিমধ্যে কোলকাতা আলিয়া মাদ্রসার শিক্ষকতার লোভনীয় চাকরির অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চট্টগ্রামে এসে মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র আড়াই বছরের মাথায় মাদ্রাসার এক অনুষ্ঠানে জনৈক ইংরেজ অফিসারকে স্বাগত জানাতে বাধ্য করলে হজরত ঐ পদে ইস্তফা দেন। এরই মাঝে অল্প সময়ের জন্য ঢাকা দারুল উলুম হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস এর পদ অলংকৃত করেন। কিন্তু পার্থিব সুখানুসন্ধানী আলেমদের সাহচর্য পছন্দ না হওয়াতে সেখানেও ইস্তফা দেন। ইতোমধ্যে সরকারের আমন্ত্রণে বরিশালের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান শর্ষিণা দারুল সুন্নত আলীয়া মাদ্রাসায় হাদীসের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। এখানে কিছুদিন অবস্থানের পর নাড়ীর টানে হজরত চট্টগ্রাম ফিরে এসে চন্দনপুরা দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদেন।
১৯৩২ সালে তিনি হেকিমী শাস্ত্রে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করেন এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চত্বরের একটি কক্ষে ‘হাশেমী দাওয়াখানা’ প্রতিষ্ঠা করে হেকিমী ব্যবসায় এবং একইসাথে আর একটি কক্ষে ‘খানকাহ সফিরিয়ায়’ তরিকতের কর্মকান্ড চালাতে থাকেন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব হজরত আবদুল হামিদ বাগদাদী (র) প্যালেস্টাইন যুদ্ধে যাবার সময় হজরতকে এই মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ খতিবের দায়িত্ব সমর্পণ করে যান। হজরত অত্যন্ত সততার সাথে দীর্ঘ আট বৎসর কাল অবৈতনিক খতিবের দায়িত্ব পালন করেন।
কথিত আছে যে, হজরতের দরবারের রূহানী মাহফিলে মারিফাত অন্বেষুদের অবস্থা এতই নাজুক হতো যে নিজেকে স্থির রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে যেত।
হযরতের রূহানী ফয়েজে অভিষিক্ত হয়ে যে সমস্ত মনীষী চট্টলার মারিফাত জগতে অত্যন্ত মর্যাদা পূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সর্বোপরি হজরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারি (র), শেরে বাংলা আজিজুল হক আলকাদেরী (র.), চুনতির শাহ ছাহেব (র) এবং কুতুবদিয়ার মালেক শাহ্‌ (র) এর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়।
শরীয়তের বিধিবিধান এবং সরকারে দোজাহান, নূরে মুজাচ্ছাম হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নতের পায়রবীতে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি পবিত্র রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফের মাধ্যমে নীরবতা পালন করতেন। প্রায় সময় তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল হজরত শাহ্‌ সূফী আমানত খান (র) এর রওজা শরীফে বসে বিনয়াবনত চিত্তে ধ্যানের সাগরে ডুবে যেতেন।
মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে ইমামতি, দাওয়াখানাতে দুস্থ রোগীদের হেকিমী পরামর্শ এবং তরীকত পন্থীদের মারিফাতে দীক্ষা দান এই চতুর্বিধ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে এল্‌ম তাসাওফের এই দেদীপ্যমান নক্ষত্র হজরত মাওলানা সফিরুর রহমান হাশেমী (র) ৬৭ বৎসর বয়স অতিক্রমকালে ১৯৫৪ সনে হিজরী ১৩৭৪ সনের ১৮ শাবান মঙ্গলবার মহা মিলনের পথে যাত্রা করে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন।
চট্টগ্রামের সুন্নী আলেম ওলামা এবং দেওবন্দী আলেমগণও হজরতের প্রতি অত্যন্ত সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে জানাযা অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে শেরে বাংলা হজরত আজিজুল হক আলকাদেরী (র.) সহ অন্যান্য ওলামায়ে কেরামের সাথে পটিয়া মাদ্রাসার মুফতি আজিজুল হক ও অন্যান্য আলেমদের মধ্যে ইমামতির দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। অবশেষে উভয় পক্ষই হজরতের একমাত্র সাহেবজাদা হজরত মাওলানা মোস্তাকীম হাশেমী (ম.) এর ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন।
শিশু কালের অমলিন স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমি ফৌজদার হাটে নয়ন মনোহর মকবরা শরীফে হজরতের মাজার মোবারক অবস্থিত। এমন একজন ক্ষণজন্মা মহা পুরুষকে নিজের বুকে স্থান দিতে পেরে ফৌজদার হাটের পাক জমিন আজ স্বর্গীয় মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি নারী
পরবর্তী নিবন্ধচা শিল্প : বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এগিয়ে চলছে বীরদর্পে