আলোর পথযাত্রী

ঝর্না বড়ুয়া | শুক্রবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

তথাগত বুদ্ধের সেই মহান বাণী, ‘মানব জীবন দুর্লভ’। এ দুর্লভ জীবনকে শ্রেষ্ঠতর ও উন্নতর পর্যায়ে নেওয়ার জন্য নিজেদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে, প্রতিনিয়ত অধ্যবসায়ের মাধ্যমে প্রকৃত প্রজ্ঞা চর্চা, সত্য দর্শন, জীবের প্রতি প্রেম, উদার উন্নত চিন্তা-চেতনা, সততা, অদম্য শক্তি সাহস ও মানবতার মূর্ত প্রতীক হয়ে সমাজ সদ্ধর্ম কে আলোকিত করেছেন অনেক মহান ব্যক্তিত্ব। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সমাজের কৃতী সন্তান, আপাদমস্তক শিক্ষক, আদর্শ পিতা, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, অনন্য ব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি বড়ুয়া। তিরি যেমন স্থির শান্ত স্বভাবের, তেমনি অতি সাধারণ সহজ-সরল জীবনাচরণে অভ্যস্ত। তিনি মিতভাষী ও মানবতাবাদী গুণীজন, অনন্য প্রতিভায় সমুজ্জ্বল।
তিনি ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার জাঁহাপুর যা লোকমুখে কোঠের পাড় ঐ গ্রামে এক সম্‌ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতার নাম বিনোদিনী রানী বড়ুয়া এবং পিতার নাম ডাঃ গোপেন্দ্র লাল বড়ুয়া এল, এম, এফ।
তিনি গ্রামের প্রাইমারি গণ্ডী পেরিয়ে হাই স্কুল থেকে সফলতার সাথে ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হয়ে চট্রগ্রামের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা থেকে পরিচালিত চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সেই যুগেও একজন ডাক্তার বাবার অভিজাত সন্তান হয়েও সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা আর দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি কারিগরি শিক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। চাইলে যে কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে পারতেন অনায়াসে কিন্তু সেদিকে তিনি যাননি। তিনি বিচক্ষণতার সাথে কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন সেই কিশোর জীবন থেকে। ডিপ্লোমা পাস করার পর তিনি থেমে থাকেননি আবার কলেজে ভর্তি হয়ে প্রাইভেটে ব্যাচেলর ডিগ্রী (বি,এ পাস) লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করার সাথে সাথে নিজেকে দক্ষ ও চৌকস হিসাবে গড়ে তোলার মানসে তিনি বিভিন্ন পেশাগত কোর্স গ্রহণ করতে শুরু করলেন। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম গোল্ড মেডেলিস্ট পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন পূর্ব পাকিস্তান সার্ভে ইনস্টিটিউট, ময়নামতি, কুমিল্লা থেকে “সার্ভে ” ফাইনাল পরীক্ষায়। তিনি কঠিন অধ্যবসায়, অদম্য শক্তি, সাহস, পরিশ্রমী ও প্রতিভাবান ছাত্র হিসাবে নিজেকে বিকশিত করার আত্মপ্রত্যয়ী ও উদ্যমী ছিলেন। ঢাকা টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ডেরা অধীনে টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে “ডিপ্লোমা ইন টেকনিক্যাল এডুকেশন” কোর্স সফলতার সাথে সমাপ্ত করেন। পরিশেষে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তিনি বি,এস,সি ইন টেকনিকাল এডুকেশন (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রী অর্জন করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। কতোটা আত্মপ্রত্যয়ী উদ্যেমী মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান সত্তা হলে সুদীর্ঘ পথ এ শিক্ষা জীবনের জার্নিটাকে প্রবাহমান করতে পারেন তা তাঁর শিক্ষা জীবন পর্যালোচনা করলে অতি সহজে বোঝা যায়। ক্লান্তিহীন যাত্রায় নিজেকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন এবং শিক্ষা জীবনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছেন একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। তা আজ আমাদের প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি প্রতিটি মানুষকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে দৃঢতার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রকৌশলী অধ্যাপক মৃণাল কান্তি বড়ুয়ার শিক্ষা জীবন থেকে সহজে উপলব্ধি করা যায়। তাই ওয়াল্ট ডিজনির ভাষায় বলি, “মানুষের পক্ষে সব স্বপ্নই পূরণ করা সম্ভব, যদি সে যথেষ্ট সাহসী হয়”। আবার কনফুসিয়াসের মতে, ‘জীবন সহজ নয়, জটিলও নয় – জীবন জীবনের মতো, আমরাই একে সহজ করি জটিল করি’।
তিনি কর্মজীবনের অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্য জগতেও অনন্য অবদান রেখেছেন। সময়ের যথার্থ ব্যবহার করে সুযোগ হলেই কলম ধরেছেন সমাজের অসঙ্গতি, ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিসঙ্গত দাবীদাওয়া এবং কারিগরি শিক্ষার বহুমুখী গুরুত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কারিগরী শিক্ষার দুইটি বই যথাক্রমে হাইওয়েজ এন্ড এয়ারপোর্টস এবং চেইন সার্ভেয়িং প্ল্যানটেবলিং এন্ড টার সিয়ারী ট্রাভাসিং। মাধ্যমিক শিক্ষার একটি বই লিখেছেন তা হলো বিল্ডিং মেটেরিলেস ও ইহাদের ব্যবহার। তিনি সাহিত্য চর্চায় প্রবেশ করে সর্বসাধারণের কল্যাণেও তিনি সময়োপযোগী প্রকাশনার কাজ করেছেন যথাক্রমে ১.বৃদ্ধ মানুষ ও বয়সী বৃক্ষ, ২.মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষা সমাচার, ৩.সত্যই ধর্ম ও মিথ্যা কুজ্বটিকাময়, ৪. পুষ্পিত মোহনায়, ও ৫. আত্মজীবনী। ছাত্রজীবনে “কাকলী” ও “অয়ন ” নামে দুটি বাৎসরিক ম্যাগাজিনের প্রকাশনার গুরু দায়িত্ব পালন করতেন সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে। সুদীর্ঘ দীপ্ত পদাচরণে বিভিন্ন কল্যাণমূলক ও প্রচারমূলক কাজে সম্পৃক্ত থেকে সকলের মন জয় করেছেন। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সংগ্রহ, থাকার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি তথ্য সংগ্রহের কাজ করে দিয়ে দেশ মাতৃকার স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
কথায় আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’। এ কথার হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায় মৃণাল বাবুর ধর্মপত্নীর কাছে। তিনি একজন অনুপ্রেরণাকারী জীবনসাথী হিসাবে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে স্বামীর কর্মগুণকে এগিয়ে দিয়েছেন নিজের অনুপ্রেরণায়, উদারতায় আর সহমর্মিতায়। তাঁর নাম বীণাপাণি বড়ুয়া এবং তিনি একজন রত্নগর্ভা মা। তিনি নিজেও নারীর জীবনমান উন্নয়ন নারী সচেতনতায় দীর্ঘসময় কাজ করে আসছেন। এখনো তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি মহিলা শাখায় ধর্মীয় সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালনসহ বহু মানবতাবাদী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সমাজের ছিন্নমূল সাধারণ মানুষের নিত্যকার সমস্যাগুলো হৃদয়ের গভীরে ধারণ করে সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের পরস্পর বোঝাপড়া, গ্রহণযোগ্যতা, আদর্শ, সিদ্ধান্ত নেওয়া ও শ্রদ্ধায় জায়গাটা ভীষণ সুন্দর ও মজবুত। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনাচরণ থেকে দেখতে পাই শ্রদ্ধেয় ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন নীরব একজন অনুপ্রেরণাকারী। সর্বোপরি এখনো একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শে তিন পুত্র, পুত্রবধূগণ, দুইজন নাতী ও তিনজন নাতনী নিয়ে মহানন্দে বৌদ্ধিক আদর্শে সাধারণভাবে হাসিখুশি, মায়া-মমতা, সুখেদুঃখে একত্রে বসবাস করছেন।
প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি বড়ুয়া ছাত্রজীবন থেকে এখনো ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একজন কাজ পাগল মানুষ। পেশাগতভাবে অবসর নিলেও দেশের শীর্ষ বৌদ্ধ সংগঠনগুলোতে এখনো গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। তন্মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির সহ-সভাপতি, বুদ্ধজ্যাতি আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি। তাঁর চিন্তা-চেতনা আর ধ্যানে জ্ঞানে বাংলাদেশ সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সমুজ্জ্বল রেখে সমন্বিতভাবে সমাজকর্মে এক অনন্য অবদান রেখে চলেছেন। ‘পদ্মবীণা ফাউন্ডেশনের’ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এছাড়া বহু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন। সমাজসেবা, শিক্ষা ও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মকাণ্ডে ও আর্তমানবতার সেবার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রাম থেকে সুদীর্ঘ ১৫ বৎসর (২০০৬-২০২১ খ্রীষ্টাব্দ) পর্যন্ত তাঁকে বিভিন্নভাবে সম্মাননা দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন এতো অল্প লেখায় কোনভাবে সম্ভব নয়। গোটাজীবন শিক্ষাকে গ্রহণ করেছেন আর শিক্ষার আলোর দ্রুতি ছড়িয়েছেন। এককথায় প্রকৌশলী অধ্যাপক মৃণাল কান্তি বড়ুয়া একজন আলোর পথযাত্রী। যার পুরো জীবন জ্ঞানের আলোয় আলো ভরা। আমাদের উচিত তাঁর জীবনাদর্শের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ভারতরত্ন ড. এজিপি আব্দুল কালাম এর ভাষার বলি, ‘চলুন আজকের দিনটি আমরা উৎসর্গ করি, যাতে আমাদের সন্তানরা কালকের দিনটিকে উপভোগ করতে পারে’। প্রত্যাশা করি অনন্য প্রতিভায় সমুজ্জ্বল প্রকৌশলী অধ্যাপক মৃণাল কান্তি বড়ুয়া নিরোগ শতায়ু পার করুন, জ্ঞানবৃক্ষের মতো জাতির বাতিঘর সদৃশ্য হয়ে আমাদের আদর্শরূপে বিরাজমান থাকুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা কি পুরোপুরি বাঙালি?
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা